বাংলাদেশ আজও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনে উত্তরণের। স্বপ্ন দেখে গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার। স্বপ্ন দেখে শিশু ও নারীর জন্য নিরাপদ জীবনের। বৈষম্য অবসানের স্বপ্নও দেখে বাংলাদেশ। তবে বারবার বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। কখনো গণআন্দোলন, কখনো গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের স্বপ্ন অসংখ্য বার হোঁচট খেয়েছে। মিছিলের সেসব মুখ হারিয়ে গেছে। অনেক মুখ জীবন থেকেই বিদায় নিয়েছে। স্বাধীনতার আগে এক ধরনের স্বপ্ন ছিল। সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর স্বপ্নের পরিধি বিস্তার লাভ করে। কিন্তু ৫৪ বছরেও বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, দুর্ভিক্ষে যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে অসংখ্যবার তছনছ করেছে। দুজন রাষ্ট্রপ্রধানসহ অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, রক্তপাত হানাহানি স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় মানুষকে হতাশ করেছে। গত ৫৪ বছরে বিভিন্ন সময় দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক অর্জনও অনেক। বেড়েছে জীবনযাপনের মান। প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তারপরও অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়কাল পার করার পরেও রাষ্ট্রীয় কাঠামো স্থায়ী হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর কখনো একদলীয় শাসন, কখনো সামরিক শাসন, মাঝে কয়েক বছর গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার মধ্যে সেনা সমর্থিত শাসন এভাবেই চলছে। শেষের ১৫ বছর কর্র্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে ছিল বাংলাদেশ। এভাবেই বাংলাদেশ বারবার পথ হারিয়েছে।
গত জুলাই ছাত্র-জনতার দেশ কাঁপানো অভ্যুত্থান ৫৪ বছরের রাজনীতি, সরকার ও তাদের শাসনকালকে ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর স্বাভাবিকভাবেই জন-আকাক্সক্ষা ছিল গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের, কিন্তু বাস্তব অবস্থা ছিল ভিন্ন। দেশে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল। বিশিষ্ট সমাজকর্মী, চিন্তাবিদ এবং রাজনীতিবিদ কামরুদ্দিন আহমেদ তার ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’ বইয়ে ওই সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে ‘শেখ মুজিব যখন প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলেন তখন বাংলাদেশে চলছিল পূর্ণ অরাজকতা। নানা চরিত্রের নানা আদর্শের লক্ষাধিক ছাত্র-যুবক খোলাখুলিভাবে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। তাদের ওপর কোনো একক আধিপত্য ছিল না। যদিও কাগজপত্রে জেনারেল ওসমানীকে সেনানায়ক করা হয়েছিল। তবু সবার মধ্যে সব স্তরে সেনাবাহিনীর মধ্যে যে ধরনের নিয়মানুবর্তিতা থাকা প্রয়োজন, জেনারেল ওসমানী তা গড়ে তুলতে পারেননি। এমনকি মুজিব বাহিনীও ওসমানী সাহেবের হুকুম ছাড়া চলত। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন পার্টির নেতৃত্বে ভিন্ন ভিন্ন কমান্ড করে উঠেছিল। এমনকি একই পার্টিতেও নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল চলছিল, এ ধরনের প্রমাণও রয়েছে প্রচুর। মুজিব বাহিনী গঠন নিয়েও শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছিল। মুজিব যেহেতু মুক্তি সংগ্রাম প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করেননি তাই মুক্তিবাহিনী ছিল বিক্ষিপ্ত এবং বিশৃঙ্খল। ফলে সমগ্র বাহিনীর ওপর মুজিবের কর্র্তৃত্ব ছিল না। যার ফলে এদের একটা সংগঠনের মধ্যে আনা বা একই পতাকা তলে জমায়েত করা বিরাট একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’
সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার সুযোগটি হাতছাড়া হয় ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। নির্বাচনে বিরোধী দল চারটি আসন পেয়েছিল। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চারটি আসনে জয়ী হন। নির্বাচনে দলের সিনিয়র নেতা ও শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ খন্দকার মোশতাক আহমেদের আসনসহ কয়েকটি আসনের ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এমনকি ডাকসু নির্বাচনেও ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলের পরাজয় নিশ্চিত জেনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সুতিকাগার হিসেবে বলা হয় সেখানে এই কলঙ্কজনক ঘটনা সংঘটিত হয়। আরেকটি ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের স্তম্ভিত করে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ৭ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা ‘সেভেন মার্ডার’ নামে পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমপি এবং দলের নেতাদের একটি বড় অংশ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মন্ত্রীদের ঘরে সবসময় পারমিট শিকারিদের ভিড় থাকত। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অন্য সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল গঠন করেন। এর আগে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ছিল শেখ মুজিবের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা। বাকশাল শাসনের ছয় মাস পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন।
শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর দেশে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে সেনাবাহিনীর অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা নিহত হন। জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয়। খন্দকার মোশতাক ৮৩ দিন এবং বিচারপতি সায়েম ১৬৬ দিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হন। ক্ষমতায় থেকে জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বিভিন্ন গঠন প্রক্রিয়ার পর তার গঠিত দলটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে এই দলটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া নিজেও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে তিনিও কতিপয় সেনা কর্মকর্তার হাতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন। জিয়া ৪ বছর ২৯ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। কিন্তু তদানীন্তন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ একপর্যায়ে সাত্তারকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। প্রায় ৮ বছরের শাসন আমলে এরশাদ দুর্নীতি ও নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। শুরু হয় তার বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের আন্দোলন। এরশাদ বিরোধী দলকে দমন করার পথ বেছে নেন। তীব্র আন্দোলনের একপর্যায়ে অসংখ্য ছাত্র-যুবক রাজনৈতিক কর্মীর রক্তের বিনিময়ে ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে। এরপর এরশাদ বিচারের মুখোমুখি হন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে এবং দেশ রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যায়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মাগুরা উপনির্বাচন রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায়। এই উপনির্বাচনকে ইস্যু করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি পালন করতে থাকে। একপর্যায়ে দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বর্জন করে। পরবর্তীকালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক বিল পাস হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে পুনরায় সরকার গঠন করে। বিএনপি সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে বিচারপতির বয়স বাড়ানোর উদ্যোগকে আওয়ামী লীগ সন্দেহের চোখে দেখে। আওয়ামী লীগ আবারও হরতালসহ লাগাতার কর্মসূচিতে চলে যায়। দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং দুই নেত্রীকে কারাগারে পাঠায়। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করা হয়। ওই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩০ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মুখে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এরশাদকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়। ১৫২টি আসনের প্রার্থীকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। ওই নির্বাচনের পর থেকে শেখ হাসিনা কর্র্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা দল জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। তীব্র আন্দোলনের মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার করে শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলকে নির্বাচনে যেতে রাজি করান। এই নির্বাচনে রাতেই ভোট পর্ব সেরে ফেলা হয়। পুলিশ প্রশাসন এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘নিশি ভোট’-এর তকমা পায়। ২০২৪ সালের ‘আমি-ডামি’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ডামি প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০১৪ সালের পর থেকে শেখ হাসিনা দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করেন। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধী দলকে দমন, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ, ব্যাংকের অর্থ লোপাট করে বিদেশে পাচার, পুলিশকে পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করা ফ্যাসিবাদী শাসনে রূপ নেয়। বিএনপিসহ বিরোধী দল এবং বিভিন্ন জোটের আন্দোলন ২০২৪-এর জুলাই মাসে পরিণতি লাভ করে। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণ নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ছিল অভূতপূর্ব। শেখ হাসিনার দীর্ঘ কর্র্তৃত্ববাদী শাসনে লাখ লাখ মানুষের মাঝে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্দোলনে দেড় সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়। আহতদের সংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বুলেটে ৬০টি শিশুর জীবন অকালেই ঝরে গেছে। চোখ হারানোর সংখ্যা চার শতাধিক। এসবের বিনিময়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংস্কার কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এসব বিষয়ে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবনা তৈরি করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে সংলাপ শুরু করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিণতি বাংলাদেশকে নতুন করে সত্যের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
প্রান্তিক মানুষ টিকে থাকার জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করে চলেছে। বন্যায় ফসল ডুবে গেলে পানি নামার পর আবার ফসলের মাঠে নেমে পড়ে স্বপ্নের জাল বুনে। দূর উপকূলে জলোচ্ছ্বাসে বাড়িঘর ভেসে গেলে আবার বসত গড়ার স্বপ্ন দেখে। কাজের সন্ধানে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায় প্রতি বছর অসংখ্যা তরুণের সলিল সমাধি ঘটে। জমি বিক্রি করে, ঋণ করে সন্তানকে বিদেশে পাঠানো বাবা-মার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হলেও সামগ্রিকভাবে সমাজে বৈষম্য বিরাজ করছে। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান মনে করেন, বাংলাদেশে বৈষম্যের মূলে অন্যায্য সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘জিডিপির প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকার পরও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নতি হয়েছে। পুষ্টি, শিশু মৃত্যুহার, বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের বছর, স্যানিটেশন, জ্বালানি, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, বাসস্থান ইত্যাদি সূচকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তবে সমাজে সম্পদের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বছরের পর বছর সমাজে অন্যায় পরিস্থিতি বিরাজ করেছে।’ বৈষম্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই উদ্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি এক সংলাপে বলেছেন, ‘সমাজে বৈষম্য দূর করা সম্ভব হচ্ছে না।’
গত ৫৪ বছরে সুশাসন ও জবাবদিহির অভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি যেন প্রাতিষ্ঠানির রূপ পেয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় উপরে থাকলেও সুখী মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নিচে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ২০২৫’-এ ১৪৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৪ নম্বরে, গত বছর যা ছিল ১৪৩ দেশের ভিড়ে ১২৯তম। বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকা বিশে^র মধ্যে মাঝে মধ্যেই শীর্ষস্থানে থাকছে। এত কিছুর পরও জুলাইয়ের সফল অভ্যুত্থানের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ আবার স্বপ্ন দেখে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক