ডলার সংকটের আসল ঘটনা কী
রাজেকুজ্জামান রতন | ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০
যা ঘটে প্রকৃত ঘটনা তা নাও হতে পারে। যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতিদিন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে উচ্ছ্বাস এখন উৎকণ্ঠায় পরিণত হয়েছে, ফলে আশ্বাস দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে সরকারি মহল থেকে। কোনো সমস্যা নেই, পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আছে, তিন মাসের খাদ্য আমদানির মতো রিজার্ভ আছে এ রকম আশ্বাস যেমন দেওয়া হচ্ছে, তেমনি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে এই বলে, আগে কখনো কি এত রিজার্ভ ছিল? আর তুলনামূলক কথা বলতে পছন্দ করা কর্তারা বলছেন, পৃথিবীর অনেক দেশে এত দিন চলার মতো রিজার্ভ নেই, আমরা ভালো আছি ইত্যাদি।
কিন্তু মানুষ দেখছে ডলারের বাজার চড়া, প্রতিদিনই বাড়ছে দাম। বাজারে ১১২ টাকা পর্যন্ত উঠেছে ডলারের দাম। সরকারি দাম আর বাজারে বিক্রির মধ্যে ১৫ টাকার মতো পার্থক্য বলে ডলার নিয়ে ব্যবসাও হচ্ছে নানাভাবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে, বড় বড় গাড়ি কিনতে, বিলাসবহুল বাড়ির সরঞ্জাম কিনতে, ঈদ-পার্বণে বিদেশে শপিং করতে, খিচুড়ি রান্না বা পুকুর খননের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করতে হলে ডলার লাগবে। কিন্তু আমাদের দেশে ডলার আসে কীভাবে? একটা পথ হলো রপ্তানির মাধ্যমে, অন্যটা প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। আর ডলার প্রধানত খরচ হয় আমদানি করতে গিয়ে। আমাদের দেশে প্রধানত গার্মেন্টসের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, খাদ্য, গাড়ি আমদানি করতে ডলার খরচ করতে হয়। এই আমদানি-রপ্তানির ঘাটতিকে বলা হয় ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি। একটা সাধারণ হিসাব করে দেখা যাক! বলা হয়েছে, আমরা রপ্তানি করেছি ৫২.৫ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানি করেছি ৮৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ কমবেশি ৩৬ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি আছে। প্রবাসী শ্রমিকরা পাঠিয়েছেন ২২ বিলিয়ন ডলার। তাহলে সবশেষে ঘাটতি দাঁড়াল ১৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে রিজার্ভে তো টান পড়বেই।
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, খাদ্যের দাম বেড়েছে আর এসবের কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ। সমাধানের যুক্তি কী? আমাদের কিছু করার নেই। এই বাস্তবতা মানতেই হবে। খাদ্যপণ্যের দাম তাই বাড়ছে এবং বাড়বে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম শুধু বাড়বে তা-ই নয় আমাদের এখন ঋণ করতে হবে চড়া সুদে এবং কঠিন শর্তে। আমদানির কারণে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যাপারটা যদি তাই হয় তাহলে তো দাম বাড়ানো ও ঋণ করার বিকল্প নেই। কিন্তু ৩ আগস্ট ‘খাদ্য ও জ্বালানি আমদানি রিজার্ভকে চাপে ফেলেনি’ শীর্ষক বণিক বার্তার একটি রিপোর্ট দেখে বিষয়টাকে অন্যরকম মনে হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করা আমদানি পণ্যের কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী তৈরি করা বণিক বার্তার রিপোর্ট দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক খাদ্যপণ্য বা জ্বালানির মূল্যস্ফীতি নয় বরং ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতির কারণ অন্যত্র।
এত দিন একটা প্রশ্ন অনেকেরই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমদানি এত বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? আমদানি বেড়েছে না আমদানি ব্যয় বেড়েছে? ২০-২১ সালে আমদানি হয়েছে ৬৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.১৬ বিলিয়ন ডলারে। এই ২৩.৫৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি বাড়ার কারণ কী? এই কয়েক দিনের সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্য স্ফীতিই প্রধান কারণ। কিন্তু কাস্টমসের ডেটা অনুযায়ী ২০২১ থেকে অর্থবছর গত বছরে খাদ্যশস্যের আমদানি কমেছে ৪.৪ শতাংশ। এর মধ্যে গম আমদানির পরিমাণই বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬.৭ শতাংশ। কিন্তু চালের আমদানি কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ২০২১ সালে আমদানি হয়েছিল ২৬৮ কোটি ডলারের খাদ্যপণ্য আর গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ২৫৬ কোটি ডলার। ফলে খাদ্যশস্যের মোট আমদানির খরচ প্রায় ১২ কোটি ডলার কমেছে।
বলা হয়ে থাকে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ‘বিওপি’র ঘাটতি হয়েছে। কিন্তু কাস্টমস ডেটা অনুসারে অর্থবছর ২০২১-এর তুলনায় গত বছর ভোজ্য তেলের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য কিন্তু তার পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার। এ কথা সত্য, খাদ্যপণ্যের দাম ও আমদানি মূল্য বেড়েছে। শুধু ভোজ্য তেল নয়, দুধ, মসলা, ডাল ও চিনিসহ নন-গ্রেইন খাদ্যপণ্যের আমদানি মূল্যও বেড়েছে। প্রশ্ন হলো তা কতটা এবং তাতে কত বেশি খরচ হয়েছে? যদি চাল, ডাল, চিনি, তেল, মসলাসহ সব খাদ্যদ্রব্য আমদানি খরচ বিবেচনা করা হয়, তবে ২০২১ থেকে গত অর্থবছরে মাত্র ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যা মোট ঘাটতির মাত্র ৬ শতাংশ। এ বছরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশের ওপরে। তার অর্থ দাঁড়ায় ২০২২ সালে চাল আমদানি কম হয়েছে এবং এটা পরিষ্কার যে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিওপি ঘাটতিতে বড় ভূমিকা রাখেনি।
আবার যে কথা বলে প্রায় বিশ্বাস করিয়ে ফেলা হচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের সব দেশের মতো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ‘বিওপি’ ঘাটতি হয়েছে। কিন্তু তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। অর্থবছর ২০২১ থেকে গত বছরে পেট্রোলিয়াম আমদানির পরিমাণ তো বাড়েই নাই বরং আমদানি এক বিলিয়ন ডলার কমেছে, যেটা বিস্ময়কর। এর বিশ্বাসযোগ্য উত্তর যেটা হতে পারে যে, অর্থবছর ২০২১-এর স্টক বিপিসির কাছে রয়ে গিয়েছিল, তাই বিপিসি কম পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করেছে। ফলে, বিওটি বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকটে জ্বালানি তেলের কোনো ভূমিকা তো নেই বরং বিগত অর্থবছরে জ্বালানি তেল এক বিলিয়ন ডলার কম আমদানি হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে শুধু তেল তো একমাত্র জ্বালানি নয়, গ্যাসও একটি জ্বালানি এবং এর মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ৪০ ডলারে উঠেছে, এর প্রভাব কি পড়েনি? অবশ্যই পড়েছে, তবে যতটা ব্যাপক বলা হচ্ছে ততটা নয়। তথ্য দেখাচ্ছে, ২০২২ সালে এলএনজির কারণে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এলএনজিকে আদার ক্যাটাগরিতে দেখায়, যে ক্যাটাগরিতে আর কী কী পণ্য রয়েছে তা ঠিক উল্লেখ নেই। ফলে, জ্বালানি তেলের ১ বিলিয়ন ডলার আমদানি হ্রাস আর এলএনজির ১.৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বৃদ্ধিকে যোগ করলে দেখা যায় বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্যস্ফীতির প্রভাবে, সার্বিক জ্বালানি আমদানিতে ব্যালান্স অব পেমেন্টে মাত্র ০.৭ বিলিয়ন ডলার প্রভাব পড়েছে, যা মোট ঘাটতির মাত্র ২ শতাংশ।
