বাংলাদেশ গ্রীষ্মম-লীয় জলবায়ু এবং উর্বর মাটিতে সমৃদ্ধ এবং সম্প্রতি অনুমিত মোট কৃষি উৎপাদন প্রায় ৭-৮ কোটি মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ধান, আলু ও চিনি, ১৭ শতাংশ ফল, শাকসবজি এবং মসলা। মোট শ্রমশক্তির ০-৪৫ শতাংশ নিযুক্ত কৃষিক্ষেত্রে এবং জিডিপিতে ১৪ শতাংশের মতো। সময়ের বিবর্তনে, বাংলাদেশের কৃষিতে পা ফেলে কৃষি-খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, যা বর্তমানে জিডিপিতে ২-২.৫ শতাংশ অবদান রেখে প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। মোট রপ্তানিতে এর অংশ এখন প্রায় ৪-৫ শতাংশ। বর্তমান নিবন্ধটিতে কৃষিপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা, সমস্যা এবং সুপারিশ নিয়ে আলোকপাত করা হবে। বলা বাহুল্য, নিবন্ধে ব্যবহৃত তথ্য এবং পর্যবেক্ষণের প্রধান উৎস বিভিন্ন ব্যবসায়ী, পত্রপত্রিকা এবং গবেষকদের মতামত।
এক
সন্দেহ নেই যে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কৃষি খাত উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ এবং উল্লম্ফন প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের উর্বর জমি, অনুকূল জলবায়ু এবং সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা কৃষি-ব্যবসার জন্য প্রচুর সুযোগ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমানের কৃষিপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, বাংলাদেশের কৃষি-রপ্তানি আয় বৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের কৃষি-খাদ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাজারে। ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তার অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনা এবং প্রবৃদ্ধির নতুন উৎস খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান। দেশের অন্যতম বৃহৎ খাত হিসেবে কৃষির এই প্রচেষ্টায় অবদান রাখার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই খাতে এখনো অনেক অব্যবহৃত সম্ভাবনা রয়েছে এবং যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে বলে বিজ্ঞ মহল মনে করেন। এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।
দুই
যদিও বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, তারপরও নীতিগত সহায়তার অভাব, উচ্চ ব্যয় এবং ভালো কৃষি অনুশীলনের অনুপস্থিতির কারণে গত দশকে সামগ্রিক রপ্তানির তুলনায় কৃষিপণ্য রপ্তানি ধীরগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় এক দশকের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় ১১৪ শতাংশ বেড়ে ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে কৃষিপণ্য রপ্তানির পরিমাণ তেমন আশানুরূপ হয়নি, অনুমান করি ৮০০-৯০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
তিন
সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করছেন, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বেশ কিছু বাধা থাকলেও, প্রধান বাধা হলো নীতিগত সহায়তার অভাব। উদাহরণস্বরূপ যুক্তি দেখানো হয় যে, সুগন্ধি চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এই আশঙ্কায় যে, এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। কিন্তু এ ধরনের চাল একটি অপরিহার্য খাদ্য নয়, তাই এটি খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মতে, বাংলাদেশ বার্ষিক ১৯ লাখ টন পর্যন্ত সুগন্ধি চাল উৎপাদন করে, যার মধ্যে মাত্র ১০,০০০ টন রপ্তানি করে। সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে বলে ধারণা রপ্তানিকারকদের।
নীতিগত সহায়তার অভাবের অন্য একটি উদাহরণ উল্লেখ করা হয় ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে নগদ প্রণোদনা ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া কাঁচামালের উচ্চমূল্য স্থানীয় রপ্তানিকারকদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকার আরেকটি কারণ এবং সম্ভবত সেই কারণে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে চিনির দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আবার দেশে গমের দামও বেশি এবং চিনি ও গম জুস এবং স্ন্যাকস আইটেমের দুটি প্রধান উপাদান। ‘তাহলে আমরা কীভাবে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করব?’ জিজ্ঞাসা রপ্তানিকারকদের।
এখানেই সমস্যার শেষ নয়। কনটেইনার পরিবহন খরচও ৪ থেকে ৫ গুণ বেড়েছে। এ ছাড়াও খাদ্য উৎপাদকদের বিশেষায়িত প্যাকেজিং আমদানি করতে হয় এবং এর জন্য উচ্চ শুল্ক দিতে হয়, যা তাদের উৎপাদনের উপকরণ খরচ বাড়িয়ে দিয়ে উৎপাদন এবং রপ্তানি ব্যাহত করে। অথচ বর্তমানে, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের ৪৮৬টি উৎপাদক রয়েছে, যার মধ্যে ২৪১টি রপ্তানিকারক এবং বাকিরা দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে। বাংলাদেশ ১৪৫টিরও বেশি দেশে শস্য, চা, শাকসবজি, তামাক, ফুল, ফল, মসলা, শুকনো খাবার এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংগঠন (আসিয়ান) বাংলাদেশের জন্য একটি ভালো বাজার এবং তাই বাজার দখলের জন্য সরকার আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাতের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ বেশিরভাগ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় বিদেশেও তাদের পণ্যের চাহিদা বেশি।
কৃষি উৎপাদনে বিপ্লবের ফলে, বাংলাদেশ ধান, শাকসবজি এবং পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় স্থানে রয়েছে, যেখানে পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম চাষে সপ্তম স্থানে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, রপ্তানিতে প্রচেষ্টা চালানো এবং বিশ্ববাজারে একটি ভালো অবস্থান অর্জনের আগে দেশকে দুটি বিষয়ের ওপর মনোযোগ দিতে হবে।
চার
অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, কৃষি রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ভালো কৃষি পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা এবং আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (আইএসও) কর্র্তৃক অনুমোদিত পরীক্ষাগারে পণ্যের পরীক্ষা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি কাজ। যেমন- ভালো কৃষি পদ্ধতি কীটনাশক, জৈব ও রাসায়নিক সারের পরিমিত ব্যবহার এবং সম্পদের পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহিত করে।
এই পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, সর্বত্র অভিন্ন এবং সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি ক্রেতারা যখন মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা চান, তখন এটি ভোক্তাদের আস্থা নিশ্চিত করবে বলে আমাদের ধারণা।
বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের বাজার বিস্তৃত এবং আন্তর্জাতিক বাজার বিশাল হওয়ায় কৃষি রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২০২৭ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক কৃষিবাজার ১৯,০০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৯.১ শতাংশ। পশ্চিমা দেশগুলো ছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলোও তুলনামূলকভাবে সহজেই এই বাজারে রপ্তানি চলছে। তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কৃষিপণ্য পাঠানোর জন্য যথাযথ সার্টিফিকেশন প্রয়োজন। তা ছাড়া কৃষিপণ্যের রপ্তানি কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো মালবাহী খরচ এবং বিমানে পণ্য পরিবহনের জন্য জায়গার অভাব।
পাঁচ
এক হিসাবে দেখা যায়, ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের মোট বাজারের আকার ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তাই, বাজার দখলের জন্য এই শিল্পের বিকাশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।
ছয়
চাল, পাট, চা এবং চিংড়িসহ অনেক কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে। এগুলো এবং মূল্য সংযোজনকারী অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে, দেশটি আরও বৈচিত্র্যময় এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। কৃষি রপ্তানির চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা এবং কৃষি রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, বেসরকারি খাত এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানের মান মেনে চলা নিশ্চিত করার জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা শুরু করেছে। এসপিএস অবকাঠামো আধুনিকীকরণ এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (উঅঊ) উদ্ভিদ সংগঠন শাখা এবং উদ্ভিদ সুরক্ষা শাখার মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রযুক্তি গত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রপ্তানিকারকদের জন্য সম্মতির বোঝা কমাতে আধুনিক পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ, আমদানিকারকদের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নত প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প শুরু করেছে। কৃষিপণ্যের মান উন্নত করার জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ভালো কৃষি অনুশীলন (এঅচ) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কৃষিপণ্যের সম্পূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খল ট্র্যাক করার জন্য একটি ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম বাস্তবায়নের জন্য উঅঊ-এর উদ্ভিদ সংগঠন শাখা টঝউঅ-এর সঙ্গে কাজ করছে। এই সিস্টেমটি রপ্তানিকারকদের পণ্যের উৎপত্তি, চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতি এবং সংরক্ষণের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করতে সক্ষম করে। এটি নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে যে, পণ্যগুলো প্রয়োজনীয় মান এবং সুরক্ষা মান পূরণ করে।
সাত
সুপারিশমালা নিয়ে কিছু কথা
(ক) আমাদের সমন্বিত হিমাগার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং পরিবহনের সময় পচনশীল কৃষিপণ্যের গুণমান সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের কথা ভাবতে হবে। এর মধ্যে রেফ্রিজারেটেড ট্রাক এবং স্টোরেজ সুবিধা স্থাপনের পাশাপাশি খামার থেকে বাজারে পণ্যের মসৃণ পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য কোল্ড চেইন লজিস্টিক সিস্টেম স্থাপন করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
(খ) আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের প্রচারের জন্য বিপণন এবং ব্র্যান্ডিং কৌশলগুলো আধুনিকীকরণ করা উচিত। এর মধ্যে লক্ষ্য বাজার চিহ্নিত করার জন্য বাজার গবেষণায় বিনিয়োগ, বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের অনন্য গুণাবলি তুলে ধরে এমন প্রচারমূলক উপকরণ তৈরি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রদর্শনী এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
বিশে^র কাছে একটি জাতির পরিচয় এবং ভাবমূর্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং এটি কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা সবাই জানি যে, ব্র্যান্ডিং একটি দেশের পণ্য এবং পরিষেবা বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার এবং এটি ভোক্তাদের মনে একটি দেশের ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে। বাংলাদেশের এমন একটি ব্র্যান্ড কৌশল তৈরি করা দরকার, যা তার অনন্য বিক্রয় প্রস্তাবকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে। কৌশলটিতে একটি উপযুক্ত ব্র্যান্ড বার্তা, লোগো এবং বিপণন প্রচারণা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যা বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাগুলো আলোকিত করতে পারে। একটি বিস্তৃত ব্র্যান্ডিং কৌশল তৈরি করতে সরকারি সংস্থাগুলো শিল্প নেতা এবং কৃষি-বাণিজ্য ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে।
(গ) কৃষি রপ্তানির জন্য একটি কান্ট্রি ব্র্যান্ড তৈরির ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের প্রচেষ্টা অনুকরণীয়-পণ্য প্রচার, মান উন্নত করা এবং অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। এই প্রচেষ্টা থাইল্যান্ডকে বিশ্বব্যাপী কৃষি-রপ্তানি বাজারে একটি প্রধান খেলোয়াড় হতে সাহায্য করেছে এবং কৃষি-রপ্তানির জন্য তাদের দেশের ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাওয়া অন্যান্য দেশের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
(ঘ) কৃষি-রপ্তানিকারকরা কৃষিপণ্য রপ্তানিতে, বিশেষ করে স্যানিটারি এবং ফাইটোস্যানিটারি (ঝচঝ) প্রয়োজনীয়তা পূরণে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। ঝচঝ ব্যবস্থাগুলো কীটপতঙ্গ এবং রোগের প্রসার এবং বিস্তার রোধ করে মানুষ, প্রাণী এবং উদ্ভিদের স্বাস্থ্যরক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় হলেও, এই ব্যবস্থাগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধাও তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যেখানে জটিল ঝচঝ প্রয়োজনীয়তা মেনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সম্পদের অভাব থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক দেশ পণ্যগুলোকে নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গ এবং রোগ থেকে মুক্ত রাখতে বাধ্য করে, যা বাংলাদেশে প্রচলিত নাও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে, রপ্তানিকারকদের ব্যয়বহুল কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে হতে পারে অথবা এই প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণ করার জন্য অতিরিক্ত সার্টিফিকেশন পেতে হতে পারে। ঝচঝ ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সম্মতি এবং ফাইটোস্যানিটারি নির্দেশিকা, প্রোটোকল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং নজরদারি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকারক প্রভাব এবং প্রস্তাবিত ব্যবহারের নির্দেশিকা মেনে চলার গুরুত্ব সম্পর্কে উৎপাদকদের সচেতন করতে হবে। কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে সরকারের বিদ্যমান উদ্যোগগুলোকে পুনঃনিবেশিত করা প্রয়োজন, কারণ এটি রপ্তানিতে অ-সম্মতির জন্য ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়।
(ঙ) ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ঊট) বিশ্বের কৃষিপণ্যের অন্যতম বৃহৎ বাজার। ইইউ মান এবং নিয়ম মেনে চলা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, অনেক রপ্তানিকারক প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং ইইউ বাজারের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে সংগ্রাম করছেন। অসম্মতি কমাতে এবং কৃষিপণ্যের জন্য ইইউ বাজারে প্রবেশাধিকার উন্নত করার জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনার জন্য সরকার, শিল্প এবং নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। অসম্মতির মূল কারণগুলো মোকাবিলা করে এবং ব্যবহারিক সমাধান বিকাশের জন্য একসঙ্গে কাজ করে, রপ্তানিকারকরা তাদের প্রতিযোগিতামূলকতা বৃদ্ধি করতে এবং নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে, পাশাপাশি তাদের পণ্যগুলো গুণমান, সুরক্ষা এবং টেকসইয়ের সর্বোচ্চ মান পূরণ করে তা নিশ্চিত করতে পারে। দেশে ফল, শাকসবজি, মসলা, শস্য এবং মাছের মতো কাঁচামালের প্রচুর সরবরাহ রয়েছে, যা রপ্তানির জন্য উচ্চ-মূল্যের পণ্যে প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে। রপ্তানির জন্য সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হলো প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাত। জ্যাম, আচার, সস, চাটনি এবং টিনজাত ফল ও সবজির মতো প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যগুলোর সুবিধা, দীর্ঘমেয়াদি শেলফ লাইফ এবং অনন্য স্বাদের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ চাহিদা রয়েছে।
(চ) উন্নত প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশল এবং আধুনিক প্যাকেজিং পদ্ধতির ব্যবহার পরিবহনের সময় এই পণ্যগুলোর গুণমান এবং সতেজতা বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, শুকনো খাবার এবং সামুদ্রিক খাবারসহ বিভিন্ন ধরনের শুষ্ক এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামো, মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক মান মেনে চলার মাধ্যমে, বাংলাদেশ এই বাজারগুলোতে প্রবেশ করতে পারে এবং তার রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে পারে। এটি কেবল দেশের অর্থনীতিকেই উপকৃত করবে না বরং কৃষক, প্রক্রিয়াজাতকারী এবং রপ্তানিকারকদের কৃষি খাতের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নতুন সুযোগও প্রদান করবে। বাজার অ্যাক্সেসের জন্য আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে, বাংলাদেশের কৃষি রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। এর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, বাজার এবং অংশীদারদের সঙ্গে মান এবং নিয়মকানুন মেনে চলা, বাজার অ্যাক্সেস উন্নত করা এবং নতুন প্রযুক্তি এবং জ্ঞান প্রবর্তনের জন্য সম্পৃক্ত তা প্রয়োজন। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার কৃষি খাতের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে পারে এবং বিশ্ববাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়