এক উৎকৃষ্ট সময় এখন। এ এক অপকৃষ্ট সময়। স্থান-কাল-পাত্র আর ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্র গণমাধ্যমের যখন পথচলা, তখন সময় ভ্রুক্ষেপ না করে চলা দুষ্কর। সংবাদপত্র-গণমাধ্যমের অস্তিত্বের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক ওতপ্রোত। আর সময়ের আজকের দোলাচলে যখন নিজের দিকে তাকিয়ে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা ঘটা করে জানান দিতে হয়, তখন প্রয়োজন একটা উপলক্ষ। সপ্তম বছরের পথচলায় ষষ্ঠবর্ষ পূর্তি আমাদের জন্য তেমনই একটা উপলক্ষ। সময় ভালো কিংবা মন্দ, পূর্বাপর বিচার-বিশ্লেষণে যা কিছু স্থির হোক না কেন, এখনকার এ সময়টা আমাদের দেশের জন্য এক নতুন পালাবদল অর্থাৎ রূপান্তরের সময়। বর্ষপূর্তির এই বিশেষ আয়োজনও পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার এই-যে সময়, একেই আমাদের নিজস্ব ভাবনায় এবং ব্যাপকতর বিচারে বলি, সময় এখন দেশ রূপান্তর-এর। গতকাল আর আজ এবং আগামীর বার্তা বহন করে চলছে সংবাদপত্র, চলছি আমরা। ঋষি লেখকের ধ্রুপদি গ্রন্থ শুরুর বাক্যযুগল তাই সময়ের গুণাগুণ ভেদে তুলি এনেছি আমাদের আত্মকথন প্রসঙ্গে, সামাজিক-রাষ্ট্রিক কালবদল প্রেক্ষিতে।
নিজের কথা এখানে সব বিচারে আমাদের এই পত্রিকারই কথা। নামে-প্রকাশে-প্রচারে অনন্য আমাদের প্রিয় দেশ রূপান্তর। আজ যখন সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র এক নতুন উত্তরণলগ্নে, তখন আমাদের এই পত্রিকাকে নবোদ্যমে পথ চলার প্রত্যয় যেমন ব্যক্ত করতে হচ্ছে, তেমনি সংবাদপত্র-সাংবাদিকতার চির অনুসৃত নীতিবোধ, যা অলঙ্ঘ্য বলে গণ্য তাতে দৃঢ়-নিষ্ঠ থাকার অঙ্গীকার আমরা পুনর্বার ঘোষণা করছি। শুরু থেকে আমরা এই নীতিবোধের চর্চায়-অনুশীলনে নিষ্ঠাবান ছিলাম বলে কখনো বস্তুনিষ্ঠতার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। যা কিছু সংবাদ, তা প্রকাশে আমাদের পত্রিকা কুণ্ঠাহীন তার যাত্রা থেকে। আবার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে কিংবা সমাজ-রাষ্ট্রের আলোচিত বিষয়ে মতামতের ক্ষেত্রে কোনো কায়েমি স্বার্থ নয়, বৃহত্তর কল্যাণ-চেতনা এ পত্রিকার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে চলেছে। তাই সব অর্থে দেশ রূপান্তর একদিকে দেশের কণ্ঠস্বর, অন্যদিকে কল্যাণধর্মী রূপান্তরের ধারক ও বাহন।
এখন এই সামগ্রিক প্রেক্ষিতে আমরা সমগ্র দেশ-সমাজ পরিপার্শ্বের একটা সংক্ষেপ পর্যালোচনায় যেতে পারি। ছয় বছরের যাত্রা শেষে সপ্তম বর্ষের প্রকাশনায়ও আমাদের পত্রিকার এখন এক পরিণত অবস্থান। বহু দৈনিক পত্রিকা, কয়েক হালি টিভি গণমাধ্যম আর এন্তার ছড়াছড়িতে বিদ্যমান অনলাইন ডিজিটাল পত্রিকা ছাড়া বিশৃঙ্খল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য-কুতথ্য আকীর্ণ সংবাদমাধ্যম জগতে দেশ রূপান্তর এখন শুধু পাঠকের কাছে নয়, রাজনীতি-অর্থনীতির নেতৃসত্তাসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন নির্বাহী স্তরেও সত্যতা, আস্থা ও নির্ভরতার এক বিশ্বাসযোগ্য বাহন। আমাদের পত্রিকার এ এক অনবদ্য অর্জন।
