সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ডেডিকেটেড সিটি বাস সার্ভিস ঢাকার চেহারা পাল্টে দেবে

আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ১২:৩৮ এএম

বাংলাদেশ বহু ঘনত্বের দেশ। শুধু ঢাকা শহরে ২ কোটি মানুষ বসবাস করে। নানা কারণে প্রতিদিন সারা দেশ থেকে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ ঢাকায় আসে। জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। এখানে বাসের ব্যবসার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র চাঁদাবাজি বন্ধ করে ডেডিকেটেড বাস লাইন চালু করা গেলে, বাস সার্ভিসের মধ্য দিয়ে নগরীর যাতায়াত ব্যবস্থার চিত্র রাতারাতি পাল্টে দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) পরিচালনায় অভিজ্ঞ দক্ষ একজন বিশেষজ্ঞ পরিচালক খুঁজে দায়িত্ব দেওয়া। বাংলাদেশে অনেক বাস কোম্পানি একটি বাস নিয়ে রাস্তায় নেমে, কেউ ৬শ কেউ ৮শ কেউ ১২শ বাসের মালিক হওয়ার নজির রয়েছে। অথচ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পরিচালনায় অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাস পরিচালনা করতে পারছে না। তারা সরকারের কিনে দেওয়া বাস বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দিয়ে পরিচালনা করে। ফলে ইজারাদার যে বাসটি দৈনিক ৫ হাজার টাকা জমার চুক্তিতে বিআরটিসি থেকে ইজারা নেন, তিনি তৃতীয় পক্ষ কাউকে অথবা ঐ বাসের চালকের কাছে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা জমা চুক্তিতে পুনঃইজারা দেন। ঐ চালক ভাড়া আদায়কারী বাসের সহকারীর কাছে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকার চুক্তিতে ভাড়া কাটতে ইজারা দেন। তারা আবার প্রতিদিন বেতন আদায়ের পরেও ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা মুনাফা তোলার চেষ্টা করেন। অথচ নির্মাণ ও মেরামতের যাবতীয় খরচ বিআরটিসির ঘাড়ে। এভাবে প্রতিটি বিআরটিসি বাসে দৈনিক কয়েকজনের ভাগবাটোয়ারার ভাড়ে ন্যুব্জ বাসটি বছর ঘুরতেই অচল হয়ে গ্যারেজে পড়ে থাকে। এভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতিবছর বিআরটিসির বাসের সংখ্যা কমছে। নতুন বাস অকেজো হয়ে ডিপোতে ডিপোতে পড়ে থাকে। আমি মনে করি, বিআরটিসি পরিচালনায় আমলাদের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দক্ষ, অভিজ্ঞ, কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ একজন পরিচালক নিয়োগ দিয়ে বিআরটিসি পরিচালনা করা গেলে বিআরটিসিকে লাভজনক করা যাবে। পাশাপাশি যাত্রী পরিবহন খাতে সরকারের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। বিআরটিসি যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ভোগান্তি লাঘবে ভূমিকা রাখবে, বেসরকারি বাস মালিকদের ধর্মঘট, বিরোধী দলের হরতাল অবরোধে জনগণের পাশে থাকবে এবং পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও বিআরটিসিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করার অঙ্গীকার করেছে। তাই দেশের প্রবেশদ্বার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের ইতিহাসে পরপর ৪ মেয়াদে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুধু দেশে নয়, দুনিয়ার ইতিহাসে দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকভাবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি মূলত রাজনীতিক হিসেবে যেমন ব্যর্থ ছিলেন, সড়কের নীতি প্রণয়ন এবং কৌশল নির্ধারণেও সফল ছিলেন না। তার হাতে দীর্ঘদিন এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকার কারণেই সড়কে বিশৃঙ্খলা থামেনি, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তিনি ২০১২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে রাজধানীতে বাসের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার, ক্ষমতাচ্যুত করার সময় ২০২৪ সালে এই বাসের সংখ্যা কমে ৩ হাজারে ঠেকেছে। অপর দিকে ২০১২ সালে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৭ লাখ, ২০২৪ সালে মোটরসাইকেল ৬০ লাখে পৌঁছেছে। সারা দেশে ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক তার আমলে বিস্তার লাভ করেছে। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যানজট-জনজট চরমে পৌঁছেছে। এমন বাস্তবতায় ঢাকা মহানগরীতে যাত্রী হয়রানি ও ভাড়া নৈরাজ্য, সড়কে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা চরমভাবে বেড়েই চলেছে। উন্নয়ন গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ৪র্থ মেয়াদেও এক বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের মেয়াদকালে সড়কের অবকাঠামো নির্মাণে অগ্রগতি হলেও দুর্নীতি ছিল লাগামহীন। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের থেকেও বেশি দামে সড়ক সেতু নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। বিগত সরকার দাবি করতেন, তারা উন্নয়নে রোল মডেলের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ‘বড় প্রকল্প মানে বড় দান মারা’ এমন তত্ত্বের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছিল সড়কের নানা প্রকল্প। তবে তাদের নেতৃত্বের অযোগ্যতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি এবং পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের মাফিয়া নেতাদের তোষণ নীতির কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। 

অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তাই এই সরকার সড়ক পরিবহন সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো, রাজধানীসহ সারা দেশের লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন উচ্ছেদ করে উন্নত দেশের আদলে স্মার্ট, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি দেশবাসীর। বর্তমান সরকারের পরিকল্পনায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছোট ছোট যানবাহনের পরিবর্তে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ১টি কোম্পানির অধীনে উন্নতমানের রাজধানীতে ২ হাজার, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২শ, সিলেট মহানগরীতে ১শ, রাজশাহী মহানগরী ১শ, বরিশাল মহানগরীতে ১শ, রংপুর মহানগরীতে ১শ, খুলনা মহানগরীতে ১শ, ময়মনসিংহ মহানগরীতে ১শ-সহ ৩ হাজার নতুন বাস নামানো জরুরি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে অথবা কেবলমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১টি কোম্পানির অধীনে এই বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়। এই কোম্পানি সফল হলে দেশের জেলা সদর থেকে প্রতিটি উপজেলায় বাস সার্ভিস গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশব্যাপী স্মার্ট বাস সার্ভিস গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। এই কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাদের পরিবর্তে বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) পরিচালনায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ লোকজন রাখা না গেলে, এই প্রকল্প বিআরটিসির মতো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নোংরা আর্বজনায় ভরপুর নারকীয় পরিবেশে লক্কড়-ঝক্কড় নগর পরিবহনগুলোতে প্রতিদিন যাতায়াতে মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাধ্য হচ্ছে। যানজট-জনজটে আটকা পড়ে প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে কর্মক্ষম মানুষের লাখো কোটি টাকার মহামূল্যবান শ্রমঘণ্টা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য, গণপরিবহনগুলোকে মুড়ির টিন বানিয়ে ইচ্ছেমতো যাত্রী হয়রানি চলছে। ভয়াবহ বায়ুদূষণ ও ধুলো দূষণের শিকার হচ্ছে নগরবাসী। যাত্রী ও নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিগত সরকারের সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হক ঢাকার পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিলে, কতিপয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের অসাধু নেতারা বেঁকে বসে। ফলে তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়, সাবেক মেয়র তাপসের নেতৃত্বে কোনো প্রকার সমীক্ষা ছাড়া চালু হওয়া চিটাগাং রুট-ঘাটারচর রুটের বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের আওতায় ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে কয়েকটি রুটে বাস সার্ভিস চালু করা হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে। সদরঘাট থেকে গাবতলী আমিন বাজার পর্যন্ত চালু হওয়া ওয়াটার বাস সার্ভিসও একই পন্থায় বন্ধ হয়ে যায়। এহেন পরিস্থিতিতে নগরীর যাত্রী সাধারণ এখন পরিবহন মালিক শ্রমিকদের ইচ্ছের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। সাধারণ মানুষ ইজ্জত ও মর্যাদা নিয়ে সিটি সার্ভিসের এসব লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহনে যাতায়াত করতে পারছে না। বিগত সরকার পরিবহনের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের কয়েকজন নেতাকে নানাভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের  স্বার্থগুলো অগ্রাধিকার দিয়েছে। তৎকালে পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ফোরামে মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে রাখা হলেও, যাত্রী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। দীর্ঘসময় বিগত সরকারের নীতি ও কৌশলে অদূরদর্শিতার কারণে পরিবহনে চাঁদাবাজি, যাত্রী হয়রানি ও ভাড়া নৈরাজ্য, ছোট যানবাহনের আধিক্যের ফলে সারা দেশে বাস নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছে। জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬ মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মিলে মাত্র ৩৫ শতাংশ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম হবে। বাকি ৬৫ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করবে বিদ্যমান লক্কড়-ঝক্কড় বাস। অথচ মাত্র ২ হাজার নতুন বাস নামাতে মাত্র আড়াই থেকে ১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। সরকার চাইলে পিপিপির মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এই ধরনের বাস সার্ভিস চালু করা যেতে পারে।

চট্টগ্রাম শহরকে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক শহর হিসেবে গড়ে তোলা গেলে এবং প্রশাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালত চট্টগ্রামে সম্প্রসারণ করা গেলে, ঢাকা জনসংখ্যার চাপ কমানো সম্ভব। তাই নতুন সরকারের উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় রাজধানী থেকে জনসংখ্যার চাপ কমানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে নেতৃত্বের অযোগ্যতা, পরিচালনার অদক্ষতা, সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব, রাজনৈতিক ঠিকাদারের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে দেশের নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ ও পুরনো সড়ক মেরামত, নৌপথ খনন, নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ ও পুরনো রেলপথ মেরামত, ইঞ্জিন ও কোচসহ নানা খাতে কেনাকাটায় এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বেশ কয়েকগুণ বাড়তি খরচের নামে দুর্নীতির মহোৎসব ছিল বিগত সরকারের সময়। এখান থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার সব সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা সড়ক, রেল, নৌ ও বিমানপথে প্রতিটি প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার সরকারের অঙ্গীকারের প্রতিফলন দেখতে চাই।

লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত