বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ইরানকে পারমাণবিক ওয়ারহেড দিতে প্রস্তুত অনেক দেশ!

আপডেট : ২৩ জুন ২০২৫, ০৭:৩০ এএম

শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষকে হতবাক করে গতকাল রবিবার ভোরে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে ফেললেন। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সংঘাত আরও বিপজ্জনক রূপ নেওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। বিশ্বনেতা ও কূটনীতিকদের কেউ কেউ এর নিন্দা জানিয়েছেন। অন্যরা উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি এ হামলাকে উত্তেজনাপূর্ণ একটি অঞ্চলে বিপজ্জনক মাত্রায় উত্তেজনা বৃদ্ধির ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, ‘এই সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে; যা বেসামরিক মানুষ, এতদাঞ্চল ও সারা বিশ্বের জন্যই ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।’

রাশিয়া : রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, অনেক দেশই তাদের নিজেদের পারমাণবিক ওয়ারহেড ইরানকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর রবিবার এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এমনটা বলেছেন বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। পোস্টে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, এটি উল্লেখ করার মতো কোনো সামরিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক জ্বালানিচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো সম্ভবত অক্ষতই আছে, নয়তো সামান্য ক্ষতি হয়েছে। পারমাণবিক উপাদানের সমৃদ্ধি, এখন দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি যে ভবিষ্যৎ পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন, অব্যাহত থাকবে।’

মেদভেদেভ আরও বলেছেন, ‘অনেক দেশ তাদের পারমাণবিক ওয়ারহেড ইরানকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’

তবে কারা কারা এ তালিকায় আছে তাদের নাম বলেননি তিনি।

মেদভেদেভ আরও বলেন, ইসরায়েলি জনগণ এখন ক্রমাগত হুমকির মধ্যে বসবাস করছে, তাদের অনেক এলাকা বিস্ফোরণে কাঁপছে। অন্যদিকে ইরান রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে।

এর আগে টেলিগ্রামে দেওয়া পোস্টে মেদভেদেভ ইরানে হামলা চালিয়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন একটি যুদ্ধের সূচনা করেছেন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প, যিনি শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন একটি যুদ্ধের সূচনা করলেন। এই ধরনের সফলতার মাধ্যমে, তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার জিততে পারবেন না।

চীন : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা নিয়ে অবশেষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করে এর কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের যেসব পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে, সেগুলো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র নজরদারির আওতাভুক্ত ছিল। এ ধরনের স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। চীন আরও বলেছে, ‘এই ধরনের সামরিক পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে উঠেছে।’

বিশেষভাবে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চীন বলেছে, ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ, বিশেষ করে ইসরায়েল, যেন দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং কূটনৈতিক সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের পথ গ্রহণ করে।’

যুক্তরাজ্য : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।’ তিনি ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার ও এ সংকটের একটি কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছার আহ্বান জানান।

অস্ট্রেলিয়া : অস্ট্রেলিয়া সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি।’

নিউজিল্যান্ড : নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সামরিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ উত্তেজনা যাতে আর না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

মেক্সিকো : মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর প্রতি কূটনৈতিক সংলাপ শুরু করা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে।

চিলি : প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বোরিক বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে এ হামলা অবৈধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘আমরা শান্তি চাই এবং শান্তি প্রয়োজন।’

ভেনেজুয়েলা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে এক পোস্টে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অবৈধ, অযৌক্তিক ও ভীষণ বিপজ্জনক আগ্রাসন বলে বর্ণনা করেছেন।

সৌদি আরব : বিবিসি জানায়, সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রিয়াদ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, বিশেষ করে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিষয়টি।

বিবৃতিতে উত্তেজনা কমাতে সংযম প্রদর্শন এবং সংঘাত এড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এ সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছার প্রচেষ্টা জোরদার করার আহ্বানও জানিয়েছে সৌদি আরব।

ওমান : আলজাজিরা জানায়, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিল ওমান। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অবৈধ আগ্রাসন বলে উল্লেখ করে এ কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে দেশটি। ওমান তাৎক্ষণিকভাবে ও সর্বাত্মক উত্তেজনা প্রশমনেরও আহ্বান জানিয়েছে।

ওমান নিউজ এজেন্সিকে ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, দেশটি এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং সতর্ক করে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ সংঘাত আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদেরও স্পষ্ট লঙ্ঘন।

কাতার : যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এ অঞ্চলে যে বিপজ্জনক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে কাতার।

ইরাক : ইরাক প্রতিবেশী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। এ হামলায় যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে বলেও উল্লেখ করেছে দেশটি।

এদিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে অংশ নিতে যাওয়া ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি রবিবার বলেছেন, পুতিনের সঙ্গে কথা বলতে তিনি মস্কো যাচ্ছেন। সোমবারই তার সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্টের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। রুশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপিআর) নেতা লিওনিদ সøাৎস্কি বলেছেন, ইরানে এই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক কারণ ছিল না এবং আন্তর্জাতিক আইনে এটি কোনোভাবেই বৈধতা পেতে পারে না।

‘উত্তেজনা বৃদ্ধির এ পরিণতি শুধু অঞ্চলটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ওয়াশিংটন তেহরানের প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী বলে বুঝতে পারছে। এ সব কিছু সংঘাতের দুষ্টচক্রকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়েছে,’ বলেছেন রুশ পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ স্টেট দুমার আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান স্লাৎস্কি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত