কামরুলের রেখার শক্তি ও চিত্রভাষার রূপান্তর
মোস্তফা জামান | ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
১. আঁকিয়ে কামরুল হাসান পটুয়া হিসেবে বহুল পরিচিত। শহুরে শিল্পীর গ্রামীণ নাম ধারণের সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান ছাড়াই গণমানসে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যা জরুরি, তা এই শিল্পীর সার্বিক মূল্যায়ন। কামরুলের অনন্য ব্যক্তিত্ব, তার রেখানির্ভর ছবির অভিব্যক্তিময়তা, জাতীয় সংগ্রামে শামিল হয়ে সমাজ পরিবর্তনে তার ভূমিকা এসবই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাকে তারকাখ্যাতি দিয়েছে। অথচ তার মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পরও এমন কোনো প্রদর্শনীর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি, যার মধ্য দিয়ে তার শিল্পী-সত্তার সামগ্রিক একটি চেহারা জনসমক্ষে হাজির করা যায়।
কামরুলের চিত্রকর্ম ও জীবন নিয়ে বইপত্রের সংখ্যা সামান্য। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আজিজুল হক ও নিসার হোসেন বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে বয়ান রচনার উদ্যোগী হয়েছেন। বোরহান উদ্দিন যদি তার স্বভাবসুলভ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে কিছুটা আলোকিত করেছেন শিল্পীর কর্মের তাৎপর্যের পরিসর, আজিজুল হক জীবন-বৃত্তান্তের দিকটি নিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন, প্রকাশ করেছেন মনোগ্রাফ। আজিজুল হক শিল্পকলা একাডেমিকৃত আধুনিক শিল্পী সিরিজের কামরুল হাসানের ওপর প্রকাশিত বইটিরও লেখক। এটি নানা প্রকারের স্কেচ, জলরং, তেলরং ও ছাপছবিতে সাজানো। এর বিক্ষিপ্ত রূপ শিল্পীর স্টাইলের অর্জন ধর্তব্যে না নিয়ে বিনা লজিকে ছবি সাজানোর কারণে সৃষ্ট। কামরুলের শত শত ড্রইংয়ের মধ্য দিয়ে তার ভাষার বিকাশ যে অব্যাহত ছিল, তেমন কোনো কালি-তুলির শক্তিশালী নমুনা বা তার উল্লেখ এ বইয়ে নেই। আরও যা বাদ পড়েছে তা তার রাজনৈতিক চিত্রকল্প গঠনে পিকাসোর বিমানবিকীরণ প্রক্রিয়া ও লোকশিল্পের, বিশেষ করে সরাচিত্রের সহজ অথচ শৈল্পিক শক্তিমত্তা প্রকাশকারী আকস্মিক সৃষ্ট রেখানির্ভর অঙ্কনের মিশ্রণে আঁকা তেলচিত্রগুলো। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে এ রকম বেশ কটি ক্যানভাস ২০০৮ সালে আয়োজিত বিশেষ একটি প্রদর্শনীতে দর্শকের সামনে হাজির করা হয়। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাদুঘরে রাখা এই মাস্টারপিসগুলো অন্তত শিল্পমোদীদের মনে নাড়া দেওয়ার সুযোগ পায়। এই আয়োজন ছিল দুই বাংলার আধুনিক শিল্পের স্থানিক মাত্রা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পীদের একটি যৌথ প্রদর্শনীর। যামিনী রায় থেকে শুরু করে জয়নুল, এস এম সুলতান ও রশিদ চৌধুরীর কিছু অসাধারণ কাজ ও এই বিশেষ প্রদর্শনীর অংশ ছিল। প্রদর্শনী উপলক্ষে যে ক্যাটালগটি ছাপা হয়, তাতে শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম কামরুল হাসানকে ‘সহজাত ও সার্থক শিল্পী’ হিসেবে আখ্যা দেন। কামরুলকে লেখক ‘আবিষ্কার উদ্ভাবনার তাড়না’র সূত্রেও মূল্যায়ন করেছেন। তাৎক্ষণিকতা ও অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ততা চিহ্নিত করে শিল্পীর আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও জীবনের গূঢ় তাগিদের কথাও লেখক বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তি শিল্পীর চরিত্র ধরা দেয়, যা তার জীবন ও কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিল্পী হিসেবে কামরুল হাসানের লীলাময়তার দিকটি এখানে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
২. কামরুল হাসানের কাজ আপাতদৃষ্টিতে বিষয়নির্ভর মনে হয়। গ্রামীণ পটভূমিতে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি চাক্ষুষ করে তুলেছেন। জয়নুলের মতো তিনিও জ্যামিতিক বিন্যাসের কাছাকাছি গিয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থিতু হননি। যদি ১৯৪০-এর দশকে অবয়ব হৃদ্যকরণে মন দেন, তা ছিল তার পূর্ববর্তী শিল্পীদের পরম্পরানির্ভর। এমনকি যে পুতুল তৈরির কারখানায় তিনি দুই বছর চোখ এঁকে হাত পাকিয়েছেন, তেমন অভিজ্ঞতা তিনি চিত্রকল্প নির্মাণে ব্যয় করেছেন। ১৯৫০-এর আঁকা মাছ ধরা ইলাস্ট্রেশনের ভঙ্গিতে যে দুই গ্রামীণ বালককে উপস্থাপন করতে দেখা যায়, তার মধ্যে এক ধরনের শিল্পজ দস্তখত স্পষ্ট হয়। সোজা রেখায়, সমান আঙুল এঁকে হাত-পা দেহ বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে ও বাস্তব দৃশ্যের খোঁজ দেওয়ার পদ্ধতিটা নতুন। তরুণ কামরুলের কাজে এই ম্যানার বা স্বতন্ত্র-বৈশিষ্ট্য রচনার প্রয়াস তার পূর্ববতী চেষ্টা থেকে আলাদা বলে চিহ্নিত করা চলে। তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একরৈখিক জীবনাচরণ সম্ভবপর হয়নি। জালাল উদ্দিন আহমেদ তার ‘আর্ট ইন পাকিস্তান’ বইয়ে (করাচি ১৯৫৪) শিল্পীর যে পরিচিতি লিখেছেন সেখানে তার শিক্ষায় ছেদ পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৮-এ কলকাতা আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে দুবছরের মাথায় কামরুল পড়াশোনা বাদ দিয়ে রোজগারে মন দিতে বাধ্য হন। তিন বছর এভাবে কেটে যায়, কিন্তু এ সময়কাল নতুনতর অভিজ্ঞতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তরুণ কামরুল পুতুল বানানোর কারখানায় চাইনিজ লেখার ব্যবহার করে পুতুলের চোখের মণি, পাপড়ি ও ঠোঁট এঁকে হাত পাকান। জালাল উদ্দিনের ব্যবহৃত শিল্পীর বয়ান অনুবাদ করলে এমনটা দাঁড়ায় : ‘পোড়া মাটির দলা যখন আমার তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠল, তখনই আমার শিল্পের অসীম শক্তি বিষয়ে চৈতন্য হলো।’
কেন শিল্পী কামরুল হাসান নাগরিক হয়ে নাইওর আঁকেন, গ্রাম্যবধূর লাস্যময় উপস্থিতি তুলে ধরেন? বোরহান উদ্দিন ‘কামরুল হাসান’ শিরোনামের বইয়ে কামরুলের গ্রামপ্রীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রশ্ন তোলার ভঙ্গিতে তিনি এ বিষয়ের সুরাহা করেছেন। শিল্পী কি ঐতিহ্যের সন্ধানে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, নাকি ওটা তার সংগ্রামের অংশবিশেষ : তিনি কি রিট্রিটের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেন? সত্যিকার অর্থেই নাগরিক সমাজের মধ্যে যে মানবদেহ ও আত্মার বিনাশ কামরুল সেই মানবদেহ ও আত্মার পুনরুজ্জীবনের পথে দৃঢ়চিত্ত সৈনিক বিশেষ। তার সৈনিকতায় ললিত ভাব, দ্রোহ, প্রেমভাষা ও মানবমুক্তির আশা সমভাবে বিরাজ করেছে। কামরুল পটশৈলীর শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হলেন ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে। শিল্পশিক্ষার কাঠামো থেকে তিনি প্রথম নিজস্ব রীতির প্রয়োগে প্রশংসিত হলেন। সৈয়দ আজিজুল হকের কামরুল হাসান : জীবন ও কর্ম (১৯৯৮) বইয়ে শিল্পীর ভাষা তৈরির প্রথম পর্বের খোঁজ মেলে।
৩. কামরুলের পটশৈলীর প্রতি আকর্ষণ হঠাৎ তৈরি হয়নি। তার কলকাতার জীবনে এর নাতিদীর্ঘ পরম্পরা বিদ্যমান। প্রথম যে শিল্পী দরবারি ও ক্ল্যাসিকধর্মিতার পাশাপাশি গ্রামীণ বা লোকজ চিত্রের শৈলীর আভাস দেন, তিনি নন্দলাল বসু। তার হরিপুরা পোস্টার প্রথম দেশজ চরিত্র নির্মাণের নমুনা না, কিন্তু এমনতর দেশজ চরিত্রে উচ্চতামুখীনতার বদলে আনুভূমিক দিকে যাত্রার প্রথম লক্ষণ দেখা যায়। পটশৈলীর সঙ্গে কামরুলের সন্ধির শুরু যদি ১৯৪৬-এ, লোকপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এর মূল্যায়ন জরুরি। বাঙালির জাগরণে আরও নানা প্রকল্পের মধ্যে ব্রতচারী আন্দোলন একটি। ১৯৩৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কামরুল যুগসন্ধিলগ্নের ‘একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান বাঙালির’ সাক্ষাৎ পেলেন। কামরুলের ভাষায়, ‘বাংলার অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মনমানসিকতার এবং শৌর্য-বীর্যের গৌরবময় ইতিহাস যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল।’ (কামরুল : বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথা)।
ব্রতচারী শিবিরের হাইব্রিড চরিত্র অনিবার্য ছিল। এটি মূলত একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন, যাতে ঐতিহ্যের সুনির্দিষ্ট কিছু দিকে মনোযোগী হওয়ার পথনির্দেশনা পেয়েছে সেদিনের নতুন প্রজন্ম। রায়বেঁশে নৃত্যের পুনরুত্থান গুরুসদয় দত্তের সূত্রেই সম্ভব হয়েছিল। কামরুলের প্রস্তুতিপর্বে এই নাচ বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানে যে বিষয়টি কামরুলের শিল্পীজীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল, গ্রামীণ শিল্পী মটরুর ছবির সঙ্গে পরিচয়। শিল্পী মটরু ব্রতচারী শিবিরে অংশগ্রহণ করায় কামরুল এ অঞ্চলের রেখা প্রধান কাজের নমুনার সাক্ষাৎ পেলেন। পটুয়া মটরু তরুণ শিক্ষানবিস কামরুলের ‘ভিক্টোরিয়ান পদ্ধতির’ প্রাসাদের দুয়ার ভেঙে দিতে সাহায্য করেছেন। মটরু পটুয়ার চিত্রকর্ম দেখিয়ে গুরুসদয় দত্ত কামরুল হাসানকে বলেছিলেন, ‘হাসান, আর্ট স্কুলে যা শিখছো সেটাও বহু মূল্যবান বস্তু। তবে অতিবস্তুবাদ, তার মধ্যে হীরা-জহরত অনেক আছে, বস্তুবাদ বলেই পশ্চিমের শিল্পীরা সরাসরি চোখের দৃষ্টিতে যা দেখে তা-ই আঁকে, কিন্তু আমাদের এই শিল্পীরা অন্তর দৃষ্টি দিয়ে সব দেখে। এ দেখা এরা জন্মকাল থেকেই দেখে আসছে। গ্রামের সহজ-সরল গানের মতোই এদের রং ও রেখার ভাষা।’ (সৈয়দ আজিজুল হক : ১৯৯৯)
পটচিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, পিকাসোর অভিনবত্ব লক্ষ করে, চিত্র রচনায় আকস্মিকতার স্থান তিনি ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন। অথবা বলা যায়, আকস্মিকতার ফল লক্ষ করেই তিনি দুই আপাত বিপরীত ধারা থেকে অর্থাৎ পট ও ঘনবাদী ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চিত্রে ফর্ম বা রূপের সুরাহা করতে পেরেছেন। গ্রামীণ পটের আকস্মিকতা আর প্যারিসবাসী শিল্পী পিকাসোর কাজের আকস্মিকতার সার্থক প্রয়োগ তার নানা চিত্রের রাজনৈতিক ও স্থানিক মাত্রা অর্জনে সহায়ক হয়েছে। তেলরঙে করা চিত্র ‘নাইওর’ ও ১৯৮৩-র শুরুর দিকে আঁকা রাজনীতিক চিত্রকল্পে পিকাসোর শিক্ষাটা সবচেয়ে স্পষ্ট। অন্যরা যখন সিনথেটিক কিউবিজম থেকে জ্যামিতিক বিভাজন শিখে আধুনিক হওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কামরুল পিকাসোর একই মুখ নানা পরিপ্রেক্ষিতে দেখার লজিক গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ কম্পোজিশন তৈরির নিমিত্তে তিনি কোনো কিছু আমদানি করেননি, বরং মানব অবয়বের আকস্মিক ফুটে ওঠা ভিন্নতা নির্মাণ, কোনো মুহূর্তের অর্থবোধক ব্যাখ্যা বা এক্সপ্রেশন বা আকারায়ন তার উদ্দেশ্য ছিল।
সাংস্কৃতিক এই ব্যক্তিত্বের রেখা ও চিত্রকল্পের রাজনৈতিক যে চরিত্র, তার ব্যাখ্যায় নিজস্ব প্রয়োগের বিশেষ কিছু দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। রেখা কী করে জটিলতাপ্রবণ হয়ে ওঠে অর্থাৎ বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ে প্রতীকমুখী চিত্রকল্প গড়ে তোলে। একক মূর্তি থেকে শুরু করে বহুসংখ্যক মূর্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রেখাচিত্রে কামরুলের জটিলতার বিকাশ লক্ষণীয়। ১৯৭০ দশকের সমাজবাস্তবতার আকারায়ন ছাড়াও কেবল নারী, হাতি কিংবা পাখির চিত্রেও কামরুল অনেক সহজে জটিলতার বা বহুমাত্রিকতার জন্ম দিয়েছেন, যা তার চিত্রকল্পকে লোকজ চিত্রের সাধারণ অনুবাদ হওয়া থেকে উদ্ধার করেছে। এমনকি গ্রামীণ ধাঁচ আয়ত্ত করে শহুরে পরিশীলন অর্জনের যে কলকাতা ও ঢাকাকেন্দ্রিক নানা প্রয়াস, তার বিপরীতে ‘বর্তমান’ সময় ও ‘পরম্পরা’র ধারণার সমন্বয়ে ‘আগামী’র চিত্রভাষা নির্মাণে সাহায্য করেছে।
লেখক শিল্পী, শিল্প-সমালোচক ও অধুনালুপ্ত ইংরেজি আর্ট ম্যাগাজিন ‘ডেপার্ট’-এর সম্পাদক
শেয়ার করুন
মোস্তফা জামান | ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

১. আঁকিয়ে কামরুল হাসান পটুয়া হিসেবে বহুল পরিচিত। শহুরে শিল্পীর গ্রামীণ নাম ধারণের সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান ছাড়াই গণমানসে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যা জরুরি, তা এই শিল্পীর সার্বিক মূল্যায়ন। কামরুলের অনন্য ব্যক্তিত্ব, তার রেখানির্ভর ছবির অভিব্যক্তিময়তা, জাতীয় সংগ্রামে শামিল হয়ে সমাজ পরিবর্তনে তার ভূমিকা এসবই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাকে তারকাখ্যাতি দিয়েছে। অথচ তার মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পরও এমন কোনো প্রদর্শনীর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি, যার মধ্য দিয়ে তার শিল্পী-সত্তার সামগ্রিক একটি চেহারা জনসমক্ষে হাজির করা যায়।
কামরুলের চিত্রকর্ম ও জীবন নিয়ে বইপত্রের সংখ্যা সামান্য। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আজিজুল হক ও নিসার হোসেন বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে বয়ান রচনার উদ্যোগী হয়েছেন। বোরহান উদ্দিন যদি তার স্বভাবসুলভ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে কিছুটা আলোকিত করেছেন শিল্পীর কর্মের তাৎপর্যের পরিসর, আজিজুল হক জীবন-বৃত্তান্তের দিকটি নিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন, প্রকাশ করেছেন মনোগ্রাফ। আজিজুল হক শিল্পকলা একাডেমিকৃত আধুনিক শিল্পী সিরিজের কামরুল হাসানের ওপর প্রকাশিত বইটিরও লেখক। এটি নানা প্রকারের স্কেচ, জলরং, তেলরং ও ছাপছবিতে সাজানো। এর বিক্ষিপ্ত রূপ শিল্পীর স্টাইলের অর্জন ধর্তব্যে না নিয়ে বিনা লজিকে ছবি সাজানোর কারণে সৃষ্ট। কামরুলের শত শত ড্রইংয়ের মধ্য দিয়ে তার ভাষার বিকাশ যে অব্যাহত ছিল, তেমন কোনো কালি-তুলির শক্তিশালী নমুনা বা তার উল্লেখ এ বইয়ে নেই। আরও যা বাদ পড়েছে তা তার রাজনৈতিক চিত্রকল্প গঠনে পিকাসোর বিমানবিকীরণ প্রক্রিয়া ও লোকশিল্পের, বিশেষ করে সরাচিত্রের সহজ অথচ শৈল্পিক শক্তিমত্তা প্রকাশকারী আকস্মিক সৃষ্ট রেখানির্ভর অঙ্কনের মিশ্রণে আঁকা তেলচিত্রগুলো। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে এ রকম বেশ কটি ক্যানভাস ২০০৮ সালে আয়োজিত বিশেষ একটি প্রদর্শনীতে দর্শকের সামনে হাজির করা হয়। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাদুঘরে রাখা এই মাস্টারপিসগুলো অন্তত শিল্পমোদীদের মনে নাড়া দেওয়ার সুযোগ পায়। এই আয়োজন ছিল দুই বাংলার আধুনিক শিল্পের স্থানিক মাত্রা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পীদের একটি যৌথ প্রদর্শনীর। যামিনী রায় থেকে শুরু করে জয়নুল, এস এম সুলতান ও রশিদ চৌধুরীর কিছু অসাধারণ কাজ ও এই বিশেষ প্রদর্শনীর অংশ ছিল। প্রদর্শনী উপলক্ষে যে ক্যাটালগটি ছাপা হয়, তাতে শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম কামরুল হাসানকে ‘সহজাত ও সার্থক শিল্পী’ হিসেবে আখ্যা দেন। কামরুলকে লেখক ‘আবিষ্কার উদ্ভাবনার তাড়না’র সূত্রেও মূল্যায়ন করেছেন। তাৎক্ষণিকতা ও অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ততা চিহ্নিত করে শিল্পীর আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও জীবনের গূঢ় তাগিদের কথাও লেখক বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তি শিল্পীর চরিত্র ধরা দেয়, যা তার জীবন ও কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিল্পী হিসেবে কামরুল হাসানের লীলাময়তার দিকটি এখানে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
২. কামরুল হাসানের কাজ আপাতদৃষ্টিতে বিষয়নির্ভর মনে হয়। গ্রামীণ পটভূমিতে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি চাক্ষুষ করে তুলেছেন। জয়নুলের মতো তিনিও জ্যামিতিক বিন্যাসের কাছাকাছি গিয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থিতু হননি। যদি ১৯৪০-এর দশকে অবয়ব হৃদ্যকরণে মন দেন, তা ছিল তার পূর্ববর্তী শিল্পীদের পরম্পরানির্ভর। এমনকি যে পুতুল তৈরির কারখানায় তিনি দুই বছর চোখ এঁকে হাত পাকিয়েছেন, তেমন অভিজ্ঞতা তিনি চিত্রকল্প নির্মাণে ব্যয় করেছেন। ১৯৫০-এর আঁকা মাছ ধরা ইলাস্ট্রেশনের ভঙ্গিতে যে দুই গ্রামীণ বালককে উপস্থাপন করতে দেখা যায়, তার মধ্যে এক ধরনের শিল্পজ দস্তখত স্পষ্ট হয়। সোজা রেখায়, সমান আঙুল এঁকে হাত-পা দেহ বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে ও বাস্তব দৃশ্যের খোঁজ দেওয়ার পদ্ধতিটা নতুন। তরুণ কামরুলের কাজে এই ম্যানার বা স্বতন্ত্র-বৈশিষ্ট্য রচনার প্রয়াস তার পূর্ববতী চেষ্টা থেকে আলাদা বলে চিহ্নিত করা চলে। তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একরৈখিক জীবনাচরণ সম্ভবপর হয়নি। জালাল উদ্দিন আহমেদ তার ‘আর্ট ইন পাকিস্তান’ বইয়ে (করাচি ১৯৫৪) শিল্পীর যে পরিচিতি লিখেছেন সেখানে তার শিক্ষায় ছেদ পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৮-এ কলকাতা আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে দুবছরের মাথায় কামরুল পড়াশোনা বাদ দিয়ে রোজগারে মন দিতে বাধ্য হন। তিন বছর এভাবে কেটে যায়, কিন্তু এ সময়কাল নতুনতর অভিজ্ঞতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তরুণ কামরুল পুতুল বানানোর কারখানায় চাইনিজ লেখার ব্যবহার করে পুতুলের চোখের মণি, পাপড়ি ও ঠোঁট এঁকে হাত পাকান। জালাল উদ্দিনের ব্যবহৃত শিল্পীর বয়ান অনুবাদ করলে এমনটা দাঁড়ায় : ‘পোড়া মাটির দলা যখন আমার তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠল, তখনই আমার শিল্পের অসীম শক্তি বিষয়ে চৈতন্য হলো।’
কেন শিল্পী কামরুল হাসান নাগরিক হয়ে নাইওর আঁকেন, গ্রাম্যবধূর লাস্যময় উপস্থিতি তুলে ধরেন? বোরহান উদ্দিন ‘কামরুল হাসান’ শিরোনামের বইয়ে কামরুলের গ্রামপ্রীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রশ্ন তোলার ভঙ্গিতে তিনি এ বিষয়ের সুরাহা করেছেন। শিল্পী কি ঐতিহ্যের সন্ধানে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, নাকি ওটা তার সংগ্রামের অংশবিশেষ : তিনি কি রিট্রিটের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেন? সত্যিকার অর্থেই নাগরিক সমাজের মধ্যে যে মানবদেহ ও আত্মার বিনাশ কামরুল সেই মানবদেহ ও আত্মার পুনরুজ্জীবনের পথে দৃঢ়চিত্ত সৈনিক বিশেষ। তার সৈনিকতায় ললিত ভাব, দ্রোহ, প্রেমভাষা ও মানবমুক্তির আশা সমভাবে বিরাজ করেছে। কামরুল পটশৈলীর শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হলেন ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে। শিল্পশিক্ষার কাঠামো থেকে তিনি প্রথম নিজস্ব রীতির প্রয়োগে প্রশংসিত হলেন। সৈয়দ আজিজুল হকের কামরুল হাসান : জীবন ও কর্ম (১৯৯৮) বইয়ে শিল্পীর ভাষা তৈরির প্রথম পর্বের খোঁজ মেলে।
৩. কামরুলের পটশৈলীর প্রতি আকর্ষণ হঠাৎ তৈরি হয়নি। তার কলকাতার জীবনে এর নাতিদীর্ঘ পরম্পরা বিদ্যমান। প্রথম যে শিল্পী দরবারি ও ক্ল্যাসিকধর্মিতার পাশাপাশি গ্রামীণ বা লোকজ চিত্রের শৈলীর আভাস দেন, তিনি নন্দলাল বসু। তার হরিপুরা পোস্টার প্রথম দেশজ চরিত্র নির্মাণের নমুনা না, কিন্তু এমনতর দেশজ চরিত্রে উচ্চতামুখীনতার বদলে আনুভূমিক দিকে যাত্রার প্রথম লক্ষণ দেখা যায়। পটশৈলীর সঙ্গে কামরুলের সন্ধির শুরু যদি ১৯৪৬-এ, লোকপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এর মূল্যায়ন জরুরি। বাঙালির জাগরণে আরও নানা প্রকল্পের মধ্যে ব্রতচারী আন্দোলন একটি। ১৯৩৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কামরুল যুগসন্ধিলগ্নের ‘একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান বাঙালির’ সাক্ষাৎ পেলেন। কামরুলের ভাষায়, ‘বাংলার অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মনমানসিকতার এবং শৌর্য-বীর্যের গৌরবময় ইতিহাস যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল।’ (কামরুল : বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথা)।
ব্রতচারী শিবিরের হাইব্রিড চরিত্র অনিবার্য ছিল। এটি মূলত একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন, যাতে ঐতিহ্যের সুনির্দিষ্ট কিছু দিকে মনোযোগী হওয়ার পথনির্দেশনা পেয়েছে সেদিনের নতুন প্রজন্ম। রায়বেঁশে নৃত্যের পুনরুত্থান গুরুসদয় দত্তের সূত্রেই সম্ভব হয়েছিল। কামরুলের প্রস্তুতিপর্বে এই নাচ বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানে যে বিষয়টি কামরুলের শিল্পীজীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল, গ্রামীণ শিল্পী মটরুর ছবির সঙ্গে পরিচয়। শিল্পী মটরু ব্রতচারী শিবিরে অংশগ্রহণ করায় কামরুল এ অঞ্চলের রেখা প্রধান কাজের নমুনার সাক্ষাৎ পেলেন। পটুয়া মটরু তরুণ শিক্ষানবিস কামরুলের ‘ভিক্টোরিয়ান পদ্ধতির’ প্রাসাদের দুয়ার ভেঙে দিতে সাহায্য করেছেন। মটরু পটুয়ার চিত্রকর্ম দেখিয়ে গুরুসদয় দত্ত কামরুল হাসানকে বলেছিলেন, ‘হাসান, আর্ট স্কুলে যা শিখছো সেটাও বহু মূল্যবান বস্তু। তবে অতিবস্তুবাদ, তার মধ্যে হীরা-জহরত অনেক আছে, বস্তুবাদ বলেই পশ্চিমের শিল্পীরা সরাসরি চোখের দৃষ্টিতে যা দেখে তা-ই আঁকে, কিন্তু আমাদের এই শিল্পীরা অন্তর দৃষ্টি দিয়ে সব দেখে। এ দেখা এরা জন্মকাল থেকেই দেখে আসছে। গ্রামের সহজ-সরল গানের মতোই এদের রং ও রেখার ভাষা।’ (সৈয়দ আজিজুল হক : ১৯৯৯)
পটচিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, পিকাসোর অভিনবত্ব লক্ষ করে, চিত্র রচনায় আকস্মিকতার স্থান তিনি ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন। অথবা বলা যায়, আকস্মিকতার ফল লক্ষ করেই তিনি দুই আপাত বিপরীত ধারা থেকে অর্থাৎ পট ও ঘনবাদী ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চিত্রে ফর্ম বা রূপের সুরাহা করতে পেরেছেন। গ্রামীণ পটের আকস্মিকতা আর প্যারিসবাসী শিল্পী পিকাসোর কাজের আকস্মিকতার সার্থক প্রয়োগ তার নানা চিত্রের রাজনৈতিক ও স্থানিক মাত্রা অর্জনে সহায়ক হয়েছে। তেলরঙে করা চিত্র ‘নাইওর’ ও ১৯৮৩-র শুরুর দিকে আঁকা রাজনীতিক চিত্রকল্পে পিকাসোর শিক্ষাটা সবচেয়ে স্পষ্ট। অন্যরা যখন সিনথেটিক কিউবিজম থেকে জ্যামিতিক বিভাজন শিখে আধুনিক হওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কামরুল পিকাসোর একই মুখ নানা পরিপ্রেক্ষিতে দেখার লজিক গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ কম্পোজিশন তৈরির নিমিত্তে তিনি কোনো কিছু আমদানি করেননি, বরং মানব অবয়বের আকস্মিক ফুটে ওঠা ভিন্নতা নির্মাণ, কোনো মুহূর্তের অর্থবোধক ব্যাখ্যা বা এক্সপ্রেশন বা আকারায়ন তার উদ্দেশ্য ছিল।
সাংস্কৃতিক এই ব্যক্তিত্বের রেখা ও চিত্রকল্পের রাজনৈতিক যে চরিত্র, তার ব্যাখ্যায় নিজস্ব প্রয়োগের বিশেষ কিছু দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। রেখা কী করে জটিলতাপ্রবণ হয়ে ওঠে অর্থাৎ বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ে প্রতীকমুখী চিত্রকল্প গড়ে তোলে। একক মূর্তি থেকে শুরু করে বহুসংখ্যক মূর্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রেখাচিত্রে কামরুলের জটিলতার বিকাশ লক্ষণীয়। ১৯৭০ দশকের সমাজবাস্তবতার আকারায়ন ছাড়াও কেবল নারী, হাতি কিংবা পাখির চিত্রেও কামরুল অনেক সহজে জটিলতার বা বহুমাত্রিকতার জন্ম দিয়েছেন, যা তার চিত্রকল্পকে লোকজ চিত্রের সাধারণ অনুবাদ হওয়া থেকে উদ্ধার করেছে। এমনকি গ্রামীণ ধাঁচ আয়ত্ত করে শহুরে পরিশীলন অর্জনের যে কলকাতা ও ঢাকাকেন্দ্রিক নানা প্রয়াস, তার বিপরীতে ‘বর্তমান’ সময় ও ‘পরম্পরা’র ধারণার সমন্বয়ে ‘আগামী’র চিত্রভাষা নির্মাণে সাহায্য করেছে।
লেখক শিল্পী, শিল্প-সমালোচক ও অধুনালুপ্ত ইংরেজি আর্ট ম্যাগাজিন ‘ডেপার্ট’-এর সম্পাদক