শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

তারুণ্যের সংবেদনশীলতা শক্তি ও সীমা

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৩৩ পিএম

সমাজ রূপান্তরের প্রথম স্পন্দন তারুণ্যের রক্তধারায় সিক্ত, ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। এই ‘সংবেদনশীলতা’-কে ভøাদিমির ইলিচ লেনিন তার বিখ্যাত গ্রন্থ What Is To Be Done? (১৯০২) গ্রন্থে সমাজের অন্যায় অবিচারের প্রতি অসাধারণ সংবেদনশীলতা’  (‘exceptional sensitivity to social injustice’) বলে চিহ্নিত করেছিলেন। লেনিন লিখেছেন, ‘এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নবীন অংশ, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ এবং শ্রমিক যুবকদের একটি অংশ, সামাজিক অন্যায়ের প্রতি অসাধারণ সংবেদনশীলতা, সত্যের প্রতি তৃষ্ণা এবং আত্মত্যাগের সক্ষমতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।’  

লক্ষণীয় যে, প্রথাগতভাবে শ্রেণিকে নিছকই অর্থনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করা বা অর্থনৈতিক বর্গে পর্যবসিত করবার দোষে লেনিন অন্তত এই নিবন্ধে দুষ্ট নন। ছাত্র ও শ্রমিক যুবকদের শ্রেণিগত ভূমিকা তাদের রাজনৈতিক চেতনার জায়গা থেকে লেনিন নির্ণয় করেছেন। এর সঙ্গে ‘ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম’, এবং ‘লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমেয়ার’-এ মার্কস রাজনীতিতে শ্রেণির ভূমিকা যেভাবে বিচার করেছেন তার মিল আছে।

কিন্তু তারুণ্যের এই ব্যতিক্রমী সংবেদনা একইভাবে বিপদের উৎস হতে পারে, যদি তা তাত্ত্বিক নির্দেশনা এবং রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা সিদ্ধ না হয়। ঘটনা ঘটনের তাৎক্ষণিক বিচার ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তরুণরা যদি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে তা বিপদের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা বিচার করে, তারুণ্যের সংবেদনশীলতার শক্তি ও সীমা নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

সংবেদনশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বৃত্তি। এই বৃত্তিই তরুণদের বিপ্লবের দিকে ধাবিত করে। সমাজের দমননীতি, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে তারাই দ্রুত প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে। তাই সংবেদনশীলতার মানদণ্ডে তরুণ সমাজকে সক্রিয় শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করার অর্থ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছাত্র-তরুণদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার মধ্য দিয়েও আমরা পাঠ করতে পাড়ি। এর দ্বারা রাজনৈতিক গতিপ্রক্রিয়ার অভিমুখ অনেকটাই নির্ণয় করা সম্ভব। তরুণদের আবেগ, আদর্শবাদ এবং স্বপ্ন সব কিছু মিলিয়েই তারা বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক, রাষ্ট্র ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে প্রশ্ন করতে শেখে।

তরুণদের সুস্পষ্ট নৈতিক আবেগ ও শক্তিকে শনাক্ত করা সহজ। তারা শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন চায় না তারা চায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গঠন করবার সংকল্প। কিন্তু লেনিন বারবার বলছেন, এই স্বতঃস্ফূর্ত আদর্শবাদকে সংগঠিত করতে না পারলে তা এক ধরনের রোমান্টিক আবেগপ্রবণতায় নিঃশেষ হয়। যা সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক কোনো রূপান্তর নয়, বরং এলোমেলো প্রতিক্রিয়ায় শেষ হয়। এই বিপদের সম্ভাবনা থাকে বলে লেনিন বলছেন : ‘আমাদের উচিত ছাত্র তরুণদের আদর্শবাদ ও শক্তিকে বিপ্লবী দলে সংগঠিত অভিজ্ঞতা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত করা।’ এখানে ‘শৃঙ্খলা’ মানে রাজনৈতিক সংগঠন, তাত্ত্বিক চর্চা ও নেতৃত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতি যা তরুণদের আবেগকে দিকনির্দেশনা দেয়। লেনিন সতর্ক করেন, সংবেদনশীলতা যথেষ্ট নয় সংবেদনা কেবল একটি আরম্ভ মাত্র, কোনো পরিণতি নয়। এখান থেকেই তার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ মশহুর দাবি তিনি হাজির করেছিলেন :  ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোনো বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না।’

এই ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ মর্ম হচ্ছে, সংবেদনশীল তরুণরা যদি রাজনৈতিক তত্ত্ব, শ্রেণিবিচার ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা এবং বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোর বিশ্লেষণ করতে না শেখে তবে তাদের আন্দোলন আবেগের বাষ্প হয়ে ভেসে যাবে, ‘সেন্টিমেন্টালিজম’-এর বন্যা তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি আমরা বারবার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখেছি। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন (২০১৮) বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (২০১৮), সাংগঠনিক দিশাহীনতার কারণে টেকসই রাজনৈতিক রূপ নিতে পারেনি। তারও আগে দেখেছি ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা কীভাবে শাহবাগের (২০১৩) আন্দোলনকে উগ্র জাতিবাদী ঘৃণা, হিংসা ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতিতে পর্যবসিত করেছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দিল্লির নগ্ন হস্তক্ষেপের শর্ত তৈরি করেছে। এই বিপদ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে শাপলা ম্যাসাকার। শাপলা হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সেকুলার ও ধর্মবাদী জাতিবাদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ প্রধান সংকট হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে হাজির হয়ে যায়। 

এখনকার সংকট

বর্তমান তরুণ সমাজের বড় একটি বড় অংশ সামাজিক মাধ্যমে চটজলদি প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। করপোরেট মিডিয়ার প্রযুক্তির দ্বারা তরুণদের ইচ্ছা, বাসনা ও রাজনৈতিক চেতনা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তার ওপর রয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। যেমন মার্কিন দূতাবাসের ইয়থ টেনিং, শিক্ষা প্রোগ্রাম এবং নানাভাবে ‘আত্মবিকাশ’ ঘটানোর পরিকল্পনা এবং তথাকথিত ‘জি-জেনারেশন’ পয়দার সংস্কৃতি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে পয়দা হওয়া জি-জেনারেশন তরুণদের সংবেদনশীলতাকে বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পর্যবসিত করে। রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তরুণদের আবেগকে অনায়াসে করপোরেট বাজারে বিক্রির পণ্য বানানো যায়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাস্তব রাজনৈতিক সংগ্রামের বদলে ভিজ্যুয়াল ও সিম্বলিক প্রতিবাদ করপোরেট ব্যবসাকেই শক্তিশালী করে। যার মাধ্যমে আমরা আসলে করপোরেট ব্যবস্থার তথ্য সরবরাহকারী হয়ে উঠি। ভাসমান ডিজিটাল আবেগ সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপান্তরে অধিকাংশ সময় ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বড় বিপদের জায়গা হচ্ছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংকটের গভীরতা ও জটিলতা বোঝা ও সঠিক অবস্থান গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমরা সচেতন ও শিক্ষিত না হয়ে ক্রমাগত দিশাহারা ও বিপথগামী হয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। এই সেই আবেগসর্বস্বতার বিপদ লেনিন ডিজিটাল বিপ্লবেরও বহু আগে যা শনাক্ত করেছিলেন আবেগ যদি বিশ্লেষণ ও তাত্ত্বিক শক্তি হিসেবে পরিণত রূপ নিতে না পারে এবং সাংগঠনিক রূপ নিয়ে সমাজে সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হতে ব্যর্থ হয় তখন তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আবেগ তখন সমাজ রূপান্তরের শক্তি নয়; বরং পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা কিংবা স্থিতাবস্থা রক্ষার মনোরম বিকল্প মাত্র হয়ে ওঠে। তরুণদের সংবেদনশীলতা একটি সমাজ রূপান্তরের সূচনা ঘটাতে পারে, কিন্তু তা তখনই সফল হয় যখন সংবেদনশীলতা সঠিক তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক সংগঠন এবং বাস্তবোচিত রণকৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়।

সংবিধান ও রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের সম্পর্ক না বোঝা

তাত্ত্বিক অজ্ঞতার প্রথম কোরবানি ঘটেছে, সংবিধান বা আইনের সঙ্গে রাজনীতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক না বোঝা। যার ফল, গণঅভ্যুত্থানকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনস্ত করা। দরকার ছিল শহীদ মিনার বা রাজু ভাস্কর্যের সামনে নিজেদের জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করা। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার বিজয়ী মুহূর্তে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিল করে একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করাই ছিল সঠিক কাজ। কিন্তু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তরুণরা নিজেদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ও ক্ষমতার বৃত্ত থেকে মূহূর্তে নিজ দোষে ছিটকে পড়ে এবং ক্ষমতা সেনাবাহিনী ও আমলাদের হাতে তুলে দেয়। এর দ্বারা পুরনো ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসনের শর্ত তৈরি হয়ে যায়। আত্মঘাতী ঘটনাকে আমি ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ বলে শনাক্ত করি। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের অর্থ হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’-কে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের বোতলে ঢুকিয়ে ফেলা।

রাজনীতি ও আইনের সম্পর্ক বোঝার অক্ষমতার ফলে এই সাধারণ জ্ঞানটুকু দানা বাঁধেনি যে, গণঅভ্যুত্থান যদি সংবিধান ও আইন মেনে না চলে তাহলে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ফল হিসেবে গড়ে ওঠা নতুন গাঠনিক শক্তির (Constituent Power) কাজ ফরমান দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন শুরু করা এবং গণপরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। ফ্যাসিস্ট সংবিধান পুনরায় বহাল করে গণঅভ্যুত্থানের মর্ম অনায়াসে নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমরা এখন পরিষ্কার দেখতে পারছি যে, ছাত্র-তরুণদের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের দাবিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পর্যন্ত জারি করতে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পরও নতুন বাংলাদেশ গঠন করবার ব্যর্থতা হিসেবে, ৮ আগস্ট বারবারই আলোচিত হবে।

রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য

দ্বিতীয় বিপদ তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য না জানা এবং না বোঝা। এমন সব ব্যক্তিকে সরকারের মুখ্য ভূমিকায় বসানো হয়েছে, যারা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে আরও গভীর করে তুলতে পারছে। প্রতিবিপ্লবের সহযোগী হিসেবে লুটেরা মাফিয়া শ্রেণি, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী শ্রেণি, কিছু ভিন্ন শক্তি, পরাশক্তি এবং আন্তর্জাতিক করপোরেট শক্তির যোগসাজশ ঘটেছে দ্রুত। ফলে ছাত্র-তরুণরা ক্ষমতার বলয় বা বৃত্ত থেকে বহুদূরে ছিটকে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারে ক্ষমতার যে নতুন পুঞ্জীভবন ঘটেছে তাতে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার আদৌ খুনি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করতে পারবে কি না, সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এমনকি বাহ্যিক চটকদারি ছাড়া কার্যকর কোনো সংস্কার উপদেষ্টা সরকারের করা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

আমরা প্রতিবিপ্লবী শক্তির ক্ষমতা উপদেষ্টা সরকারের কাজ দেখেও আঁচ করতে পারি। সমাজের এলিট ও অভিজাত শ্রেণি থেকে বাছাই করা ব্যক্তিদের দিয়ে বিবিধ সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পর কীভাবে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়তে হবে, সেই প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করবার কোনো প্রয়াস বা চেষ্টা নেই। বোঝা যাচ্ছে, সংস্কার বড়জোর বাহ্যিক কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন ছাড়া ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না।

জাতিবাদের নিগড়ে শৃঙ্খলিত পড়ে থাকা

সবচেয়ে বড় বিপদ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। সমাজে শ্রেণি ও শক্তির নতুন বিন্যাস ঘটেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, গণঅভ্যুত্থান পুরনো জাতিবাদী চিন্তা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেনি। আমরা বাঙালি সেকুলার জাতিবাদকে পরাস্ত করেছি বটে কিন্তু তার দ্বারা ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানকে নিশ্চিত করেছি। আমরা জাতিবাদের কালপর্ব অতিক্রম করতে পারিনি। ভুলে গিয়েছি ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বয়ান সবসময়ই কোনো না কোনো অপরিবর্তনীয়, চিরায়ত বা শাশ্বত আত্মপরিচয় সর্বস্বতার দাবির ওপর দাঁড়ায়। হতে পারে তা পরিচয়সর্বস্ব সেকুলার বাঙালি জাতিবাদ, কিংবা তার বিপরীত বাইনারি বা অপর পৃষ্ঠা: পরিচয়সর্বস্ব ধর্মীয় জাতিবাদ।

বাঙালি জাতিবাদের পরাজয় মানে, জাতিবাদের পরাজয় নয়। বরং ঘটেছে, পালটা ধর্মীয় জাতিবাদের উত্থান। উচিত ছিল জাতিবাদের কালপর্ব পেছনে ফেলে কিংবা তার পরিসমাপ্তি টেনে নিজেদের নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ইতিহাসে হাজির করা এবং বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের ন্যায়সংগত হিস্যা আদায় করা। সেই হিস্যা শুধু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দাবিদার হিসেবে নয় একই সঙ্গে ইসলামের বৈপ্লবিক ও সর্বজনীন মর্ম ও মহিমা আত্মস্থ করবার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার হিম্মত অর্জন করা। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ঘটছে জাতিবাদী উগ্র ধর্মপন্থা।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্র শুধু একটি ভৌগোলিক মুক্তি বা বিমূর্ত স্বাধীনতা ছিল না, বরং সেটা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে ধর্মের সর্বজনীন নীতিনৈতিকতা ও আদর্শ ধারণ করে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রয়াস। বাঙালি জাতিবাদ সেই সময় প্রগতির মুখপত্র হিসেবে হাজির হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরিণতি ঘটে ভাষা ও সংস্কৃতিকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-র নামে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতিচর্চা। এই চরিত্র নিয়েই বাঙালি জাতিবাদ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপ লাভ করে। 

একাত্তরের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ধারণা ছিল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু এই সেকুলার চেতনা কখনোই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক গঠনের পথে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেনি। বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আটকে রাখা হয়েছে স্মারক দিবস, ভাষণ ও সংগীতচর্চায়। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কোনো পরিস্ফুটন ঘটেনি। আমরা কলোনিয়াল আইন ও সংস্কৃতি অনুসরণ করেছি এমনকি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও আদালতে বাংলাভাষা প্রবর্তন করতে পারিনি। এর ফল হলো, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কেবল সাংস্কৃতিক নস্টালজিয়ায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনায় ভাষা ও সংস্কৃতির রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণরা তাদের কর্মসূচির নামকরণ করেছে বাংলাতে নয়, অধিকাংশ সময় ইংরেজিতে। এতে বোঝা যায়, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ছাত্র-তরুণদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা কাজ করে। এই হীনমন্যতা অর্থাৎ অকারণ ইংরেজিপ্রীতি তরুণদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সঙ্গে ব্যবধান তৈরি করবে। এক ধরনের কলোনিয়াল মানসিকতা ছাত্র-তরুণদের মধ্যে কাজ করছে। যার ফলে সহজেই সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সহজ। নিজের ভাষায় মৌলিক চিন্তা করতে না পারা এবং নিজের ভাষায় রণধ্বনি নির্মাণের তৌফিক অর্জনের ব্যর্থতার ফল নেতিবাচক হতে বাধ্য।

বাঙালি জাতিবাদ ইসলামকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায় এবং তার বয়ানে বাংলাদেশের জনগণকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে উচ্চবর্ণের বাঙালির হিন্দুর সংস্কৃতিকেই বাংলাদেশের সংস্কৃতি হিসেবে দাবি করে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে ওঠে ইসলামের প্রতিপক্ষ। তবুও সত্য এই যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তাদের ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে বিভক্ত বা আলাদা করবার সেকুলার জাতিবাদী রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছে। এখন তাহলে কর্তব্য হচ্ছে, এই ঐতিহাসিক বিভাজন ও বিভক্তি কাটিয়ে ওঠা। আমাদের ভাষা ও

সংস্কৃতির মতো ইসলামও আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতি সত্তা নির্মাণের উপাদান এই বাস্তব সত্য উপলব্ধি করা। তাহলে বিভাজন ও বিভক্তি কাটিয়ে ওঠাই আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য।

কিন্তু এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্মীয় জাতিবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য হতে পারে না। আমাদের কাজ ধর্ম বনাম সেক্যুলারিজমের বাইনারি অতিক্রম করা, জাতিবাদের কালপর্ব অতিক্রম করে যাওয়া। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সবই নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের নিজেদের নতুনভাবে গঠন করবার উপাদান। আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি যেমন  নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠনের শক্তিশালী ভিত্তি তেমনি ধর্ম ও ঐতিহ্যও আমাদের পরিগঠনের জমিন আমাদের নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ নির্ণয় এবং শত্রু-মিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্র। সেটা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম হতে হবে তা নয়, বরং রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তারও ভূমিকা থাকবে। রাজনৈতিকতার শক্তিকে দৃঢ় করবার জন্য যে কোনো ধর্ম বা চিন্তার সর্বজনীন ও সবার অনুসরণীয় আদর্শকে সামষ্টিক আদর্শ হিসেবে হাজির করার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দায় আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

বাঙালি জাতিবাদের পরাজয়ের ফলে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তাকে কীভাবে নতুন করে নির্মাণ করতে পারি সেই সিদ্ধান্তের ওপর আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই শূন্যতার সুযোগে যে চেতনা মাথাচাড়া দিয়েছে, তা হলো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, সেকুলার জাতিবাদের বিপরীতে নতুন এক ফ্যাসিস্ট নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। এটা বিপদের জায়গা। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক শূন্যতার ভেতর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র গঠনের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে। ইসলামে জাতিবাদের কোনো স্থান না থাকলেও ধর্মীয় জাতিবাদ মুসলমানদের একই জাতি হিসেবে কল্পনা করে, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং জাতিরাষ্ট্রের আদলে একটি ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি খেলাফত কায়েম করতে চায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ জুড়ে একাধিক মাজারে হামলা হয়েছে। মাজারগুলো লোকায়ত সংস্কৃতিচর্চার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় বা লৌকিক প্রতিষ্ঠান। মূলত এর দ্বারা ধর্মীয় জাতিবাদী গোষ্ঠী স্থানীয়ভাবে নিজের ক্ষমতা কায়েম করতে চাচ্ছে। ইসলামে গান হারাম কিংবা উঁচু কবর রাখা নিষিদ্ধ বলে কবরগুলো গুঁড়িয়ে ভূমির সমান্তরাল করে ফেলা হয়েছে। গাঁজা ও নেশাদ্রব্য সেবনের যে অভিযোগ তোলা হয়, সেটা বরং বড় বড় কনসার্ট কিংবা এলিট ও অভিজাতদের এলাকায় বেশি প্রচলিত। কিন্তু গাঁজা বা নেশার অভিযোগ হামলার খুব সহজ একটা অজুহাত মাত্র। বাঙালি জাতিবাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর মাজার ভাঙার পেছনে রয়েছে স্থানীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব,  ধর্মবাদীদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে, বাঙালি জাতিবাদের পরাজয়ের জমিনে ধর্মীয় জাতিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।

ধর্মীয় জাতিবাদী ক্ষমতার আরেকটি উপসর্গ হচ্ছে নারীদের পোশাক, চলাফেরা, এমনকি কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় একটি অনানুষ্ঠানিক ধর্মীয় পুলিশ বাহিনী তৈরি করা। ২০২৩-২৪ সালে ঢাকায় একাধিক নারীকে পোশাকের কারণে হেনস্তা এবং সামাজিকভাবে ‘শাস্তি’ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির ‘শাস্তি প্রথা’ রূপে মৃত্যুদণ্ড দাবি বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। ব্লগার হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হয়েছে। ২০১৫-২০২২ সালের মধ্যে অন্তত ৫ জন ব্লগার হত্যার পেছনে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ‘ন্যায়বিচার’-এর ধারণা কাজ করেছে। সম্প্রতি ‘হাতের অধিকার’ দাবি করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কার্যকর করার দাবি পরিস্থিতিকে আরও সহিংস করে তুলেছে। 

সেকুলার জাতিবাদের রাজনৈতিক পরাজয়ের পর তরুণদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের ‘বাঙালি মুসলমান’ পরিচয়কে বিকল্প সমাধান হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তারা বাঙালি জাতিবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে ইতিহাসের দুই ধারার দ্বন্দ্ব না ভেবে, একটা থেকে আরেকটি পরিচয়ে ‘স্মার্ট’ রূপান্তর গজানোর মধ্যে সমাধান দেখছে। এটা ভুল পথ। এই ভুল পথ ধর্মীয় জাতিবাদকেই শক্তিশালী করবে এবং বাংলাদেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলবে। এই প্রবণতা তরুণদের দ্বৈত সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। ইতিহাসকে পরিবর্তনশীল বা গতিশীল নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিসেবে না বুঝে তারা এখন ‘বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামে অস্পষ্ট ধারণার মধ্যে নিজের পরিচয় খুঁজছে।

‘বাঙালি’ কিংবা ‘মুসলমান’ উভয়ের মর্ম ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত। তাদের পার্থক্য বা বাইনারি ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের অতিক্রম করতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এই বাইনারি ভেঙে নিজেদের নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে হাজির করার লড়াই। আমাদের অবশ্যই এই সেকুলার ও ধর্মীয় জাতিবাদী বাইনারি অতিক্রম করে যেতে হবে। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠনের প্রকল্প ত্যাগ করে নতুন করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্মাণের ধোঁয়াশার মধ্যে ঢুকে পড়লে আমরা আবার বিভাজন ও বিভেদকেই রাজনীতির মঞ্চে নতুন পালা হিসেবে হাজির করব। এই ধোঁয়াশায় পতিত হলে প্রমাণিত হবে আজকের তরুণ সমাজ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক তত্ত্ব, সাংগঠনিক শক্তি কিংবা নৈতিক অবস্থান কোনো কিছুই ধারণ করছে না।

তাহলে আমাদের করণীয় কী?

জাতীয়তাবাদ, বিশেষ করে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গঠিত জাতিসত্তা, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কল্পনার ফসল। একুশ শতকে এসে সেই কল্পনাকে হোক তা ‘বাঙালি’ বা হোক তা ‘মুসলমান’ রাজনৈতিকভাবে নতুনভাবে নির্ণয় করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নির্মাণ যার প্রথম কাজ হচ্ছে গাঠনিক শক্তি হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিকতাকে পরিগঠন। সেই লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্তব্যগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে সেরে ফেলা। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গাঠনিক শক্তি রক্ত দিয়ে জনগণ তৈরি করে তরুণদের হাতে তুলে দিয়েছিল, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও প্রজ্ঞার অভাবে তরুণরা তার তাৎপর্য বোঝেনি। হারিয়ে ফেলেছে। তাহলে আবেগ ও রোমান্টিক ধ্যান-ধারণা পরিহার করে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রতি তরুণদের বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে। মনোযোগ ও নিষ্ঠা নিয়োগ করতে হবে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াসহ রাজনীতির নির্ধারক ক্ষেত্রগুলোর ওপর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সব ধরনের ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াকু জনগণের যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তাকে ধারণ করবার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইটাই এখন মুখ্য। ভাষা কিংবা সংস্কৃতিকে আত্মপরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার বানানো যেমন ভুল, তেমনি ধর্মকে জাতিবাদী পরিচয় বানানোও একই জাতিবাদী ভুল ও পশ্চাৎপদতা। অথচ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের শক্তিশালী গাঠনিক উপাদান।

তাহলে এখন দরকার উভয় প্রকার জাতিবাদকে ঐতিহাসিকভাবে বিচার করবার ক্ষমতা অর্জন যেন আমরা জাতিবাদের কালপর্ব দ্রুত অতিক্রম করে যেতে পারি। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা রূপান্তরের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের দ্রুত দাঁড়াতে হবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আমাদের লক্ষ্য হবে একদিকে গণসার্বভৌমত্ব (People’s Sovereignty) কায়েমের নীতির ভিত্তিতে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠন এবং একই সঙ্গে সম্পদ সৃষ্টি ও সম্পদ বণ্টনের ন্যায্য ব্যবস্থা নির্মাণ, প্রাণ-পরিবেশ-প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ন্যায়বিচার কায়েমের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মানব সম্পদের বিকাশের জন্য শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি, ইত্যাদি। বাংলাদেশে দ্রুত বিকাশ নিশ্চিত করা ছাড়া আমরা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকতে পারব না।

সংবেদনশীলতা যথেষ্ট নয়, গণআন্দোলন গণসংগ্রামের পাশাপাশি দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, যেন সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা আবার ভুল না করি।

লেখক : দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তক

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত