আশা এবং আশা ভঙ্গের কথা
মামুনুর রশীদ | ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০
প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যথার্থই বলেছেন, ‘অবৈধ টাকায় বিরিয়ানির চেয়ে সাদাসিধে জীবন ভালো’। এ কথাটি তিনি তার বহুবছরের অভিজ্ঞতার আলোকেই বলেছেন। তার পিতা বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, চাটার দল সব চেটেপুটে খেয়ে নিল। এ উক্তিটি তিনি করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর তার কন্যাও একই ধরনের উক্তি করলেন। ইতিমধ্যে ঐ চাটার দল নানাভাবে পুষ্ট হয়ে বিভিন্ন কৌশলে বিরামহীনভাবে চেটেপুটে খেয়েছে। সাম্পªতিক কালে প্রধানমন্ত্রী যে অভিযান শুরু করেছেন তাতে একদিক থেকে আমরা আশান্বিত হয়েছি আবার অন্যদিকে খুবই হতাশ হয়েছি। কারণ এই বার্তাটি কোথাও পৌঁছাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সন্দিহান হচ্ছি। বিভিন্ন সংগঠনের প্রধানদের বিরুদ্ধে যে অভিযান তিনি চালাচ্ছেন তাতে সংগঠনগুলোর মধ্যে আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একটা ঝাঁকি লেগে ভয় পাওয়ার বিষয় ছিল। কিন্তু তা কী হয়েছে? দায়িত্বহীন আচরণের জন্য সেদিন ওসি মোয়াজ্জেমের আট বছরের জেল ও দশ লক্ষ টাকা জরিমানা হলো। আশা করা যায় পুলিশ বাহিনী এই বিচারের পর আর কোনো দায়িত্বহীন আচরণ করবে না। ছাত্রলীগও সব জায়গায় সাবধান হয়ে যাবে। কিন্তু বুয়েটে আবরার হত্যার পর প্রমাণ হলো এই বার্তাটি ওখানে পৌঁছায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো কোনো উপাচার্যের আচরণেও বিষয়টি বোঝা যায়।
প্রধানমন্ত্রী এও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তার কাছে সবার আমলনামাই আছে। তাহলে ব্যবসায়ীরা সম্পªতি পেঁয়াজ এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে ঘটনা ঘটাচ্ছে তা কী করে সম্ভব হচ্ছে? আসলে আরেক জায়গায় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তাও সত্যি। তিনি বলেছেন টাকা বানানো একটা রোগ, অসুস্থতা। এই রোগে ১৯৭৪ সাল থেকে এ যাবৎ লক্ষ লক্ষ লোক আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষমতার অপর নাম যেন অর্থ উপার্জন। এই রোগে যারা একবার আক্রান্ত হয়েছে তাদের নিরাময় অসম্ভব। কারণ স্বচ্ছতার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা থাকা দরকার তা আমাদের আইন-কানুনে নেই। এখানে টাকা পাচার করা খুবই সহজ। ডলারের বাজার উন্মুক্ত। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা খুবই প্রতাপশালী। কোটি কোটি টাকা প্রতিদিন বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে লেখাপড়া করে। এই টাকা বৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর কোনো আইন নেই। তাহলে টাকা যাচ্ছে কী করে? এটাও বিচারের বিষয় যাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়ে তাদের বৈধ আয়ের পরিমাণ কত? এই টাকা দিয়ে নিজে দেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেও কী করে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য বিদেশে বিপুল টাকা পাঠানো সম্ভব?
১৯৮৫ সালে আমি কিছুদিন মুম্বাইয়ে ছিলাম। মুম্বাইয়ের বিমান অফিসে গিয়ে বসে থাকতাম। ম্যানেজার ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু বেচারার নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল ভিআইপি ডিউটি করতে করতে। ডেপুটি সেক্রেটারি থেকে শুরু করে সচিব, মন্ত্রী সবাইকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে হতো। ঢাকা থেকে ফ্লাইটটি মুম্বাই পৌঁছাত রাত ৪টার দিকে। তাদের রিসিভ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যেত। তারপর দিনের বেলায় বিভিন্ন কনভেন্ট ও স্কুলে ছাত্র ও অভিভাবকদের পাঠিয়ে দিয়ে ঘুম জড়িত চোখে অফিসে আসতেন দুপুর নাগাদ। বারবার বলতেন– এ চাকরি তার আর ভালো লাগছে না। তেমনি দেখেছি পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাঙালি ট্রাভেল এজেন্টদের অফিসে অভিভাবকদের ভিড়। তাদের সন্তানেরা সেখানে পড়ালেখা করছে এবং হুন্ডির দালালরা আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাত্র স্কলারশিপ নিয়ে যারা বিদেশে যায় সেইসব ছাত্রছাত্রীর ড়্গেত্রে এসবের বালাই নেই। কিন্তু অধিকাংশ ড়্গেত্রে বিত্তবান লোকরা দেশে ও বিদেশে ডিগ্রি কিনতে চায়। তাই সন্তানের মেধাকে লালন না করে শুধু সার্টিফিকেট কেনায় ব্যস্ত থাকে। পরিশেষে একটি অধঃপতিত মানুষ হিসেবে সন্তানটি বড় হয়। যারা অধঃপতিত হয় না তাদের একটি সত্য ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কোনো এক উচ্চপদস্থ আমলা তার ছেলেকে ইংল্যান্ডে পড়ালেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন। প্রতি মাসে তার খরচ পাঠাতেন হুন্ডির মাধ্যমে। খরচের বাইরেও বেশ কিছু টাকা তিনি পাঠাতেন। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর ছেলেটি দেশে ফিরে আসতে চাইল। কিন্তু তার বাবা তাকে ওখানেই থাকতে বলেন। সে কিছুতেই রাজি হয় না কারণ ইতিমধ্যেই সে বাংলাদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি পেয়ে গেছে। একদিন সে দেশে এসে বিমানবন্দরে নামল, বিমানবন্দরে তাকে নেওয়ার জন্য কেউ এলো না। সরাসরি সে বাসায় এসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। বাবা অফিস সেরে ড়্গিপ্ত হয়ে ঘরে ঢzকলেন। ছেলেও ড়্গিপ্ত হয়ে ছিল। বাবাকে সরাসরি বলে ফেলল– তুমি মানি লন্ডারিং করতে আমাকে ইংল্যান্ডে রাখতে চেয়েছিলে? তোমার এই অবৈধ অর্থের দায় আমি নিতে পারব না। এই বলে সে বেরিয়ে গেল। হতবাক মা পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ডাকতে শুরু করলেন, বাবা ফিরে আয়- ফিরে আয়। এক বন্ধুর গাড়ি করে সে এসেছিল সেই বন্ধুর গাড়ি করেই ফিরে গেল। পরবর্তীকালে ঐ পিতার সঙ্গে তার আর সন্ধি হয়েছিল কি না জানি না। তবে ঐ পিতার টাকা পাঠাতে কোনো অসুবিধা হয়নি কারণ এক অপদার্থ ভাগনেকে তিনি ইংল্যান্ড পাঠিয়ে টাকা পাচারের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের বড়লোকদের বাইরে টাকা পাঠানো, বাড়িঘর কেনা এবং দেশে তার ব্যক্তিগত সংকট বা রাজনৈতিক সংকটে পাড়ি জমানোর বিষয়টি আজ আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। ঘুষের টাকা বিদেশে লেনদেনের একটা ব্যবস্থা বহুদিন ধরেই গড়ে উঠেছে। অর্থ এখন বিত্তবানদের কাছে একটা নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাজনীতি করেন তাদের কাছেও ক্ষমতার পালাবদলের শঙ্কা আছে এবং পালাবদলের পরে এই অর্থই তাদের নিরাপত্তা দেবে এ ভাবনা একেবারেই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে। অবৈধ অর্থ কামানোর বিষয়টি আবার ব্যবসায়ীদের কাছে অন্যরকম। সেটা হচ্ছে মওকা পেলেই দ্রুত কামাও। পেঁয়াজের ব্যবসা করে ইতিমধ্যেই শত কোটি কোটি টাকা যে তারা উপার্জন করে ফেলেছে এটা আমরা সাধারণ মানুষরা কল্পনাও করতে পারি না। লবণ সংকট সৃষ্টি করে চার ঘণ্টার টেস্ট কেইস করেছিল, এটায় ব্যর্থ হয়ে পার্শ্বপপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চালসহ অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব ক্ষমতাবান যখন এগুলো পারে না তখন তারা সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ওপর নজর দেয়। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা শুরু করে। এবং পরিশোধের সময় নানা ধরনের কালক্ষেপণের উদাহরণ আছে। যার একটির নাম ‘রি-শিডিউল’। মাঝে মাঝেই ব্যাংক কতৃ©পক্ষ এই টাকা আদায়ের চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না জনগণের টাকা দিয়ে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপনই করে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে একজন ব্যবসায়ী নেতা ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া মানে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। সেই ঝাঁপিয়ে পড়ার মহোৎসবে আমরা প্রত্যক্ষ করছি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ভোগ্যপণ্য নিয়ে আসা হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কারণ টাকা বানানোর রোগে আক্রান্ত ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। এই রোগ সারানো খুব কঠিন। যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াতে হবে সেই সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়ে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মাঝে মাঝে খুব হাস্যকর সেস্নাগান দিয়ে থাকে যেমন– ‘দুর্নীতিকে এখনই না বলুন’। যে ঐ রোগে আক্রান্ত তার পক্ষে বা তাকে দিয়ে সত্যিকার অর্থে না বলানো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সেই লোকগুলো সভা-সমিতিতে সর্বত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছে।
একবার এক সরকারি অফিসে একটি কাজে গিয়েছিলাম। অফিসারটি বাংলাদেশের দুর্নীতির কারণ ও দুর্নীতি রোধের কী উপায় এবং দুর্নীতির জন্য কত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সবকিছুর বয়ান দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমার ছোট্ট কাজটি হলো না। বাইরে বেরিয়ে এসে যখন আমি হতাশ তখন একজন পিয়ন এসে বলল, পাঁচশোটি টাকা না হলে ঐ কাজ তো হবে না। আমি বললাম, অফিসারটি তো ভীষণ নীতিকথা বললেন– সে কি টাকা নেবে? ঐ নীতিকথার জন্যই আপনাকে এখন পাঁচশো টাকা দিতে হচ্ছে, আগে এখানে একশ টাকা দিলেই চলত। বর্তমান আমলেই সরকারি চাকুরেদর বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে এই ভাবনায় যে বেতন বেশি পেলে আর দুর্নীতি হবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘুষও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমি এর সমাধান জানি না, তবে দেশের নাগরিকদের নৈতিক মানের উন্নতি হলেই এসব সম্ভব। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিপর্যয় হয়ে গেছে তাতে নৈতিক উন্নতি আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবুও আশা করব এই ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন ঘটবেই। কারণ একসময় চাটার দল ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়বে। পরবর্তী প্রজন্ম এই পাপের দায় নেবে না।
লেখক
নাট্যকার ও অভিনেতা, কলামনিস্ট
[email protected]
শেয়ার করুন
মামুনুর রশীদ | ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০

প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যথার্থই বলেছেন, ‘অবৈধ টাকায় বিরিয়ানির চেয়ে সাদাসিধে জীবন ভালো’। এ কথাটি তিনি তার বহুবছরের অভিজ্ঞতার আলোকেই বলেছেন। তার পিতা বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, চাটার দল সব চেটেপুটে খেয়ে নিল। এ উক্তিটি তিনি করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর তার কন্যাও একই ধরনের উক্তি করলেন। ইতিমধ্যে ঐ চাটার দল নানাভাবে পুষ্ট হয়ে বিভিন্ন কৌশলে বিরামহীনভাবে চেটেপুটে খেয়েছে। সাম্পªতিক কালে প্রধানমন্ত্রী যে অভিযান শুরু করেছেন তাতে একদিক থেকে আমরা আশান্বিত হয়েছি আবার অন্যদিকে খুবই হতাশ হয়েছি। কারণ এই বার্তাটি কোথাও পৌঁছাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সন্দিহান হচ্ছি। বিভিন্ন সংগঠনের প্রধানদের বিরুদ্ধে যে অভিযান তিনি চালাচ্ছেন তাতে সংগঠনগুলোর মধ্যে আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একটা ঝাঁকি লেগে ভয় পাওয়ার বিষয় ছিল। কিন্তু তা কী হয়েছে? দায়িত্বহীন আচরণের জন্য সেদিন ওসি মোয়াজ্জেমের আট বছরের জেল ও দশ লক্ষ টাকা জরিমানা হলো। আশা করা যায় পুলিশ বাহিনী এই বিচারের পর আর কোনো দায়িত্বহীন আচরণ করবে না। ছাত্রলীগও সব জায়গায় সাবধান হয়ে যাবে। কিন্তু বুয়েটে আবরার হত্যার পর প্রমাণ হলো এই বার্তাটি ওখানে পৌঁছায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো কোনো উপাচার্যের আচরণেও বিষয়টি বোঝা যায়।
প্রধানমন্ত্রী এও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তার কাছে সবার আমলনামাই আছে। তাহলে ব্যবসায়ীরা সম্পªতি পেঁয়াজ এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে ঘটনা ঘটাচ্ছে তা কী করে সম্ভব হচ্ছে? আসলে আরেক জায়গায় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তাও সত্যি। তিনি বলেছেন টাকা বানানো একটা রোগ, অসুস্থতা। এই রোগে ১৯৭৪ সাল থেকে এ যাবৎ লক্ষ লক্ষ লোক আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষমতার অপর নাম যেন অর্থ উপার্জন। এই রোগে যারা একবার আক্রান্ত হয়েছে তাদের নিরাময় অসম্ভব। কারণ স্বচ্ছতার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা থাকা দরকার তা আমাদের আইন-কানুনে নেই। এখানে টাকা পাচার করা খুবই সহজ। ডলারের বাজার উন্মুক্ত। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা খুবই প্রতাপশালী। কোটি কোটি টাকা প্রতিদিন বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে লেখাপড়া করে। এই টাকা বৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর কোনো আইন নেই। তাহলে টাকা যাচ্ছে কী করে? এটাও বিচারের বিষয় যাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়ে তাদের বৈধ আয়ের পরিমাণ কত? এই টাকা দিয়ে নিজে দেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেও কী করে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য বিদেশে বিপুল টাকা পাঠানো সম্ভব?
১৯৮৫ সালে আমি কিছুদিন মুম্বাইয়ে ছিলাম। মুম্বাইয়ের বিমান অফিসে গিয়ে বসে থাকতাম। ম্যানেজার ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু বেচারার নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল ভিআইপি ডিউটি করতে করতে। ডেপুটি সেক্রেটারি থেকে শুরু করে সচিব, মন্ত্রী সবাইকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে হতো। ঢাকা থেকে ফ্লাইটটি মুম্বাই পৌঁছাত রাত ৪টার দিকে। তাদের রিসিভ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যেত। তারপর দিনের বেলায় বিভিন্ন কনভেন্ট ও স্কুলে ছাত্র ও অভিভাবকদের পাঠিয়ে দিয়ে ঘুম জড়িত চোখে অফিসে আসতেন দুপুর নাগাদ। বারবার বলতেন– এ চাকরি তার আর ভালো লাগছে না। তেমনি দেখেছি পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাঙালি ট্রাভেল এজেন্টদের অফিসে অভিভাবকদের ভিড়। তাদের সন্তানেরা সেখানে পড়ালেখা করছে এবং হুন্ডির দালালরা আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাত্র স্কলারশিপ নিয়ে যারা বিদেশে যায় সেইসব ছাত্রছাত্রীর ড়্গেত্রে এসবের বালাই নেই। কিন্তু অধিকাংশ ড়্গেত্রে বিত্তবান লোকরা দেশে ও বিদেশে ডিগ্রি কিনতে চায়। তাই সন্তানের মেধাকে লালন না করে শুধু সার্টিফিকেট কেনায় ব্যস্ত থাকে। পরিশেষে একটি অধঃপতিত মানুষ হিসেবে সন্তানটি বড় হয়। যারা অধঃপতিত হয় না তাদের একটি সত্য ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কোনো এক উচ্চপদস্থ আমলা তার ছেলেকে ইংল্যান্ডে পড়ালেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন। প্রতি মাসে তার খরচ পাঠাতেন হুন্ডির মাধ্যমে। খরচের বাইরেও বেশ কিছু টাকা তিনি পাঠাতেন। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর ছেলেটি দেশে ফিরে আসতে চাইল। কিন্তু তার বাবা তাকে ওখানেই থাকতে বলেন। সে কিছুতেই রাজি হয় না কারণ ইতিমধ্যেই সে বাংলাদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি পেয়ে গেছে। একদিন সে দেশে এসে বিমানবন্দরে নামল, বিমানবন্দরে তাকে নেওয়ার জন্য কেউ এলো না। সরাসরি সে বাসায় এসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। বাবা অফিস সেরে ড়্গিপ্ত হয়ে ঘরে ঢzকলেন। ছেলেও ড়্গিপ্ত হয়ে ছিল। বাবাকে সরাসরি বলে ফেলল– তুমি মানি লন্ডারিং করতে আমাকে ইংল্যান্ডে রাখতে চেয়েছিলে? তোমার এই অবৈধ অর্থের দায় আমি নিতে পারব না। এই বলে সে বেরিয়ে গেল। হতবাক মা পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ডাকতে শুরু করলেন, বাবা ফিরে আয়- ফিরে আয়। এক বন্ধুর গাড়ি করে সে এসেছিল সেই বন্ধুর গাড়ি করেই ফিরে গেল। পরবর্তীকালে ঐ পিতার সঙ্গে তার আর সন্ধি হয়েছিল কি না জানি না। তবে ঐ পিতার টাকা পাঠাতে কোনো অসুবিধা হয়নি কারণ এক অপদার্থ ভাগনেকে তিনি ইংল্যান্ড পাঠিয়ে টাকা পাচারের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের বড়লোকদের বাইরে টাকা পাঠানো, বাড়িঘর কেনা এবং দেশে তার ব্যক্তিগত সংকট বা রাজনৈতিক সংকটে পাড়ি জমানোর বিষয়টি আজ আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। ঘুষের টাকা বিদেশে লেনদেনের একটা ব্যবস্থা বহুদিন ধরেই গড়ে উঠেছে। অর্থ এখন বিত্তবানদের কাছে একটা নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাজনীতি করেন তাদের কাছেও ক্ষমতার পালাবদলের শঙ্কা আছে এবং পালাবদলের পরে এই অর্থই তাদের নিরাপত্তা দেবে এ ভাবনা একেবারেই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে। অবৈধ অর্থ কামানোর বিষয়টি আবার ব্যবসায়ীদের কাছে অন্যরকম। সেটা হচ্ছে মওকা পেলেই দ্রুত কামাও। পেঁয়াজের ব্যবসা করে ইতিমধ্যেই শত কোটি কোটি টাকা যে তারা উপার্জন করে ফেলেছে এটা আমরা সাধারণ মানুষরা কল্পনাও করতে পারি না। লবণ সংকট সৃষ্টি করে চার ঘণ্টার টেস্ট কেইস করেছিল, এটায় ব্যর্থ হয়ে পার্শ্বপপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চালসহ অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব ক্ষমতাবান যখন এগুলো পারে না তখন তারা সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ওপর নজর দেয়। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা শুরু করে। এবং পরিশোধের সময় নানা ধরনের কালক্ষেপণের উদাহরণ আছে। যার একটির নাম ‘রি-শিডিউল’। মাঝে মাঝেই ব্যাংক কতৃ©পক্ষ এই টাকা আদায়ের চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না জনগণের টাকা দিয়ে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপনই করে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে একজন ব্যবসায়ী নেতা ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া মানে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। সেই ঝাঁপিয়ে পড়ার মহোৎসবে আমরা প্রত্যক্ষ করছি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ভোগ্যপণ্য নিয়ে আসা হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কারণ টাকা বানানোর রোগে আক্রান্ত ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। এই রোগ সারানো খুব কঠিন। যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াতে হবে সেই সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়ে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মাঝে মাঝে খুব হাস্যকর সেস্নাগান দিয়ে থাকে যেমন– ‘দুর্নীতিকে এখনই না বলুন’। যে ঐ রোগে আক্রান্ত তার পক্ষে বা তাকে দিয়ে সত্যিকার অর্থে না বলানো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সেই লোকগুলো সভা-সমিতিতে সর্বত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছে।
একবার এক সরকারি অফিসে একটি কাজে গিয়েছিলাম। অফিসারটি বাংলাদেশের দুর্নীতির কারণ ও দুর্নীতি রোধের কী উপায় এবং দুর্নীতির জন্য কত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সবকিছুর বয়ান দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমার ছোট্ট কাজটি হলো না। বাইরে বেরিয়ে এসে যখন আমি হতাশ তখন একজন পিয়ন এসে বলল, পাঁচশোটি টাকা না হলে ঐ কাজ তো হবে না। আমি বললাম, অফিসারটি তো ভীষণ নীতিকথা বললেন– সে কি টাকা নেবে? ঐ নীতিকথার জন্যই আপনাকে এখন পাঁচশো টাকা দিতে হচ্ছে, আগে এখানে একশ টাকা দিলেই চলত। বর্তমান আমলেই সরকারি চাকুরেদর বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে এই ভাবনায় যে বেতন বেশি পেলে আর দুর্নীতি হবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘুষও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমি এর সমাধান জানি না, তবে দেশের নাগরিকদের নৈতিক মানের উন্নতি হলেই এসব সম্ভব। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিপর্যয় হয়ে গেছে তাতে নৈতিক উন্নতি আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবুও আশা করব এই ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন ঘটবেই। কারণ একসময় চাটার দল ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়বে। পরবর্তী প্রজন্ম এই পাপের দায় নেবে না। লেখক নাট্যকার ও অভিনেতা, কলামনিস্ট [email protected]