তাহলে কিছুদিন ধরে যে হাহাকার ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে তার কারণ কি অন্য কিছু? কিন্তু বিওপি ঘাটতি যে হয়েছে তা তো সত্য। এই ঘাটতির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা কোন কোন খাতের? হিসাব ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে প্রথমত, আরএমজি আর দ্বিতীয়ত, ইন্টারমিডিয়ারি গুডস। আরএমজির খাতে কতটা আমদানি বেড়েছে? ২০২১ সালে আরএমজি সেক্টরের কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ ১৪.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২২.২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার সংখ্যাগত পরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার আর যা মোট ঘাটতির ৩২ শতাংশ।
অন্যদিকে, উৎপাদনের বিভিন্ন কাঁচামাল যার মধ্যে আছে সিমেন্ট তৈরির ক্লিঙ্কার, ওয়েল সিড, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, আয়রন, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, সার ইত্যাদির আমদানি ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৪.৯৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এসব কাঁচামাল আমদানিতে ৯.৬৯ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ৬৩.৬ শতাংশ বেশি এবং যা মোট ২৩.৫৯ বিলিয়ন ডলার ঘাটতির ৪১ শতাংশ।
ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০-২১ থেকে ২১-২২-তে আমদানির যে প্রবৃদ্ধি তার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত ইন্টারমিডিয়েট গুডস ও আরএমজির কাঁচামাল। কারণ এই দুই ক্যাটাগরিই ৭০ শতাংশের ওপরে ঘাটতি তৈরি করেছে। ফলে, এত দিন বলা হয়েছিল যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ বা বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিওপি ঘাটতি হয়েছে এই যুক্তিটা তথ্য দ্বারা প্রমাণিত নয়।
তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল, যা আমদানি করা হয় তার সঙ্গে শ্রমিকের শ্রম আর মালিকের লাভ মিলেই রপ্তানি। সোজা হিসেবে বলা যায়, আমদানির চেয়ে রপ্তানি আয় বেশি হবে। তাহলে আমদানি বাড়লে ক্ষতি নেই বরং রপ্তানি আয় বাড়বে। প্রবাসী আয় সেটাও তো জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি এসেছে। এক মাসেই এসেছে ২.১ বিলিয়ন ডলার। অবৈধ পথে বা হুন্ডি করে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করতে পারলে আরও বেশি ডলার আসবে এ কথা সবাই মনে করেন।
তাহলে বাণিজ্য ঘাটতির আর কী কী কারণ থাকতে পারে? অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, গত কয়েক মাসে দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পেছনে এলসির আড়ালে টাকা পাচার একটি কারণ হতে পারে। তার এই সন্দেহের নিশ্চয়ই কারণ আছে। বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। খাদ্যপণ্য আর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে প্রধান করে দেখিয়ে আড়ালে অন্য কিছু যে ঘটছে তা তো আন্দাজ করা যায়। রেকর্ড আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে গেল কি না তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির পরিসংখ্যান অস্বাভাবিক। কারণ দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে কোনো সূচকেই এই আমদানির প্রতিফলন নেই। লুকিয়ে থাকা বা লুকিয়ে রাখা অন্য কিছুটাকে দেখানো আর বন্ধ করার দায়িত্ব পালন করবে কে? বৈদেশিক বাণিজ্য কোনো একটা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণ আর আমাদের দেশে তা কি কিছু মানুষের অর্থ পাচারের প্রধান উৎসে পরিণত হবে? এসব সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। জনমনে উত্থাপিত প্রশ্ন, সন্দেহ আর কারণ দূর করার দায়িত্ব তো ক্ষমতাসীন সরকারকেই নিতে হবে।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
শেয়ার করুন
রাজেকুজ্জামান রতন | ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০

যা ঘটে প্রকৃত ঘটনা তা নাও হতে পারে। যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতিদিন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে উচ্ছ্বাস এখন উৎকণ্ঠায় পরিণত হয়েছে, ফলে আশ্বাস দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে সরকারি মহল থেকে। কোনো সমস্যা নেই, পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আছে, তিন মাসের খাদ্য আমদানির মতো রিজার্ভ আছে এ রকম আশ্বাস যেমন দেওয়া হচ্ছে, তেমনি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে এই বলে, আগে কখনো কি এত রিজার্ভ ছিল? আর তুলনামূলক কথা বলতে পছন্দ করা কর্তারা বলছেন, পৃথিবীর অনেক দেশে এত দিন চলার মতো রিজার্ভ নেই, আমরা ভালো আছি ইত্যাদি।
কিন্তু মানুষ দেখছে ডলারের বাজার চড়া, প্রতিদিনই বাড়ছে দাম। বাজারে ১১২ টাকা পর্যন্ত উঠেছে ডলারের দাম। সরকারি দাম আর বাজারে বিক্রির মধ্যে ১৫ টাকার মতো পার্থক্য বলে ডলার নিয়ে ব্যবসাও হচ্ছে নানাভাবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে, বড় বড় গাড়ি কিনতে, বিলাসবহুল বাড়ির সরঞ্জাম কিনতে, ঈদ-পার্বণে বিদেশে শপিং করতে, খিচুড়ি রান্না বা পুকুর খননের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করতে হলে ডলার লাগবে। কিন্তু আমাদের দেশে ডলার আসে কীভাবে? একটা পথ হলো রপ্তানির মাধ্যমে, অন্যটা প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। আর ডলার প্রধানত খরচ হয় আমদানি করতে গিয়ে। আমাদের দেশে প্রধানত গার্মেন্টসের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, খাদ্য, গাড়ি আমদানি করতে ডলার খরচ করতে হয়। এই আমদানি-রপ্তানির ঘাটতিকে বলা হয় ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি। একটা সাধারণ হিসাব করে দেখা যাক! বলা হয়েছে, আমরা রপ্তানি করেছি ৫২.৫ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানি করেছি ৮৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ কমবেশি ৩৬ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি আছে। প্রবাসী শ্রমিকরা পাঠিয়েছেন ২২ বিলিয়ন ডলার। তাহলে সবশেষে ঘাটতি দাঁড়াল ১৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে রিজার্ভে তো টান পড়বেই।
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, খাদ্যের দাম বেড়েছে আর এসবের কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ। সমাধানের যুক্তি কী? আমাদের কিছু করার নেই। এই বাস্তবতা মানতেই হবে। খাদ্যপণ্যের দাম তাই বাড়ছে এবং বাড়বে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম শুধু বাড়বে তা-ই নয় আমাদের এখন ঋণ করতে হবে চড়া সুদে এবং কঠিন শর্তে। আমদানির কারণে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যাপারটা যদি তাই হয় তাহলে তো দাম বাড়ানো ও ঋণ করার বিকল্প নেই। কিন্তু ৩ আগস্ট ‘খাদ্য ও জ্বালানি আমদানি রিজার্ভকে চাপে ফেলেনি’ শীর্ষক বণিক বার্তার একটি রিপোর্ট দেখে বিষয়টাকে অন্যরকম মনে হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করা আমদানি পণ্যের কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী তৈরি করা বণিক বার্তার রিপোর্ট দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক খাদ্যপণ্য বা জ্বালানির মূল্যস্ফীতি নয় বরং ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতির কারণ অন্যত্র।
এত দিন একটা প্রশ্ন অনেকেরই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমদানি এত বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? আমদানি বেড়েছে না আমদানি ব্যয় বেড়েছে? ২০-২১ সালে আমদানি হয়েছে ৬৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.১৬ বিলিয়ন ডলারে। এই ২৩.৫৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি বাড়ার কারণ কী? এই কয়েক দিনের সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্য স্ফীতিই প্রধান কারণ। কিন্তু কাস্টমসের ডেটা অনুযায়ী ২০২১ থেকে অর্থবছর গত বছরে খাদ্যশস্যের আমদানি কমেছে ৪.৪ শতাংশ। এর মধ্যে গম আমদানির পরিমাণই বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬.৭ শতাংশ। কিন্তু চালের আমদানি কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ২০২১ সালে আমদানি হয়েছিল ২৬৮ কোটি ডলারের খাদ্যপণ্য আর গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ২৫৬ কোটি ডলার। ফলে খাদ্যশস্যের মোট আমদানির খরচ প্রায় ১২ কোটি ডলার কমেছে।
বলা হয়ে থাকে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ‘বিওপি’র ঘাটতি হয়েছে। কিন্তু কাস্টমস ডেটা অনুসারে অর্থবছর ২০২১-এর তুলনায় গত বছর ভোজ্য তেলের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য কিন্তু তার পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার। এ কথা সত্য, খাদ্যপণ্যের দাম ও আমদানি মূল্য বেড়েছে। শুধু ভোজ্য তেল নয়, দুধ, মসলা, ডাল ও চিনিসহ নন-গ্রেইন খাদ্যপণ্যের আমদানি মূল্যও বেড়েছে। প্রশ্ন হলো তা কতটা এবং তাতে কত বেশি খরচ হয়েছে? যদি চাল, ডাল, চিনি, তেল, মসলাসহ সব খাদ্যদ্রব্য আমদানি খরচ বিবেচনা করা হয়, তবে ২০২১ থেকে গত অর্থবছরে মাত্র ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যা মোট ঘাটতির মাত্র ৬ শতাংশ। এ বছরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশের ওপরে। তার অর্থ দাঁড়ায় ২০২২ সালে চাল আমদানি কম হয়েছে এবং এটা পরিষ্কার যে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিওপি ঘাটতিতে বড় ভূমিকা রাখেনি।
আবার যে কথা বলে প্রায় বিশ্বাস করিয়ে ফেলা হচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের সব দেশের মতো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ‘বিওপি’ ঘাটতি হয়েছে। কিন্তু তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। অর্থবছর ২০২১ থেকে গত বছরে পেট্রোলিয়াম আমদানির পরিমাণ তো বাড়েই নাই বরং আমদানি এক বিলিয়ন ডলার কমেছে, যেটা বিস্ময়কর। এর বিশ্বাসযোগ্য উত্তর যেটা হতে পারে যে, অর্থবছর ২০২১-এর স্টক বিপিসির কাছে রয়ে গিয়েছিল, তাই বিপিসি কম পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করেছে। ফলে, বিওটি বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকটে জ্বালানি তেলের কোনো ভূমিকা তো নেই বরং বিগত অর্থবছরে জ্বালানি তেল এক বিলিয়ন ডলার কম আমদানি হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে শুধু তেল তো একমাত্র জ্বালানি নয়, গ্যাসও একটি জ্বালানি এবং এর মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ৪০ ডলারে উঠেছে, এর প্রভাব কি পড়েনি? অবশ্যই পড়েছে, তবে যতটা ব্যাপক বলা হচ্ছে ততটা নয়। তথ্য দেখাচ্ছে, ২০২২ সালে এলএনজির কারণে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এলএনজিকে আদার ক্যাটাগরিতে দেখায়, যে ক্যাটাগরিতে আর কী কী পণ্য রয়েছে তা ঠিক উল্লেখ নেই। ফলে, জ্বালানি তেলের ১ বিলিয়ন ডলার আমদানি হ্রাস আর এলএনজির ১.৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বৃদ্ধিকে যোগ করলে দেখা যায় বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্যস্ফীতির প্রভাবে, সার্বিক জ্বালানি আমদানিতে ব্যালান্স অব পেমেন্টে মাত্র ০.৭ বিলিয়ন ডলার প্রভাব পড়েছে, যা মোট ঘাটতির মাত্র ২ শতাংশ।
তাহলে কিছুদিন ধরে যে হাহাকার ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে তার কারণ কি অন্য কিছু? কিন্তু বিওপি ঘাটতি যে হয়েছে তা তো সত্য। এই ঘাটতির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা কোন কোন খাতের? হিসাব ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে প্রথমত, আরএমজি আর দ্বিতীয়ত, ইন্টারমিডিয়ারি গুডস। আরএমজির খাতে কতটা আমদানি বেড়েছে? ২০২১ সালে আরএমজি সেক্টরের কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ ১৪.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২২.২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার সংখ্যাগত পরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার আর যা মোট ঘাটতির ৩২ শতাংশ।
অন্যদিকে, উৎপাদনের বিভিন্ন কাঁচামাল যার মধ্যে আছে সিমেন্ট তৈরির ক্লিঙ্কার, ওয়েল সিড, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, আয়রন, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, সার ইত্যাদির আমদানি ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৪.৯৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এসব কাঁচামাল আমদানিতে ৯.৬৯ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ৬৩.৬ শতাংশ বেশি এবং যা মোট ২৩.৫৯ বিলিয়ন ডলার ঘাটতির ৪১ শতাংশ।
ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০-২১ থেকে ২১-২২-তে আমদানির যে প্রবৃদ্ধি তার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত ইন্টারমিডিয়েট গুডস ও আরএমজির কাঁচামাল। কারণ এই দুই ক্যাটাগরিই ৭০ শতাংশের ওপরে ঘাটতি তৈরি করেছে। ফলে, এত দিন বলা হয়েছিল যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ বা বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিওপি ঘাটতি হয়েছে এই যুক্তিটা তথ্য দ্বারা প্রমাণিত নয়।
তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল, যা আমদানি করা হয় তার সঙ্গে শ্রমিকের শ্রম আর মালিকের লাভ মিলেই রপ্তানি। সোজা হিসেবে বলা যায়, আমদানির চেয়ে রপ্তানি আয় বেশি হবে। তাহলে আমদানি বাড়লে ক্ষতি নেই বরং রপ্তানি আয় বাড়বে। প্রবাসী আয় সেটাও তো জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি এসেছে। এক মাসেই এসেছে ২.১ বিলিয়ন ডলার। অবৈধ পথে বা হুন্ডি করে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করতে পারলে আরও বেশি ডলার আসবে এ কথা সবাই মনে করেন।
তাহলে বাণিজ্য ঘাটতির আর কী কী কারণ থাকতে পারে? অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, গত কয়েক মাসে দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পেছনে এলসির আড়ালে টাকা পাচার একটি কারণ হতে পারে। তার এই সন্দেহের নিশ্চয়ই কারণ আছে। বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। খাদ্যপণ্য আর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে প্রধান করে দেখিয়ে আড়ালে অন্য কিছু যে ঘটছে তা তো আন্দাজ করা যায়। রেকর্ড আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে গেল কি না তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির পরিসংখ্যান অস্বাভাবিক। কারণ দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে কোনো সূচকেই এই আমদানির প্রতিফলন নেই। লুকিয়ে থাকা বা লুকিয়ে রাখা অন্য কিছুটাকে দেখানো আর বন্ধ করার দায়িত্ব পালন করবে কে? বৈদেশিক বাণিজ্য কোনো একটা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণ আর আমাদের দেশে তা কি কিছু মানুষের অর্থ পাচারের প্রধান উৎসে পরিণত হবে? এসব সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। জনমনে উত্থাপিত প্রশ্ন, সন্দেহ আর কারণ দূর করার দায়িত্ব তো ক্ষমতাসীন সরকারকেই নিতে হবে।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট