মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মোড় এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযান। ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে হামলা চালিয়ে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে সরাসরি জড়িয়েছে ওয়াশিংটন। এ হামলা শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং আঞ্চলিক ও বিশ্ব শান্তির জন্য নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে। ইরানের পাল্টা হুমকি, হরমুজ প্রণালি বন্ধের ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এ সংকটের গভীরতা আরও প্রকট করছে।
গতকাল রবিবার ভোরে ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বাহিনী ব্যাপক হামলা চালায়। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্পিরিট স্টেলথ বোমারু বিমান ও জিবিইউ-৫৭ ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ব্যবহার করে, যা ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংসে অত্যন্ত কার্যকর। ফক্স নিউজের উপস্থাপক শন হ্যানিটি জানান, ফোর্দোতে ছয়টি বাংকার বাস্টার বোমা এবং নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে মার্কিন সাবমেরিন থেকে ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ হামলাকে ‘অভূতপূর্ব সামরিক সাফল্য’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক হুমকি নির্মূল করাই আমাদের উদ্দেশ্য। ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে।’ তিনি ইরানকে শান্তি বেছে নিতে আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘নইলে ভবিষ্যৎ হামলা আরও কঠোর হবে।’ হোয়াইট হাউজ থেকে দেওয়া এক ভাষণে ট্রাম্প এ হামলাকে ‘যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, এবং বিশ্বের জন্য ঐতিহাসিক ক্ষণ’ বলে উল্লেখ করেন। ইসরায়েলের চাপ এবং রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের তাগিদ এ হামলার পেছনে কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মাত্র তিন দিন আগে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি দুই সপ্তাহের মধ্যে সংঘাতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু ইরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ প্রত্যাখ্যানের পর তিনি দ্রুত এ অভিযানের অনুমোদন দেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত করার অজুহাতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে। এবার তেল আবিবের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, ইরানের সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্টেলথ বোমা ও জিবিইউ-৫৭ বাংকার বাস্টার বোমা প্রয়োজন ছিল, যা ভূগর্ভের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম।
হোয়াইট হাউজ ও পেন্টাগন এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেনি। তবে শন হ্যানিটি জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে কথোপকথনের পর তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, ফোর্দোতে ছয়টি বাংকার বাস্টার বোমা এবং নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।
ইসরায়েল গত শনিবার দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের জন্য প্রস্তুতির ঘোষণা দেয়। তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়া পরিস্থিতিকে সবার জন্য বিপজ্জনক করে তুলবে।’
ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা হুমকি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, তবে তারা লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজে হামলা শুরু করবে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
২০১৮ সালে ২০১৫-এর পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের সাত বছর পর ট্রাম্পের নেতৃত্বে এ সংঘাত ঘটল। ওই চুক্তি ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করার বিনিময়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছিল। তবে ট্রাম্পের এ হামলার সিদ্ধান্ত তার দলের মধ্যেও সমালোচিত হয়েছে। অনেকে সতর্ক করেছেন, এ সংঘাতে গভীর জড়িত হওয়া ট্রাম্পের যুদ্ধবিমুখ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে।
ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর ট্রাম্প বলেন, এখনই ইরানের শান্তি স্থাপনের সময়। হোয়াইট হাউজের এক বিবৃতিতে তিনি নিশ্চিত করেন, ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে মার্কিন সেনাবাহিনী হামলা চালিয়েছে।
গত শনিবার রাত ১০টায় হোয়াইট হাউজ থেকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ‘এ নামগুলো আমরা বছরের পর বছর শুনে এসেছি, যখন তারা ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি করছিল। আজ রাতে, আমি বিশ্বকে জানাচ্ছি, ইরানে হামলা ছিল অসাধারণ সামরিক সাফল্য।’
তিনি দাবি করেন, ‘ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাস সমর্থক দেশটির পারমাণবিক হুমকি বন্ধ করাই এ হামলার লক্ষ্য।’ ট্রাম্প বলেন, ‘তেহরান যদি শান্তি বেছে না নেয়, তবে ভবিষ্যৎ হামলা আরও ভয়াবহ হবে। এভাবে আর চলতে পারে না। হয় শান্তি আসবে, নয় ইরানের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপর্যয়; আট দিনে যা দেখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি। মনে রাখবেন, আরও অনেক লক্ষ্য রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইলে অবশিষ্ট লক্ষ্যগুলোয় দ্রুত ও নির্ভুলভাবে হামলা চালাতে পারে, মাত্র কয়েক মিনিটে।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ঘোষণা দিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত সব মার্কিন নাগরিক ও সেনা এখন ‘বৈধ লক্ষ্য’। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক ঘোষক বলেন, ‘এ অঞ্চলে প্রত্যেক মার্কিন নাগরিক বা সেনা এখন বৈধ লক্ষ্য।’
গতকাল ভোরে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ঘোষণা দেয়, ‘এখন থেকে যুদ্ধ শুরু।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হোসেইন শারিয়তমাদারি মার্কিন নৌবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও হরমুজ প্রণালি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বলে সিএনএন জানায়। শারিয়তমাদারি বলেন, ‘ফোর্দোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এখন আমাদের পাল্টা জবাব দেওয়ার সময়।’
ইরানের কট্টরপন্থি দৈনিক কায়হানের টেলিগ্রাম বার্তায় বলা হয়, ‘বিলম্ব না করে বাহরাইনে মার্কিন নৌবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং হরমুজ প্রণালিতে আমেরিকান, ব্রিটিশ, জার্মান ও ফরাসি জাহাজ চলাচল বন্ধ করা উচিত।’
আয়াতুল্লাহ খামেনি এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে তিনি আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি জড়ায়, তবে তাদের ক্ষতি অপূরণীয় হবে।’
ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘ইরানের যেকোনো প্রতিশোধমূলক হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আরও ভয়াবহ শক্তি প্রয়োগ করবে।’
ইসরায়েলও সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ, জনসমাগম নিষিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র : ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জ তেহরান থেকে ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হয়েছে এটি। আইএইএ জানায়, নাতাঞ্জে ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা হয়েছিল, যা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য একধাপ পেছনে।
এ কেন্দ্রটি ভূগর্ভে নির্মিত, বিমান হামলা থেকে সুরক্ষিত। এখানে সেন্ট্রিফিউজ ক্যাসকেড রয়েছে, যা ইউরেনিয়াম-সমৃদ্ধকরণে ব্যবহৃত হয়। ইসরায়েলি হামলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার কারণে এর বেশিরভাগ সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেজস্ক্রিয়তা স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ ছিল। ইরান এখন নাতাঞ্জের দক্ষিণে ‘পিকঅ্যাক্স পর্বতের’ নিচে সুড়ঙ্গ খনন করছে। এটি স্টাক্সনেট ভাইরাস ও ইসরায়েলের পৃথক হামলার লক্ষ্য ছিল।
তেহরান থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ফোর্দো, নাতাঞ্জের তুলনায় ছোট। ২০০৭ সালে নির্মাণ শুরু হলেও ২০০৯ সালে জাতিসংঘকে জানানো হয়। এটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সুরক্ষিত।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলেন, এটি ধ্বংসে শুধু জিবিইউ-৫৭ বাংকার বাস্টার বোমা কার্যকর, যা বি-২ স্টেলথ বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়।
তেহরান থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইসফাহানে হাজারো বিজ্ঞানী কাজ করেন। এখানে তিনটি চীনা গবেষণা চুল্লি ও গবেষণাগার রয়েছে। ইসরায়েল এখানেও হামলা চালিয়েছে। আইএইএ জানায়, তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়নি।
বুশেহরে ইরানের একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যা রাশিয়ার ইউরেনিয়ামে চলে এবং আইএইএর নজরদারিতে আছে। আরাক হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর ও তেহরান গবেষণা চুল্লিও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বড় ধাক্কা দিলেও, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বিস্তারের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড আদম জানায়, তেল আবিবের বেশ কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১১ জন আহত হয়েছে।
এমডিএ জানায়, তেহরানের হামলায় দ্বিতল ভবন ধ্বংস হয়েছে। উদ্ধারকারী দল ১০টি স্থানে কাজ করছে। ভিডিওতে ধ্বংসস্তূপ ও ক্ষতিগ্রস্ত ভবন দেখা গেছে।
ইসরায়েলি পুলিশ জানায়, মধ্য ইসরায়েল ও হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। সিএনএনের এক প্রযোজক জেরুজালেমে বিস্ফোরণের শব্দ ও আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র দেখেছেন।
ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাশিয়া সফর : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে মস্কো যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব রয়েছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ে সমন্বয় করব।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘বিপজ্জনক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি একটি বড় সীমালঙ্ঘন।’