কিন্তু আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, বিশ্বলোকে আপন গৌরবে দৃপ্ত স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অর্ধশত বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও রাষ্ট্রের কাঠামোগত ক্ষেত্রে মেয়াদি ধারাবাহিকতার সমন্বিত ব্যবস্থা-সংবলিত ঐতিহ্য এখনো গড়ে ওঠেনি। দুর্বল নড়বড়ে ভঙ্গুর অস্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামো সমাজের মননগত বিকাশকে শুধু নয়, কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-সাহিত্য-ক্রীড়া-সংস্কৃতি মিলিয়ে লোকসমাজের সমগ্র কার্যক্রমের উৎপাদনশীলতায় এবং সমাজ নিহিত কোনো ব্যক্তি এককের বা যূথবদ্ধ সমষ্টির কোনো চর্চায়-গবেষণায়-প্রদর্শনে-পরিবেশনে-কর্মসম্পাদনে বিশেষ শৈলীতে সাফল্যের কিংবা নৈপুণ্য অর্জনের নিশ্চিতি দিতে পারে না। সব বিষয়ে প্রতিযোগিতা-তাড়িত এই বিশে^ কিংবা অঞ্চলে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমরা এখনো কোনো বিশেষ অর্জন কিংবা সাফল্যের মুকুটবিহীন পড়ে রয়েছি অনুল্লেখ। এরই ফলে, আমাদের সমাজ-চেতনাগতভাবে পারস্পরিক কিংবা বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রে ভাব ও মতামত আদান-প্রদানে, এমনকি একক অবস্থানে নিজস্ব মত ব্যক্ত করায় এক ধরনের সংকীর্ণতা এবং একগুঁয়েমিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। রাষ্ট্রের পঞ্চম যুগে আমরা পথ চলছি। এখনো আমরা আমাদের মাতৃভাষায় বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির মৌলিক বিষয়গুলো আত্মস্থ করার মতো নির্ভরযোগ্য এবং প্রতিযোগিতাসক্ষম বইপত্রের সমাহার সম্ভবপর করে তুলতে পারিনি। আর সমাজ জুড়ে এমন বইপত্র সহজলভ্য করার কাজ তো দূরের বিষয়। এর বিষময় প্রতিক্রিয়া দাঁড়িয়েছে এই যে, আমাদের জনসমাজ বিশ্বের আগুয়ান চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন, কূপম-ূকতায় আচ্ছন্ন এবং নানা ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্র প্রতিযোগিতায় ম্রিয়মাণ। এই-যে এখন সংস্কার সংস্কার আর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ঢোল বেজে চলেছে, এ থেকেই বোঝা যায়, কোথায় সমসাময়িক বিশ্বচেতনা আর কত নিচে পড়ে আছি আমরা। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় ক্ষমতার হাতবদলের পথ রুদ্ধ হওয়ায় যে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং স্বাধীন এই রাষ্ট্রের জন্ম, কই কোথায় সেই গণতন্ত্র, কোথায় সেই নির্বাচন, কোথায় ক্ষমতার হাতবদলের ধারাবাহিক মেয়াদি ব্যবস্থা!
এমন ঐতিহ্যিক ব্যবস্থায় যদি দেশ চলতে পারত, তবে সমাজের মননগত বিকাশের এক উন্নততর স্তরে পৌঁছে নাগরিক চেতনা হতো সৃজনশীল, আলোচনা-সমালোচনা হতো প্রাণবন্ত এবং রাষ্ট্র এক উন্নত-উদার গণতন্ত্রের পীঠস্থানে রূপান্তর লাভ করত। কিন্তু তা এখন শুধুই কল্পলোকের বিষয়। বাস্তবে আস্ফালন, হুংকার, রোষ, ক্ষোভ অথবা ব্যক্তি-বন্দনা, দলতন্ত্র, দলদাসগিরি, গোষ্ঠীতন্ত্র, গোষ্ঠীপ্রীতির চূড়ান্ত রূপ যে কর্তৃত্ববাদ, সে পথেই আমরা অলক্ষ্যে হাঁটছি অথবা বলি, ছুটে চলেছি। অতীতে নির্বাচন আর ভোটকে তামাশায় পরিণত করে দেশের ঊর্ধ্বে দল এবং তারও ঊর্ধ্বে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদের বিস্তার ঘটানো হয়েছিল। এখন কাঠামোবিহীন মেয়াদি ধারাবাহিকতার ব্যবস্থা রহিত রাষ্ট্রে একক এক ব্যক্তিকে সব সমস্যার সমাধান চিত্রিত করে নয়া কর্তৃত্ববাদ আরোপিত হচ্ছে সমাজ-দেহে। আর এরই সুযোগে চলছে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার বিস্তার।
কথা বিস্তৃত না করে আমরা যদি ফের আত্মকথনে মগ্ন হই, তবে বলতে হবে, রাষ্ট্রের ক্রিয়াকর্মের ছাপ যেহেতু বহন করতে হয় নাগরিকদের, সেহেতু নাগরিক কর্মযজ্ঞের প্রতি ক্ষেত্রেই সেই ছাপ স্পষ্ট চিত্রিত হয়। সংবাদপত্রে গণমাধ্যমে সবচেয়ে আগে প্রতিবিম্বিত হয় সেই ছাপ। গত কয়েকটি বছর দেশের ওপর বিভিন্নভাবে যে চাপ এবং ছাপ রেখে গেছে আমাদের দেশ রূপান্তর-এর যাত্রা এবং বেড়ে ওঠা এরই মধ্যে। তাই অন্যসব পত্রিকার ভিড়ে বিগত বছরগুলোর প্রকাশ দেশ রূপান্তর-এর পাতায় বিশেষ এবং আলাদা রূপে ফুটে উঠেছে। এজন্য সময়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা সব পত্রিকার মধ্যে থেকেও আমাদের দাবি হবে একটু বাড়তি। আমরা বলব, গত সাত বছরের ঘটাপূর্ণ সময়ে আমরা দেশ রূপান্তরকে খবরের যথার্থ দর্পণে সাজিয়েছি, মতামত প্রকাশের মুক্ত মঞ্চে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ২৪-এর রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলনে পতিত সরকার ও দল যখন ফ্যাসিবাদ হিসেবে চিত্রিত এবং চিহ্নিত, তখন আমাদের বলা দরকার, সেই ফ্যাসিবাদের উষ্মা ও রোষদৃষ্টি উপেক্ষা করে বন্ধুর পথেই চলতে হয়েছে আমাদের।
এজন্য এখন ফ্যাসিবাদী শাসন অবসানে আমাদের রাষ্ট্র যখন নতুন চলার পথ সন্ধানরত, তখন আমরা চাইব, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শুধু কথায় নয়, পরিপূর্ণ আইনি কাঠামোয় হবে নিরঙ্কুশ। এই স্বাধীনতা যথার্থ নিরঙ্কুশ হতে হলে সংবাদপত্র-গণমাধ্যমের আয়ের পথ হতে হবে রাষ্ট্র-কর্তৃত্বের মর্জিমুক্ত এবং বিশেষ প্রয়োজনে দল-সরকার কর্তৃত্ব ব্যতিরেক মুক্ত সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সহযোগিতা হতে হবে অবারিত। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা দরকার, সংবাদপত্র, গণমাধ্যম মিলিয়ে ইংরেজি শব্দে ‘প্রেস’ বলতে যা বোঝানো হয়, সেই ‘প্রেস’-এর কোনো ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র তার কোষাগারের অর্থে কোনো মালিকানা নিয়ে অবস্থান করবে না। বেতার-টেলিভিশনের যে মালিকানা রাষ্ট্রের রয়েছে, তা থাক। রাষ্ট্রের ওই মালিকানা একান্তই রাষ্ট্রীয় বেতার-টিভি হিসেবে থাকবে, কিন্তু সংবাদপত্র-গণমাধ্যমের বৃহত্তর জগতে অপরাপর সংস্থার প্রতিযোগী হিসেবে নয়। সংবাদ উৎস হিসেবে দেশে-সমাজে সরকার, পার্লামেন্ট, সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা যেসব সংবাদ সৃষ্টি করছে এবং করবে, তার জন্য বেতার-টিভিতে সরকারের তথ্য অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার ও দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগ এখন যেভাবে কাজ করছে, সেই পরিসর আরও বাড়িয়ে নিরন্তর তারা সংবাদের জোগান দিয়ে যাবে। প্রচারমূলক এবং বিশেষ কোনো বর্ণনামূলক সংবাদ ক্ষেত্রে ওইসব দপ্তর-সংস্থা-প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব জনসংযোগ শাখার মাধ্যমেই তা রচনা এবং প্রচার করবে। সংবাদপত্র-গণমাধ্যম প্রয়োজন মনে করলে ওইসব সংবাদ ছাপবে, প্রচার করবে; প্রয়োজন মনে না করলে তা এড়িয়ে যাবে। এতে প্রতিযোগিতা হবে বহুমুখী। সংবাদ সত্যতার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং একই সঙ্গে সরকারি তথ্যের ক্ষেত্রে এতদিনকার সত্যতার ঘাটতি, মিথ্যা চটকদার প্রচারণা বন্ধ হবে।
অন্যদিকে সব সংবাদপত্র-গণমাধ্যম তখন যা-কিছু সংবাদ বলে গণ্য, তার প্রকাশ-প্রচার-রচনা ক্ষেত্রে নিরেট সত্য-সন্ধানেই ব্রতী থাকবে এবং প্রতিযোগিতা তাগিদে বস্তুনিষ্ঠতানির্ভর শৈলী ও ভঙ্গি কুশলতায় পাঠক আনুকূল্য লাভের বিষয়ে হবে যতœবান। সংবাদপত্র-গণমাধ্যম যখন সংবাদ সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতার ভিত্তিতে চলবে, তখন সমাজ জুড়ে মিথ্যা-অসত্য-গুজব চালাচালির অনাচারও ক্রমে অপসৃত হতে শুরু করবে। তখন মতামতের ভিত্তি হবে সত্য তথ্যভিত্তিক যুক্তি, সেই সঙ্গে ন্যায়বোধ ও শ্রেয়বোধের বিস্তৃতিতে সমাজে অস্থিরতার ক্রম অবসান দেখতে পাব আমরা।
এখানে এই স্বল্প পরিসর আলোচনায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ‘প্রেস ফ্রিডম’ বিষয়ে উপসংহার টানা চলে না। এর আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়ে গেছে, যা উল্লেখ করা হয়নি। আমাদের কৃষি খাত সংবাদপত্র-গণমাধ্যমের জন্য বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজস্ব অর্থাৎ অর্থ জোগানের উৎস নয়। কৃষি খাতের সেই বাণিজ্যিকীকরণ এখনো দূরবর্তী ভাবনা। সরকারি-বেসরকারি শিল্প-কারখানা, সেবা-পরিষেবা, সামগ্রিক উৎপাদন-ব্যবসা-বাণিজ্য, জল-স্থল-আকাশ পরিবহন, নির্মাণ-ঠিকাদারি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-ক্রীড়া-সংস্কৃতি-বিনোদন-অবকাশ, শিশু-কিশোর-যুবা-নারী-বৃদ্ধকেন্দ্রিক বিষয়াবলি, চাকরি-নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম, প্রধানত, এসব হচ্ছে বিজ্ঞাপন উৎস। এ ছাড়া রয়েছে জনসমাজের ব্যক্তিগত বিষয়াবলি যেখানে প্রয়োজন হয় অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের। যেমন : পাত্র-পাত্রী চাই, পড়াতে চাই, পড়তে চাই, ভাষা শিক্ষা, কম্পিউটারবিষয়ক শিক্ষা, বাসা বদলাতে-বাসাভাড়া, সম্পদ কেনাবেচা ইত্যাদি প্রয়োজনেও দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন। দেখা যাবে, পুরো এই বিজ্ঞাপন ক্ষেত্রে সরকার অর্থাৎ রাষ্ট্রের রয়েছে সিংহভাগ মালিকানা। কেননা, সরকার দেশের প্রধান নির্মাণকারী, নিয়োগকর্তা, চাকরিদাতা, পরিবহন সম্পাদনকারী, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি-হাসপাতাল পরিচালনাকারী এবং সাংস্কৃতিক বিনোদনেও পরিকল্পক-আয়োজক। আবার সব ক্ষেত্রে সরকারই হচ্ছে বড় বিক্রেতা ও ক্রেতা। সেই অর্থে প্রধান আমদানি ও রপ্তানিকারক। এতটা ভেঙে বিস্তারিত বলতে হলো, কারণ, আমরা এই ‘প্রেস ফ্রিডম’ আলোচনায় এখন সহজে বুঝব, শুধু একটা বা কয়েকটা বাক্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চিতি দিলেই তা স্বাধীন হবে না, যতক্ষণ আয়-ব্যয়ের জোগান ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সরকার বা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও খবরদারি মুক্ত না হচ্ছে।
আজ যখন রাষ্ট্রের নয়া বন্দোবস্ত, ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রদ এবং বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে নানা সংস্কার আলোচনা চলছে, তখন বলা দরকার, সংবাদপত্র-গণমাধ্যমের যথার্থ নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার শুধু সরকারি নিশ্চয়তা নয়, রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানব্যবস্থা-সংবলিত কাঠামো থাকতে হবে, যাতে ওই স্বাধীনতার বাতাবরণ সম্পূর্ণরূপে সরকারের কর্তৃত্ব মুক্ত হয়। এমন স্বাধীন সংবাদপত্র-গণমাধ্যমই শুধু সমাজের গণতান্ত্রিক ও মননগত বিকাশ ত্বরান্বিত করে রাষ্ট্রের সব অঙ্গনে গণতন্ত্র ও সহনশীলতা চেতনার প্রসার ঘটাতে সক্ষম। অর্ধশতাব্দীকাল আগে স্বাধীন এই দেশে যখন নতুন এক রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানলব্ধ রূপান্তরমুখী সময় অতিক্রম করছি আমরা, তখন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার ভাষায় যখন ‘জাগিয়া উঠিল প্রাণ’ তখন বলি, দেশ হোক কর্তৃত্ববাদের কবজামুক্ত উদার গণতন্ত্রের গরিমায় সদাজাগ্রত এবং মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চায় যথার্থ স্বাধীন সংবাদপত্র-গণমাধ্যম হোক দেশ-দর্পণ।
লেখক : সম্পাদক, দেশ রূপান্তর