শ্রীলঙ্কা, ছোট্ট এই দ্বীপ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কত স্মৃতিই না জড়িয়ে! এশিয়া কাপে এই শ্রীলঙ্কাতেই, ১৯৮৬ সালে মোরাতোয়াতে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। বর্তমান প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন সেদিন টস করেছিলেন ইমরান খানের সঙ্গে। এখানেই মোহাম্মদ আশরাফুলের সেই বিস্ময় জাগানো শতক, মুশফিকুর রহিমের ডাবল সেঞ্চুরি, কলম্বোতে শততম টেস্টে জয়। শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের ক্রিকেটের পথচলারও সঙ্গী। অনেক কোচরা এসেছেন শ্রীলঙ্কা থেকে, যেহেতু শ্রীলঙ্কাও একটা সময়ে ক্রিকেটের ছোট দল থেকে বিশ্বকাপজয়ী দল হয়েছে, তাই তাদের পথনকশা মেনে বাংলাদেশও একটা সময়ে সেই সাফল্য অর্জন করবে এমনটাই মনে করতেন অনেকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বে চিড় ধরেছে নানান ঘটনায়। নিদাহাস ট্রফিতে ‘নাগিন উদযাপন’, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের বিশ্বকাপে টাইম-আউটসহ বেশ কিছু ঘটনা দুই দলের সম্প্রীতিতে ফাটল ধরিয়েছে। আজ গলে শুরু হচ্ছে শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ দুই টেস্ট সিরিজের প্রথমটি, যে ম্যাচটা খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন ম্যাথিউস। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে বলে গেলেন, সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কোনো ক্ষোভ নেই তার মনে।
২০০৯ সালে গলেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক, আজ এখানেই শুরু ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টের। ১১৮ টেস্টের ১০টি খেলেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। আছে ১৯৯ রানে রানআউট হওয়ার অনাকাক্সিক্ষত স্মৃতিও। যেভাবে মাঠ থেকে বিদায় নিচ্ছেন, সেটা দেখে খানিকটা আক্ষেপ বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তরও, ‘আপনি যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস দেখেন, অনেক তারকা ক্রিকেটার আছেন, যাদের বিদায়টা যথাযথ হয়নি। রাষ্ট্রীয় বা বোর্ড থেকে সম্মানজনক বিদায়ের সুযোগ পাননি। এখন যারা খেলছেন, তাদের জন্য এটা শেখার বিষয়। ভবিষ্যতে যারা বিদায় নেবেন, তাদের জন্যও একটা সুন্দর বিদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। ম্যাথিউসের জন্য শুভকামনা থাকবে। তিনি যেন ভালোভাবে অবসর নিতে পারেন।’
ম্যাথিউসের বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনের আবহের আড়ালে নিজেদের দলের সমস্যাগুলো ভালোই আড়াল করেছেন শান্ত। ইনিংসের সূচনায় নামবেন নাকি ওয়ান ডাউনে, সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন তথ্য ফাঁসের দোহাই দিয়ে, ‘আমার ব্যাটিংটা আসলে কোন জায়গায় হবে, এটা কালকেই বলতে চাই। কারণ, আমি চাই না আমার যে প্রতিপক্ষ আছে, তারা আগে থেকে ওই ধারণাটা পেয়ে যাক। আমরা কী কম্বিনেশনে যাব, তার ওপর নির্ভর করে ১১ জনের দল সাজানো হবে।’ দলের সমন্বয় ঠিক করতে না পারার প্রধান কারণ সহ-অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের অসুস্থতা। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সবশেষ চক্রে ১২ ম্যাচে ৭০০’র বেশি রান আর ৩৯ উইকেট নেওয়া মিরাজের বিকল্প কেউ নেই। শুধু তাই নয়, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেশের মাটিতে খেলা সবশেষ টেস্ট সিরিজেরও সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। তাই তো এই অলরাউন্ডারের জন্যই শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন অধিনায়ক, ‘মিরাজের অবস্থা আগের থেকে ভালো। তবে সে এখনো পর্যবেক্ষণে আছে। ওকে পাওয়া না পাওয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সেটা নিশ্চিত হয়ে গেলেই আমরা দলটা সাজিয়ে নিতে পারব।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংসের সূচনা করেছিলেন সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক। সেঞ্চুরিয়ান সাদমানকে নিঃসন্দেহে পরের টেস্টে বসিয়ে রাখবে না টিম ম্যানেজমেন্ট। মিরাজ যদি শেষ পর্যন্ত না খেলেন সে ক্ষেত্রে হয়তো ব্যাটিং শক্তি বাড়াতে একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান একাদশে নিতে পারে বাংলাদেশ। সে ক্ষেত্রে টেস্ট একাদশে প্রত্যাবর্তন হতে পারে লিটন দাসের, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে যার খেলা হয়নি।
লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ২০২৩-২৫ চক্রের শিরোপা নিষ্পত্তি শেষ হওয়ার ৭২ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই গলে শুরু হয়ে যাচ্ছে ২০২৫-২৭ চক্রের খেলা, শুরুই হচ্ছে শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ সিরিজ দিয়ে। আগের চক্রে বাংলাদেশ জিতেছিল ৪ টেস্ট। এবার শান্ত চাইছেন জয়ের সংখ্যা বাড়াতে, সেদিকেই চোখ, ‘নতুন একটা প্রতিপক্ষ, নতুন একটা কন্ডিশনে খেলা। আমার মনে হয় এই কন্ডিশনে বেশ কিছু ক্রিকেটারের খেলার অভিজ্ঞতাও আছে। এই অভিজ্ঞতা যদি কাজে লাগাতে পারে, তাহলে এই সিরিজটা আমার মনে হয় যে ভালো কিছু হবে। কিন্তু আমাদের ভালো ক্রিকেট খেলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমরা যারা ব্যাটিংয়ের দায়িত্বে আছি।’ অভিজ্ঞতার পাল্লায় বাংলাদেশই এগিয়ে। শ্রীলঙ্কা সবশেষ চক্রে জিতেছে ৫ টেস্ট, বাংলাদেশের চেয়ে একটি বেশি। এবার শুরু থেকেই তারা ভবিষ্যৎমুখী ভাবনায়, ১৮ সদস্যের দলে এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ছয়জনই নতুন মুখ।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্রে বাংলাদেশের বিদেশে সিরিজ তিনটি; শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া। পরিবেশ ও প্রতিপক্ষ বিবেচনায় শ্রীলঙ্কাই এই তিনের ভেতর অপেক্ষাকৃত সহজ প্রতিপক্ষ এবং চেনা পরিবেশ। জয়ের বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা আছে এই প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাই ২৬ টেস্টের মাত্র একটিতে জিতলেও বাংলাদেশ অধিনায়ক শুনিয়েছেন জয়ের আশাবাদ। এ ছাড়া তার করারইবা কী আছে!