
একটা দেশের উন্নতি নির্ভর করে তার প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার ও জনসম্পদের প্রকৃতির ওপর। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেই কোনো দেশকে উন্নত বলা যায় না; বড়জোর ধনী আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু জনসম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশের উন্নতি হয় টেকসই, বহুমুখী ও গতিশীল; প্রাকৃতিক সম্পদের লভ্যতা সেখানে তেমন বড় কোনো বিষয় হয়ে ওঠে না, বরং সেটার দুর্লভতাই দেশের নাগরিক ও নেতাদের উন্নয়ন-প্রচেষ্টায় ‘মন্ত্রের সাধন, কিংবা শরীর পতন’-এর দেবসুধা পানে মরিয়া হয়ে ওঠার প্রেরণা জোগায়। প্রাকৃতিক সম্পদ আপনা-আপনি দেশের নাগরিকদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটায় না; দক্ষ জনসম্পদের মাধ্যমে সেগুলো সদ্ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। সে কারণে আফ্রিকার অনেক দেশ মহামূল্যবান নানা খনিজের অধিকারী হয়েও আজ অনুন্নত বা বড়জোর উন্নয়নশীল তকমায় ভূষিত। আর ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশ তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও অতি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তাদের এই উল্লম্ফনের পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছে মানবসম্পদের উন্নয়ন, যেটা আবার এসেছে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থেকে।
পাকিস্তানের এক বছর পর ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা লাভ, এরপর ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিমজ্জন, যুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত অবকাঠামো ও মহারুগ্ণ এক অর্থনীতির পৃষ্ঠদেশে আরোহণ এই ছিল উন্নয়ন-পূর্ব দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাস। কিন্তু তারা ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশ গড়ার ব্রত শুরু করেন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে, যেখানে প্রাধান্য পায় স্টেম (Science, technology, engineering and mathematics) এডুকেশন এবং গবেষণা ও উদ্ভাবন। প্রথম দিকে সরকারকে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি করতে হতো বটে, তবে স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেগুলোর বিস্তার যেমন ঘটানো হতো, তেমনি সেগুলোতে নব নব স্থানীয় প্রযুক্তির উদ্ভাবন সূচিত হতো। এগুলোকে সুসমন্বিত করে জাতীয় ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তারা গঠন করেন এনআইএস (National Innovation System)। প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় nq KIST (Korea Institute of Science & Technology) এবং স্থানীয়ভাবে জটিল প্রযুক্তির উন্মেষ ঘটাতে ১৯৭১ সালে স্থাপন করা হয় KAIST (The Korean Advanced Institute of Science & Technology)। এ পর্যায়ে এনআইএসের প্রধান কাজ হয়ে যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকাজের সমন্বয় সাধন, বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণার সম্প্রসারণ, গবেষণার ফলাফলের বিস্তার সাধন এবং সব পর্যায়ে গবেষণা ও উন্নয়ন (Research & Development, R&D) কার্যক্রমকে টেকসইকরণ।
গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে সরকার এই খাতে সম্পদের ন্যূনতম বিনিয়োগ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়, বেসরকারি কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে উন্মুক্ত হস্তে কর রেয়াত ও প্রণোদনা প্রদান করে এবং এই খাতে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা সেরা স্নাতকরা নিয়োজিত হতে পারেন, তার ব্যবস্থা নেয়। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বেসরকারি সেক্টরে এই খাতে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৮০ সালে এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ০.২৮ শতাংশ, পক্ষান্তরে ২০১০ সালে তা বেড়ে উন্নীত হয়ে যায় ২.৮০ শতাংশে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী আরঅ্যান্ডডি খাতে দক্ষিণ কোরিয়ার বরাদ্দ বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; জিডিপির ৪.৮ শতাংশ। ৫.৪ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে ইসরায়েল এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের অধিকারী।
বাংলাদেশে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দের চিত্র বড়ই করুণ। এখানে গবেষণা ও উন্নয়ন (R & D) খাত নামে স্বতন্ত্র কোনো খাত নেই; অথচ বিশ্বে ১২৫ দেশে এটির আলাদা অস্তিত্ব জাজ্বল্যমান। এখানে এটা শিক্ষা খাতের একটা উপখাত মাত্র। আর শিক্ষা খাতেই বরাদ্দের হার জিডিপির ২ শতাংশের যৎসামান্য ওপরে; গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে মাত্র ০.৩ শতাংশ। The Business Standard-এর ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে এ খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ১৩৭ কোটি টাকা; যার মধ্যে সরকারিগুলোতে ৩৬ কোটি এবং বেসরকারিগুলোতে ১০১ কোটি টাকা। ১৫০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫টি এ খাতে কোনো টাকাই খরচ করেনি, আর যেগুলো এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে, সেগুলোর সংখ্যা ৪৪টি। উল্লিখিত, ইংরেজি দৈনিকটির ১৪ জানুয়ারি ২০২১ তারিখের আরেক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৯৬-২০১৭ সালের মধ্যে দেশের বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের সংখ্যা ৩৮,৩৯৭, পক্ষান্তরে ওই সময়ে নাইজেরিয়ার সংখ্যা ছিল ৭১,০৪৬, ইন্দোনেশিয়ার ৭২,১৪৬ এবং পাকিস্তানের ১,২১,৮৩৬। এ তো গেল সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব; মানের বিচারেও দেশের গবেষণার অবস্থা তথৈবচ।
রচনা চুরি করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদাবনতি, নিম্নমান ও চুরি করা অভিসন্দর্ভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার বৃত্তি বাতিলÑএই জাতীয় সংবাদ এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। এসব সংবাদ দেশে গবেষণার মান সম্পর্কে একটা বার্তা দেয়। দেশে এ জাতীয় গবেষণা আগেও যে ছিল না তা নয়। আকবর আলি খানের ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘সত্তরের দশকে বাংলাদেশে মাত্র তিনজন অধ্যাপক ছিলেন যারা প্রত্যেকে দুটি করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। এরা তিনজনই দুর্নীতির দায়ে জেল খাটেন। এরপর বাংলাদেশে ডাবল পিএইচডির আর খবর পাওয়া যায়নি।’ এই তিনজন অধ্যাপক রচনা চুরি করে জেলে গিয়েছিলেন, নাকি অন্য কোনো কারণে লাল দালানে পদার্পণ করেন, তা অবশ্য বইটাতে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে এ গবেষণার অধিকাংশই অ্যাকাডেমিক ধাঁচের; পদোন্নতি লাভ ও ব্যক্তিগত কিছু প্রাপ্তিযোগের মোহে পরিচালিত। যার প্রায়োগিক মূল্য উল্লেখ করার মতো নয়। দেশে গবেষণার প্রায়োগিক মূল্য কেমন, তার দু-একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে, যাতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত ছিল। ওই বছর সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলে চাল আমদানিও হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টন। এটা যুক্ত করা হলে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ লাখ টন, যেটা পরবর্তী বছর জের হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। অঙ্কের হিসাবে এই পরিমাণ বছরের উৎপাদনের ২৫ শতাংশেরও বেশি। এ ধরনের মোটাসোটা জের-পরবর্তী বছরে যুক্ত হলে সাধারণভাবে মজুদ নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ থাকে না; পরবর্তী বছর ১০ শতাংশ উৎপাদন ঘাটতি হলেও তা সামলে নেওয়া সহজেই সম্ভব। অথচ মজুদের এই স্বাস্থ্যকর অবস্থা সত্ত্বেও মহার্ঘ মূল্যে এই দুঃসময়ে চাল আমদানি চালিয়ে নিতে হচ্ছে; চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ টন আমদানি হয়ে গেছে, পাইপ লাইনে আরও আছে। তাহলে এই গবেষণার ফল আমরা কী কাজে প্রয়োগ করব?
খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরির সময় কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। একবার এক গবেষক মডেল প্রয়োগ করে ধান, চাল ও গম সংগ্রহের বছরব্যাপী এক নির্ঘণ্ট তৈরি করে আনেন। তাতে দেখলাম যে, জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে গম সংগ্রহের এন্তেজাম করা হয়েছে। মে মাসের পর অভ্যন্তরীণ বাজারে দেশি গমের যে টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায় না, সেটা বলার পর গবেষকরা পড়ে যান মহামুশকিলে; একদিকে মডেলের নির্ভুলতা, অন্যদিকে রূঢ় বাস্তবতা। পরে তারা কেমন করে যেন ম্যানুয়ালি সে আপদ অপসারণ করতে সক্ষম হন। এ জাতীয় উপযোগিতাÑশূন্য বহু গবেষণাপত্র খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটে খোঁজাখুঁজি করলে এখনো পাওয়া যাবে।
তবে এই জাতীয় প্রায়োগিক মূল্যহীন গবেষণা যে শুধু এ দেশে দেখা যায়, তা না। উন্নত অনেক দেশেও এগুলোর উপস্থিতি এন্তার। নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু চিকিৎসা বিভাগে গবাদি পশুর মূত্রত্যাগের অভ্যাস সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রকল্পে মার্কিন সরকার ৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করে। এখানে গবেষকরা জানতে চান যে, নদী পার হওয়ার সময়, গরু নদীতে নামার আগে, না পার হওয়ার পর প্রস্রাব করে। পুরো অর্থব্যয়ের পর জানা গেল যে, প্রকল্পে নিযুক্ত অধিকাংশ পর্যবেক্ষক গরুগুলো কখন নীরবে মূত্রত্যাগ করেছে, তা ঠাহর করতে পারেননি। সুতরাং এ বিষয়ে কিছু জানতে আরও একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রকল্পটি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি অপচয়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে সিনেটর প্রক্সমায়ার স্মারক পুরস্কারে ভূষিত হয় (আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি, আকবর আলি খান, পৃষ্ঠা : ১৬৬)।
এখন আমাদের বেশি প্রয়োজন প্রায়োগিক মূল্যমানসম্পন্ন গবেষণা; চাহিদা ও সম্পদের জোগানের ভিত্তিতে পরিচালিত গবেষণা। বিষয় হবে স্বল্পব্যয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মানসম্পন্ন ও ক্রেতাদের মনোহরণ করেÑএমন নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও সেগুলোর বিপণন এবং নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান; আমরা রপ্তানি বাড়াতে চাই, কিন্তু পর্যাপ্ত পণ্য ও গন্তব্য নেই। দক্ষতার চাহিদা ও তার পরিবর্তন-প্রবণতা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে পাঠ্যক্রম প্রবর্তন ও সংশোধন; আধুনিক শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ এবং চাহিদাবিহীন ডিগ্রি-সর্বস্ব শিক্ষার ব্যয় সংকোচ একটি জরুরি গবেষণার ক্ষেত্র। আমাদের রয়েছে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রচুর উচ্চশিক্ষিত বেকার। অথচ তাদের বাদ দিয়ে বহু দেশি প্রতিষ্ঠানই বিদেশি লোকবল নিয়োগ দেয়, যার জন্য বছরে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। এর কারণ ও প্রতিকার বের করা দরকার। অবহেলিত ও স্বল্প-কর্ষিত ক্ষেত্রগুলোর সম্ভাবনা যাচাইকরণ আরেকটি ক্ষেত্র হতে পারে; আমরা সমুদ্রে বিপুল সম্পদের মালিকানা পেয়েছি, কিন্তু এখনো তা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এ রকম আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলোতে গবেষণা পরিচালনা দেশের জন্য নবদিগন্তের সূচনা করতে পারে। এজন্য শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণায়ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে ক্ষেত্রে ইউনেসকোর সুপারিশ জিডিপির ৬ শতাংশ; আর আরঅ্যান্ডডি খাতে বোদ্ধাদের দাবি ১.৫ শতাংশ।
তবে এসব গবেষণার ফলাফল যাতে কাজে লাগে, গবাদি পশুর মূত্রত্যাগবিষয়ক গবেষণার মতো এর অর্থ যাতে জলে না যায়, তার জন্য উপযুক্ত দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আংকেল শ্যামের আদলে প্রতি বছর দশটি উৎকৃষ্ট ও দশটি নিকৃষ্ট গবেষণার তালিকা প্রণয়ন করে গবেষকদের পুরস্কৃত ও তিরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আর গবেষণাকে সমৃদ্ধ ও টেকসই করতে বেসরকারি সেক্টরে তার সম্প্রসারণ ঘটাতে এবং পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে স্নাতক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পটভূমিতে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন পরিক্রমা এ ক্ষেত্রে আমাদের পাথেয় হিসেবে কাজ করতে পারে। এ কাজে কোরিয়ার মতো সরকারকেই বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট
বিখ্যাত বাঙালি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা সদরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মগত নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত। ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দীবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখেন। প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’, তবে ছবিটি আর মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে নায়িকার অভিনয় করে সাড়া ফেলে দেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটি সবিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস (১৯৫৫)। ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। সুচিত্রা সেনের একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন এবং তার দুই নাতনি রাইমা সেন ও রিয়া সেনও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। ২০১২ সালে তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবিভূষণ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন সুচিত্রা সেন।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল রাশিয়া। বছর ঘুরে এলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। বড় গাছের যেমন বড় ছায়া পড়ে, তেমনি বড় কোনো দেশ যুদ্ধে জড়ালে তার কালোছায়া পড়ে পুরো বিশ্বেই। ইউক্রেন যুদ্ধের কালো ছায়াও পড়েছে এখন বিশ্বে। এই এক বছরেই বিশ্ব রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে। বিশ্বের নানা দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা টানাপড়েন শুরু হয়েছে। অনেক দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিশ্বজুড়ে দেখা দিচ্ছে অর্থনৈতিক মহামন্দা। দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? কে থামাতে পারবে এই যুদ্ধ? সাদা চোখে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে বলে মনে করা হলেও, এটি যে রাশিয়া আর পশ্চিমা ন্যাটো জোটের মধ্যকার লড়াই, তা সবাই জেনে গেছে। মূলত ইউক্রেন হচ্ছে এখানে প্রক্সি। যুদ্ধ থামানোর ভূমিকায় থাকার কথা ছিল ইউরোপের, কিন্তু তারা আর সে অবস্থানে নেই। ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্ররা চাচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকেই সরিয়ে দিতে। ফলে, ইউক্রেন চাইলেও সমঝোতা আলোচনা সম্ভব হচ্ছে না। শান্তি আলোচনার তাবৎ উদ্যোগ তাই থমকে গেছে।
এরই মধ্যে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে। নতুন আরেকটি বছরে চলে গেল যুদ্ধটি। বিশ্বের সব বড় দেশের নেতারা যুদ্ধ বন্ধে বাস্তবধর্মী কোনো ফর্মুলা বাতলে দিচ্ছেন না। জাতিসংঘ কী করছে তা-ও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। একচোখা এই সংস্থাটির এ যুগে থাকা দরকার আছে কি না, তা নিয়েও অনেকে আবার কথা শুরু করেছেন। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি সামনের দিনগুলোতে বিশ্ববাসীকে আরও খারাপ সময়ের ভেতর ফেলে দেবে। পৃথিবী এর মধ্যেই মন্দা অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশ করেছে। এটা থেকে বের হওয়ার চাবিকাঠি শুধু আমেরিকার হাতেই। কারণ, ইউক্রেন কিংবা ন্যাটো দুপক্ষই আমেরিকার অধীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমেরিকা চাইলে যুদ্ধ বন্ধ করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আমেরিকা নানা কারণেই সেটি করবে না। এ কারণে এই যুদ্ধ দীর্ঘ একটা রূপ পেতে যাচ্ছে।
যুদ্ধের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক জেনারেল এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ মিক রায়ান বলছেন, স্বল্প মেয়াদে কোনো একটি পক্ষের কৌশলগত বিজয় কিংবা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরিভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা এখানে খুব কম। যুদ্ধরত কোনো পক্ষই এমন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি, যা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করতে পারে। ফলে যুদ্ধ সহসাই থামবে না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও বারবার বলে চলেছেন, তিনি পিছপা হবেন না। তিনি মনে করছেন কৌশলগত ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে তিনি এ যুদ্ধে লাভবান হবেন। কারণ দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং তারা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার পাশাপাশি চীনের হুমকির ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগী হবে। আত্মবিশ্বাসী রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেও কোনো ফল পায়নি পশ্চিমারা। ইউক্রেনের তরফেও সমঝোতার টেবিলে বসার মনোভাব নেই। ন্যাটো ও আমেরিকার প্রশ্রয়ে তারাও অনড় অবস্থানে।
এ অবস্থায় পুতিন ইউক্রেনে পরমাণু হামলা চালাবেন কি না সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে তিনি কিছু একটা যে করে ফেলবেন, তা নিশ্চিত। ইউক্রেনে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটুক আর নাই ঘটুক, এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতিতে তার চেয়েও বড় বোমা পড়ছে প্রতিনিয়ত। বৈশ্বিক খাদ্যশস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষ এখন দিশেহারা। পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যয়সংকোচন নীতি নেওয়া হচ্ছে। আমদানি পণ্যেও আরোপ হয়েছে নানা বিধিনিষেধ। বাংলাদেশও ধুঁকছে খাদ্যপণ্য আমদানি নিয়ে। ফলে চলমান সংকট নিরসনে ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ বা ‘ব্যয় সংকোচন’নীতিকেই বেছে নিতে হয়েছে সরকারকে। চলতি বছরটা বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। দেশের মানুষ ক্যালরির জন্য ভাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে আটা-ময়দার ওপরও ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এই আটা-ময়দা আসে গম থেকে যার বেশির ভাগই আমদানি করা হয় ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে। নানা গবেষণা থেকে দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। কিন্তু যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গমের দাম বেড়েছে অনেক। এতে বাংলাদেশে আটা-ময়দার দামও বেড়েছে। গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে নানা পদক্ষেপের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও বাধ্য হয়ে লোডশেডিংয়ের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। সরকারের এমন ‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনেও রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাসসহ দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। সেই সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থায়ও সমস্যা তৈরি হয়েছে, ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থাও। অনেক উন্নত দেশেও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জানিয়ে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়মুখী হওয়ার আহ্বানও রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে এরই মধ্যে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ছে বারবার। এতে করে সামনে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে। ভোটের বছর এটি। এটি ইস্যু হিসেবে হাজির হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সামনের দিনগুলোতে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এমন প্রতিকূল পরিণতি বয়ে আনবে, যা বিশ্বের ভূ-অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন আকার দিতে পারে। বাংলাদেশকেও সেই প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
আদালতে বিচারকাজ সম্পন্ন হয় আইনজীবী ও বিচারকের সমন্বয়ে। এটা অনেকটা দুই চাকার সাইকেলের মতো। একটি অকার্যকর হলে অন্যটি চলতে পারে না। আইনের শাসন কায়েম করতে হলে এই দুটি অঙ্গেরই ভূমিকা আছে। পারস্পরিক সম্মান, বোঝাপড়া ও সহযোগিতার মধ্য দিয়েই যুগ যুগ ধরে বিচারালয়ের কাজ পরিচালিত হয়েছে। তবে ইদানীং বিচারালয়ও অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকরা বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন। গত কয়েক মাসে এমন বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারদের সঙ্গে আইনজীবীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই বিরোধের জের ধরে আইনজীবী ও বিচারকরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করায় জেলার বিচারাঙ্গনে রীতিমতো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা।
পতনের যে সত্যিই কোনো সীমা হয় না, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীরা তা আরও এক বার প্রমাণ করলেন। অশ্রাব্য ভাষায় বিচারককে গালাগাল করেই ক্ষান্ত হলেন না, তারা বিচারকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালেন, আদালত বয়কট করলেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ আইন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এতখানি নিচে এর আগে নামেনি।
এর পাল্টা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল ও অশালীন আচরণ ও এজলাসে খারাপ ভাষা ব্যবহার করার অভিযোগে ওই বারের ২১ আইনজীবীকে তলব করেছে হাইকোর্ট। এর আগেও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৩ আইনজীবীকে তলব করেছে হাইকোর্ট। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ জুলাই এক জামিন শুনানিতে পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও বিচারিক কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় হাইকোর্টে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পান পিরোজপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খান মো. আলাউদ্দিন। এরপর গত সেপ্টেম্বরে খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা জজ) বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি পান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা ঘটেছে, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয়, নিন্দনীয়ও বটে। আমাদের দেশে বিচারালয়ে এমন ঘটনা আগে ঘটত না। কিন্তু এখন প্রায়ই ঘটছে। কেন এমন হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। কেননা রোগ নির্ণয় করা গেলে ওষুধ প্রয়োগ সম্ভব হবে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কার্যত উভয় পক্ষকেই সংযমী ও উদ্যোগী হতে হবে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, অনেক জেলায় বিচারকের সঙ্গে আদালতে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। সাধারণ আইনজীবীরা এ অসৌজন্যতা দেখান না। দেখান তথাকথিত ‘পাওয়ারফুল’ আইনজীবীরা, বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যাদের সংযোগ আছে। অন্যদিকে বিজ্ঞ বিচারকরাও পক্ষপাত প্রদর্শন করেন বলে অভিযোগ আছে। তারা সাধারণ আইনজীবীদের মূল্যায়ন করেন না। অন্যদিকে ‘পাওয়ারফুল’ আইনজীবীদের তারা সমঝে চলেন, বেশি গুরুত্ব দেন। ফলে আশকারা পেয়ে ‘ক্ষমতাবান’ আইনজীবীরাই বিচারকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন।
বিচারকের কোনো সিদ্ধান্ত বা রায় যে সবার পছন্দ হবে, এমন নয়। রায় মনঃপূত না হলে উচ্চতর আদালতে আপিল করার ব্যবস্থাটিও আমাদের বিচারব্যবস্থায় সুপরিচিত। কিন্তু, বিচারপতির বিরুদ্ধে কটূক্তি, তাকে হয়রান করার এই সংস্কৃতির পেছনে যে রাজনৈতিক ক্লেদ রয়েছে, তা স্তম্ভিত করার মতো। অভিযুক্ত আইনজীবীর ঠিকুজি খুঁজলে রাজনীতির রং বের করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, বিচারকের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বারের নেতাদের এসব বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া উচিত। শুধু উদ্যোগী হওয়া নয়, কখনোই যেন বার এবং বেঞ্চের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি না হয়, নেতাদের সে বিষয়ে বিশেষ যতœবান হওয়া উচিত।
বিচারকদের প্রতি আইনজীবীদের এমন আচরণের পেছনে ঢালাও রাজনীতিকীকরণের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অবক্ষয়ও কম দায়ী নয়। সব পেশার মানুষেরই একটা মান বা স্ট্যান্ডার্ড আছে। অন্তত থাকা উচিত। কাগজে-কলমে কে কতটুকু শিক্ষিত সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু শিক্ষা রুচির পরিচয় দিতে হয় ব্যবহারে, কথায়, আচরণে। আমাদের দেশে সব পেশার মানুষের মধ্য থেকেই সুবচন নির্বাসনে গেছে। যে ঘর থেকে মানুষের শিক্ষা শুরু হয়, সেখানেই গলদ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আমাদের প্রয়োজনীয় ভদ্র-নম্র হতে শেখায় না। ফলে সমাজে পারস্পরিক সম্মান করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। একজনকে সম্মান দেখালে সেও সম্মান করবে এটা মনে রাখতে হবে। কিন্তু পারস্পরিক সম্মানের বোধটাই যেন আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। সবাই নিজেকে ও নিজ পেশাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করার ফল হলো অন্যকে ছোট বা হীন করে দেখা। ফলে সমাজে বিরোধ-বিদ্বেষ বাড়ছে। একজন আরেকজনকে নিজের ক্ষমতা ও দাপট দেখানোর চেষ্টা করছে। ফলে সব খানে বিরোধ ও ঝগড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যে যার ভূমিকা সুষ্ঠুভাবে পালন করলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। আইনজীবী বিচারক মানেন না। বিচারক আইনজীবী মানেন না। ছোট আইনজীবী বড় আইনজীবীকে হিংসা করেন। বড় বিচারক ছোট বিচারককে অবজ্ঞা করেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্তাব্যক্তিরা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চান্স পেলে বিপদে ফেলেন। সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী, সবাই সবার মুখোমুখি। এ এক আশ্চর্য সমাজ বানিয়েছি আমরা! যেখানে কেউ কাউকে সম্মান করেন না, শ্রদ্ধা করেন না, নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না। কেবল নিজেকে বড় মনে করা, অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এভাবে আমরা স্বখাত সলিলে যেন ডুবতে বসেছি!
বিচারক ও আইনজীবী মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ানোটা সমাজের জন্য মোটেও শুভ নয়। পেশাগত সম্পর্ক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে আসায় এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশ ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে পারস্পরিক ভারসাম্য রেখে কাজ করতে হবে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও তারা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কেউ কারও প্রতিপক্ষ নন বরং পরস্পর সম্পূরক। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অন্যতম। গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশের বিচারকরা ধোয়া তুলসীপাতা নন। নানা অভিযোগে তারাও অভিযুক্ত। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা ঘটেছে, তাতে আইনজীবীরা কিছুতেই দায় এড়াতে পারেন না। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের একটা গূঢ়তর উদ্দেশ্য আছে। তা হলো নিজের ক্ষমতা জাহির করা এবং বিচারকদের মনে এক ধরনের আতঙ্কের সঞ্চার করা। এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, এরপর হয়তো বিচারকদের শারীরিকভাবে নিগ্রহের ঘটনাও ঘটতে পারে। তা সত্যিই ঘটবে কি না, সে জল্পনা অবান্তর এমন একটি আশঙ্কা যে তৈরি হতে পারে, সে কথাই গভীর লজ্জা এবং উদ্বেগের। বিচারকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তার প্রভাব তাদের সিদ্ধান্তের ওপরেও পড়তে পারে।
ক্ষুদ্র রাজনীতির পালে হাওয়া দিতে যদি বিচারব্যবস্থা বিঘিœত হয়, সেই ক্ষতি অপূরণীয়। দেশের রাজনীতির পরিচালকরা আত্মসমীক্ষা করতে পারেন যে গণতন্ত্রের পরিসরে তারা রাজনীতি করেন, তার মূলে কুঠারাঘাত করা কী বিপুল অবিবেচনার কাজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারপতির বিরুদ্ধে ‘বিক্ষোভ’-এর পেছনে সংগঠিত রাজনীতির কলকাঠি নেই, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। যারা এই কাজটি করছেন বা করাচ্ছেন, তাদের পরিণামের কথা মাথায় রাখা উচিত। অন্যের জন্য কবর খুঁড়লে অনেক সময় সেই কবরে নিজেকেই সমাহিত হতে হয়!
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
বিসিএস পরীক্ষার পদ্ধতিতে কোটা তুলে দিয়ে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিঃসন্দেহে বড় ধরনের সংস্কার। অন্যদিকে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পিএসসির প্রতি মেধাবীরা আস্থা হারিয়েছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে পিএসসি। বিসিএসের প্রশ্নপত্র দৃশ্যত ফাঁস হয় না, প্রশ্নপত্র নিয়েও কোনো বড় অভিযোগ নেই। কিন্তু জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক অদৃশ্য কোটার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এক ধরনের ‘পারসেপশান’ ও জেলার নাম একরকম ‘ইজম’ তৈরি করে, যা কোনো প্রার্থীকে বাড়তি সুবিধা দিতে সুযোগ তৈরি করে। অবশেষে সেটা বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছে পিএসসি। সোমবার দেশ রূপান্তরে ‘জানতে চাওয়া হবে না আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মৌখিক পরীক্ষার পরীক্ষকরা (ভাইভা বোর্ড) চাকরিপ্রার্থীর কাছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানতে চাইতে পারবেন না। এমনকি জেলার নামও না। বোর্ডের সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয়প্রীতি বা জেলাপ্রীতি বন্ধ করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি।
দেখা গেছে, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বা জেলার প্রার্থী পেলে অনেক পরীক্ষক পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন; যা প্রার্থীর জন্য সুবিধাজনক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। পিএসসির চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘কমিশন পুরো পরীক্ষা পদ্ধতিতেই সংস্কার আনার কথা। লিখিত, মৌখিক বা প্রিলিমিনারিতেও সংস্কার আসছে। এ বিষয়ে এক সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। আরও কিছু বিষয়ের মতো মৌখিক পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, এমনকি জেলার নামও জানতে চাওয়া যাবে না। পরীক্ষকরা চাকরিপ্রার্থীর রোল নম্বর ছাড়া কিছুই জানতে চাইবেন না।’ অন্যদিকে, প্রার্থীকে ভালোভাবে যাচাই করার যুক্তি দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করায় অনিয়মের সুযোগ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও পিএসসি মৌখিক পরীক্ষাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ১০০ নম্বরের যুগে পরীক্ষকদের সামনে প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বরও থাকত। এখন আর সেই সুযোগ নেই। তারপরও প্রিয়জনপ্রীতির নানা সুযোগ রয়ে গেছে।
বোর্ড সদস্যদের মনোনীত করা হয় পরীক্ষার দিন সকালেই। এ কারণে দৃশ্যত কোনো ধরনের অসমতার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি পিএসসির চেয়ারম্যানও জানেন না সদস্যদের কে কোন বোর্ডে পরীক্ষা নেবেন। বোর্ডের সামনে প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বর থাকে না। প্রার্থী বোর্ড থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ারম্যান সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নম্বর চূড়ান্ত করেন। এটা করা হয় সদস্যদের প্রত্যেকের দেওয়া নম্বর গড় করে। বোর্ডে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষককে রাখা হয়, আবার দেখা গেছে অনেক বোর্ড সদস্য কোনো প্রশ্ন করেন না। সবাইকে সমানহারে প্রশ্ন করতে হবে। কতটা প্রশ্ন করবেন বা কত সময় একজন প্রশ্ন করবেন, তা নির্ধারিত থাকতে হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে বোর্ডের চেয়ারম্যান জানতে পারেন প্রার্থীর বৃত্তান্ত। বোর্ডের কোনো সদস্যকেই প্রার্থীর বৃত্তান্ত জানতে দেওয়া যাবে না। পুরোপুরি কোডিং সিস্টেমে চলে যেতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চাকরিপ্রার্থী দেশ রূপান্তরকে বলেন, বোর্ডে ঢোকার পর প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে, ‘টেল অ্যাবাউট ইউরসেলফ’। নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে প্রার্র্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসবে, জেলার নামও আসবে। কাজেই এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যেখানে ব্যক্তিগত তথ্যের নামে জেলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন বিষয়ে ছোটখাটো সংস্কার পিএসসি করেছে। কিন্তু এই সংস্কারই যথেষ্ট না। পিএসসির সব উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় মৌখিক পরীক্ষার নম্বরে। রহস্যজনক কারণে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করা হয়েছে। এতে নানা অনিয়মের দুয়ার খুলছে। কাজেই মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমাতে হবে। বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করলেও এ বিষয়ে পিএসসিকে সদিচ্ছা দেখাতে হবে। পিএসসি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সুপারিশ করতে পারে।
পিএসসির সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে বছরে একটি বিসিএস আয়োজন করতে না পারা। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে নিয়োগের সুপারিশ পর্যন্ত সব কাজ এক বছরেই শেষ হবে। বিসিএস শেষ করতে সাংবিধানিক সংস্থাটি যে রোডম্যাপ করেছিল, তা হোঁচট খাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের প্রাইমারি থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস, মূল্যায়নসহ পুরো পাঠদান ও পরীক্ষাপদ্ধতির আধুনিকায়ন ঘটেছে। সরকারে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকেন বিসিএস ক্যাডার অফিসাররাই। ফলে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা অনেকাংশেই এই ক্যাডার অফিসারদের ওপরই নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই সেকেলে পরীক্ষাপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে পিএসসির উচিত বিসিএসের সিলেবাসের আধুনিকায়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতির আমূল সংস্কার।
বরিশালের উজিরপুরে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে এসে সংসদ সদস্যের সামনে আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতিকে পিটিয়েছেন আরেক সহসভাপতি। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উজিরপুর উপজেলা পরিষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। মারধরে আহত আওয়ামী লীগ নেতাকে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
তিনি হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। নাম মো. ইদ্রিস সরদার (৪৫)। তাকে পিটিয়েছেন একই কমিটির সহসভাপতি ও উজিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান ওরফে ইকবাল। তারা দুজনই বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহ আলম তালুকদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দুজনই এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। এদিকে মারামারির এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুই নেতা এবং ইউনিয়ন যুবলীগের এক নেতাকে সাময়িকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় লোকজন ও আহত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে উজিরপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গতকাল সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মো. শাহ আলম তালুকদার। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান অতিথি অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন। তার সঙ্গে ছিলেন হাফিজুর রহমান ও ইদ্রিস সরদার। এ সময় হাফিজুর সংসদ সদস্যের সামনে ইদ্রিসকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করলে ইদ্রিস তার প্রতিবাদ জানান। এরপর হাফিজুর তাকে সংসদ সদস্যের সামনেই মারধর শুরু করেন।
মারধরের শিকার ইদ্রিস অভিযোগ করে বলেন, ‘সংসদ সদস্যের সামনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর আমাকে নিয়ে কটূক্তি ও অশালীন মন্তব্য করে। আমি প্রতিবাদ করলে হাফিজ আমার ওপর হামলা চালিয়ে মারধর শুরু করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডার কাজী রিয়াজ, পলাশ তালুকদার ও রুবেল হোসেনসহ ৭-৮ জন সন্ত্রাসী আমাকে লাঠিপেটা করে রক্তাক্ত জখম করে।’
তবে ইদ্রিসকে মারধরের ঘটনা তার এবং সংসদ সদস্যের সামনে ঘটেনি বলে দাবি করেন অভিযুক্ত হাফিজুর।
উজিরপুর মডেল থানার ওসি মো. কামরুল হাসান গতকাল বিকেলে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মাঠে ফুল দেওয়ার পরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, তারা বসে বিষয়টি মিটমাট করেছেন।’
দল থেকে ৩ নেতা বহিষ্কর : মারামারির এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বামরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান পলাশ, শিকারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ রিয়াজুল ইসলাম কাজী ও বামরাইল ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য জসিম উদ্দিন রুবেলকে সাময়িকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে তাদের বহিষ্কারের বিষয়টি উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন বেপারী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মারামারির ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভার সিদ্ধান্তে তাদের সাময়িকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন বেপারী বলেন, ‘দল থেকে সাময়িকভাবে তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক আলহাজ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সদস্য শাহ আলম তালুকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নেত্রকোনায় র্যালিতে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, আহত ৬০ : নেত্রকোনার দুর্গাপুরে মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে র্যালি নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। গতকাল রবিবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার কাচারি মোড় থেকে ব্যানার নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা শহীদ বেদিতে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় নিজেদের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় পাঁচ সদস্য আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সময় বিএনপির চার কর্মীকে আটকের কথা জানানো হয়।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুর্গাপুরে বিএনপির স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
নেত্রকোনা পুলিশের দাবি, র্যালি নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে যাওয়ার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গালিগালাজ শুরু করেন দুর্গাপুর বিএনপির নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তখন তাদের বাধা দিলে সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে বিএনপির চার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়।
তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, র্যালি নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে যাওয়ার সময় ব্যানার নিতে বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় পুলিশের। একপর্যায়ে লাঠিচার্জ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে নেতাকর্মীরা আহত হন।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ চার রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে ১৫-২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়াসহ ঘটনাস্থল থেকে সাতজন নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যায়।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জহিরুল আলম ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘কাচারি মোড় এলাকা থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য শত শত নেতাকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রাক্কালে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ তর্কবিতর্কে জড়িয়ে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে আমাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। পরে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। এছাড়া সেখান থেকে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যায়।’
দুর্গাপুর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব সম্রাট গণি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে প্রথমে আমাদের ব্যানার নিয়ে টানাটানি ও কাগজ ছোড়াছুড়ি হয়। পরে যুবদলের পক্ষ থেকে সেøাগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ ১৫-২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে। নিরস্ত্র অবস্থায় তখন আমরাও ঢিল দিই। মোবাইলে ভিডিও করার সময় আমাদের ৭-৮টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। এছাড়াও মসজিদের ভেতরে নেতাকর্মীদের রাখা প্রায় তিনশ’ মোটরসাইকেলের খোঁজ নেই। কিন্তু পুলিশ বলছে, তারা ৩০-৪০টার মতো মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে। আমার ডান হাঁটুতে বুলেট লেগেছে। ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শিশিরের মাথায় গুলি লাগাসহ ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী আহত হন।’
তবে দুর্গাপুর থানার ওসি মো. শিবিরুল ইসলাম উল্টো বিএনপি নেতাকর্মীরা আগে পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির লোকজন রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। ইট-পাটকেল মারাসহ ককটেল ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।’
আর নেত্রকোনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি ও মিডিয়া) মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির লোকজন শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসার সময় দুর্গাপুর পৌরসভার কাচারি মোড় এলাকায় পৌঁছার পরে পুলিশকে দেখে বিভিন্ন ধরনের সেøাগান ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। পুলিশ গালিগালাজের কারণ জিজ্ঞেস করলে তখন বিএনপির নেতাকর্মীরা ঠেলা ধাক্কা দেওয়া শুরু করে ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ তাদের সতর্ক করে লাঠিচার্জ ও চার রাউন্ড ফায়ার করে এবং চারজনকে আটক করে।’
নিন্দা ও প্রতিবাদ ফখরুলের : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের ওপরই কেবল বাধা দেওয়া হচ্ছে না, বরং যেকোনো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের ওপরও ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় কেবল আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ ধরনের হামলায় পিছিয়ে নেই।’ গতকাল বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দুর্গাপুর উপজেলা ও পৌর বিএনপিসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে পুলিশের বাধা দিয়েছে, টিয়ারশেল, গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে। এতে ৬০ জনের অধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ এবং ৮ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আহত নেতাকর্মীরা গুরুতর আহতাবস্থায় বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা এ ধরনের পৈশাচিক ও ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন না থাকার কারণে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাত্রা এখন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। পুলিশ আইনের রক্ষক অথচ তারাই আইনভঙ্গের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম চালাচ্ছে।’
বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব অবিলম্বে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহারসহ তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। এছাড়া তিনি ‘পুলিশি গুলিবর্ষণে’ আহত নেতাকর্মীদের আশু সুস্থতা কামনা করেন।
প্রতিবেদনটি নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল প্রতিনিধি ও উজিরপুর সংবাদদাতার তথ্যে তৈরি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবনেই গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র (ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট) নেই। বহুতল ভবন নির্মাণের আগে এবং পরে তা বসতের বা ব্যবহারের উপযোগী কি না, তার জন্য দুই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা ছাড়পত্র লাগে।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর জন্য দুই প্রতিষ্ঠানের কোনোটির ছাড়পত্র নেই। অনুমোদন ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ও আবাসিক কার্যক্রম।
অনুমোদন তথা ছাড়পত্র না নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও ওয়ার্কস দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান।
অনুমোদন না নিয়ে বিধি অমান্য করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ময়মনসিংহ বিভাগের উপপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান।
দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা ঘটলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সে বিবেচনা থেকেই ভবন নির্মাণ করা হয়। সব ঠিক থাকলেই ছাড়পত্র (ক্লিয়ারেন্স সনদ) দেওয়া হয়। সনদের বাইরে গিয়ে ভবন নির্মাণ এবং ব্যবহারের সুযোগ নেই। অভিযোগ এলে আমরা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সুরাহা করার চেষ্টা করব। তবে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নেয়নি।’
ময়মনসিংহ গণপূর্ত দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কস ও প্ল্যানিং কমিটির সদস্য এ কে এম কামরুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের মতো সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ক্লিয়ারেন্স নেওয়া দরকার। না নিলে আইন অমান্য করা হয়। আমি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাগ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করব।’
একদিকে ভবনের অনুমোদন নেই, অন্যদিকে অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। দশতলা বঙ্গমাতা ছাত্রী হলে অগ্নিনির্বাপণের জন্য ৬২টি ছোট সিলিন্ডার রয়েছে। এসবের কোনোটিরই মেয়াদ তথা কার্যকারিতা নেই। এ কথা নিশ্চিত করেছেন হলটির প্রাধ্যক্ষ নুসরাত শারমিন তানিয়া।
অগ্নিনির্বাপণের প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তিত। বারবার বলেও সমাধান পাইনি। আমাদের কিছু সিলিন্ডার থাকলেও সেগুলোর মেয়াদ নেই। তা ছাড়া এসব কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। মোটকথা, এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত লোকবল নেই। কিছুদিন আগে হলে আগুন লাগার কথা ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। আমরা নিদানের ব্যবস্থার জন্য প্রকৌশল দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেই যাচ্ছি।’
ফায়ার সার্ভিস ও গণপূর্তের ছাড়পত্রহীন ভবনে হলের কার্যক্রম চলছে কি না জানতে চাইলে নুসরাত শারমিন বলেন, ‘আমাদের ডিপিডি ও প্রকৌশল দপ্তর বলেছে, সব অনুমোদন আছে। তবে তারা আমাদের কোনো ডকুমেন্ট দেয়নি।’
একই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দশতলা বঙ্গবন্ধু হল, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন, কলা ও বিজ্ঞান ভবনসহ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ডরমিটোরি, কোয়ার্টার ও প্রশাসনিক ভবনের। এমনকি নির্মাণাধীন কোনো ভবনের নকশার অনুমোদন নেই।’
আগুন নেভানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫৪টি সিলিন্ডার থাকলেও অধিকাংশের মেয়াদ নেই; এসব ব্যবহারের নিয়মও কেউ জানে না। অগ্নিনির্বাপণের কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজনও নেই। ১৫৪টি সিলিন্ডারের মধ্যে বঙ্গমাতা হলে ৬২টি, বঙ্গবন্ধু হলে ২২টি, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ৩০টি করে এবং প্রশাসনিক ভবনে ১০টি সিলিন্ডার রয়েছে বলে জানা গেলেও জায়গামতো সেগুলো দৃশ্যমান নয়।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গমাতা হলে আগুন লাগার গুজবে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালেও নিতে হয়েছিল। এরপর প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।
৫৭ একরের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো পানির উৎস নেই। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পানির ব্যবস্থা কীভাবে হবে তা নিয়ে শঙ্কিত ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এত বড় ভবনের আগুন নেভানো তাদের রিজার্ভের পানি দিয়ে সম্ভব নয়।
আগুন নেভানোর সরঞ্জামের ঘাটতি ও ছাড়পত্র না থাকলেও তাদের প্রস্তুতি রয়েছে বলে মনে করেন পরিকল্পনা ও ওয়ার্কস দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব হোসেন। হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার রয়েছে। আগুন লাগলে সেখান থেকে পানি সরবরাহ করা যাবে। আর জলাশয় নির্মাণের কাজ চলছে। ভবিষ্যতে ছাড়পত্রের বিষয়টি দেখা যাবে। আগুন লাগলে সৃষ্টিকর্তা না চাইলে আমাদের প্রস্তুতি দিয়েও লাভ হবে না। যা হয়ে গেছে, তা তো হয়েই গেছে।’
ভবনের গণপূর্ত ও ফায়ার সার্ভিসের সনদ না থাকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার ধারণা নেই। সংশ্লিষ্ট দপ্তর বলতে পারবে। যদি সেসবের প্রয়োজন থাকে আর আমাদের সেসব না থেকে থাকে, তাহলে আমরা প্রশাসনিকভাবে সেসব নিয়ে কাজ করব। এসব বিষয়ে দ্রুতই চিঠি দেওয়া হবে।’
বঙ্গমাতা হলের শিক্ষার্থী ফাইজাহ ওমর তূর্ণা বলেন, ‘আমরা আতঙ্কে থাকি। সারা দেশে যেভাবে আগুন লাগছে, চিন্তা হয়। আমাদের এত বড় হল, তার আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা নেই; যা আছে তা ব্যবহার করতেও জানি না আমরা। আগুন লাগলে ভয়েই মরে যাব।’
বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থী ফাহমিদ অর্ক বলেন, ‘আগুন নেভানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা। সত্বর সুরাহার ব্যবস্থা করা উচিত।’
অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিয়াদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেব।’
একজন পেশাদার ফুটবলারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন থাকে নিজ দেশের হয়ে খেলা। একই স্বপ্ন হৃদয়ে বুনে নাইজেরিয়ায় ফুটবলকে ক্যারিয়ার হিসেবে এক সময় বেছে নিয়েছিলেন এলিটা কিংসলে। তবে তার জীবনে যে এমন বাঁক বদল ঘটবে কে জানত। মাতৃভূমির জার্সিতে খেলার স্বপ্নপূরণ হওয়ার নয় যখন দেখলেন, তখন একপ্রকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে ফুটবলটা পেশা বলেই আরও দশজন আফ্রিকানের মতো ফুটবল ফেরি করতে তিনিও পাড়ি জমান বাংলাদেশে। সেই সিদ্ধান্তই অবশেষে এলিটার জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন পূরণ করেছে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব মিলে যায় ২০২১ সালে। এরপর থেকেই অপেক্ষা লাল-সবুজ জার্সি গায়ে মাঠে নামার। সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে গত শনিবার। সিলেশসের বিপক্ষে সিলেটে ৩৩ বছরের এলিটা বদলি হিসেবে খেলতে নামেন বাংলাদেশের হয়ে। তাতে হয়ে যায় ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের ভেলায় চেপে এলিটা চান লাল-সবুজের ক্যারিয়ারটাকে দীর্ঘায়িত করতে।
শনিবার নেমেছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে। বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেকের দিনটা রাঙাতে জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন গোলের। দুবার লক্ষ্যে শটও নিয়েছিলেন। তবে হয়নি। না হওয়ার কষ্টটা আছে। তবে ততটা তীব্র নয়। একটা স্বপ্ন পূরণের পর গোলের পরের লক্ষ্যটা ঠিকই ছুঁয়ে ফেলার রসদটা কুড়িয়ে নিয়েছেন শনিবারের শেষ ৪৫ মিনিট থেকে। গতকাল সকালে টিম হোটেলে প্রিয়তমা স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেছে এলিটাকে। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি লেগেই ছিল। অভিষেকেই দল জিতেছে, তৃপ্তিটা তাতেই, ‘এটা আমার জন্য একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই দিনটির দেখা পেয়েছি আমার স্ত্রী ও কন্যার অনেক আত্মত্যাগ, বাফুফের আন্তরিকতা ও কোচের আমার প্রতি আস্থার জন্য। অভিষেকেই দল জয় পেয়েছে। আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম ব্যবধান বাড়ানোর। স্কোরশিটে নিজের নাম তুলতে পারলে আনন্দটা বহুগুণ বেড়ে যেত। তবে আমি হতাশ নই। বরং অনেক কারণেই অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।’
২০২১ সালে বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর থেকেই জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নটা বড় আকার ধারণ করে। তবে অনেক শঙ্কাও ছিল। মূলত তাকে খেলানোর ব্যাপারে বাফুফে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করেনি। তাই বসুন্ধরা কিংসের হয়ে এএফসি কাপ খেলে ফেলার পরও জাতীয় দলের দরজাটা খুলছিল না। চলতি মৌসুমে আবাহনীর হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে তার প্রতি আগ্রহ বাড়ে জাতীয় দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার। সৌদিতে দুই সপ্তাহের আবাসিক ক্যাম্পেও কোচের আস্থা আদায় করে অবশেষে সিশেলসের বিপক্ষে খুলে যায় ভাগ্যের দরজা। এখন জাতীয় দলের ক্যারিয়ারটা যতটা সম্ভব লম্বা করাই তার লক্ষ্য, ‘আমার যেই বয়স, তাতে ফুটবল চালিয়ে যেতে হলে শরীরের প্রতি অধিকতর নজর দিতে হয়। শরীরের যতœটা আমি সবসময়ই গুরুত্ব দিয়ে নিই। সেটা না করলে এতদিনে চোটে পড়ে খেলাই ছাড়তে হতো। তাই শরীরটা যতদিন চাইবে, খেলাটা চালিয়ে যাব। আশা করি লম্বা সময় বাংলাদেশকে সার্ভিস দিতে পারব। তবে তার আগে আমার ওপর যে কারণে দেশ আস্থা রেখেছে, নিয়মিত গোল করে চাইব সেটার প্রতিদান দিতে।’
কাল সিশেলসের বিপক্ষে প্রীতি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। হয়তো কালই গোলের দেখাটা মিলে যাবে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম নাগরিকত্ব পরিবর্তন করে জাতীয় দলে খেলা ফুটবলারের।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম। দারুস সুন্নাহ ওয়াল ফিকর, মিরপুরের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম এবং মিরপুর সাংবাদিক এলাকার মসজিদে ফারুকের খতিব। হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন- রমজানের আমল, ইমামের গুণাবলি ও হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতাসহ সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জামিল আহমদ
দেশ রূপান্তর : বায়তুল মোকাররমে প্রথম ইমামতির স্মৃতি?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : ছাত্রজীবনে পল্টন ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে মাঝে-মধ্যে আসতাম। তখন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ঘুরে ঘুরে দেখতাম। নামাজের সময় নামাজ আদায় করতাম। তখন আকারে ছোট থাকলেও পরিবেশ ছিল খুব সুন্দর। এখন আকার বড় হলেও বিভিন্ন কারণে জাতীয় মসজিদে আগের সেই মনোরম পরিবেশ নেই।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে যখন প্রথমবার ইমামতি করলাম, জায়নামাজে দাঁড়ানোর আগে কিছুটা ভয় কাজ করছিল জাতীয় মসজিদ বলেই, ভয়ে ভয়ে নামাজ পড়ানোর পর অন্তর থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। যেখানে নামাজ পড়ানোর স্বপ্ন ছিল সেখানের ইমাম হয়েছি। এখন সিনিয়র পেশ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আর এটা হয়েছে আমার উস্তাদবৃন্দ ও মা-বাবার দোয়ার বরকতে।
দেশ রূপান্তর : ইমামদের কাছে রমজান মাস কি আলাদা কিছু?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : সব মাসই ইমামদের কাছে সমান। তবে রমজান মাস একটু বেশি গুরুত্ববহ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইমামরা হলেন দায়িত্বশীল।’ সেই দায়িত্ব শুধু নামাজের ক্ষেত্রে নয়। তিনি সমাজকে নেতৃত্ব দেবেন। সাধারণ মানুষকে পথ দেখাবেন। সংগত কারণেই রমজান মাসে এ দায়িত্ব বেড়ে যায় বলে মনে করি। রমজান হলো- ইবাদতের বসন্তকাল। তাই নিজে বেশি বেশি ইবাদতে মশগুল হওয়ার পাশাপাশি সমাজের সবাই যেন ইবাদতে বেশি বেশি মশগুল থাকতে পারে সেই চিন্তা থেকে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করা। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান হলো- একে অপরের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মাস। অন্যের প্রতি ভালোবাসা ও দয়া দেখানোর মাস।’ কাজেই সমাজের বিরাজমান সমস্যাবলি (মানুষে মানুষে দূরত্ব, হিংসা ইত্যাদি খুব বেশি) দূরীকরণে ভূমিকা রাখো। সমাজের হতদরিদ্র, যারা আর্থিক সমস্যার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য বিত্তশালীদের পেছনে মেহনত করা। মানবিক কাজে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা একজন ইমাম সাহেব সবচেয়ে বেশি করতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : একজন আদর্শ ইমামের কী কী গুণ থাকা উচিত বলে মনে করেন।
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : আদর্শ ইমামের গুণাবলি অনেক। মৌলিকভাবে, ইমাম হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকবে। ব্যক্তিজীবেন তিনি তাকওয়াবান ও পরহেজগার হবেন। অর্জিত জ্ঞানের আমল থাকবে। আকিদাগতভাবে সহিহ আকিদার অনুসারী হবেন। দেশ ও জাতির উদ্ভূত নানাবিধ সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা এবং সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতার পাশাপাশি সংকটকালীন দিকনির্দেশনা দেবেন।
দেশ রূপান্তর : সমাজে ইমামদের আশাতীত প্রভাব নেই। কেন নেই?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : সমাজে ইমামদের আশাতীত প্রভাব না থাকার অনেক কারণ রয়েছে। সবগুলো আলোচনা করার মতো নয়। তবে মোটাদাগে আমার কাছে মনে হয়, যারা ইমাম আছি তাদেরই দুর্বলতা বেশি। হয়তো আমলের কমতি, আখলাকে ঘাটতি কিংবা তাকওয়া কমসহ অনেক দুর্বলতা রয়েছে। তাই আশাতীত প্রভাব পড়ছে না। সমাজে প্রভাব বিস্তারের জন্য ইমামদের উচিত, নিজেকে আগে পরিশুদ্ধ করা, জ্ঞানার্জনে পাকাপোক্ত হওয়া এবং পরিপূর্ণ আখলাকি (চরিত্রবান) মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এসবের সমন্বয়ে নিজেকে গড়তে পারলেই একজন ইমাম সমাজে প্রভাব বিস্তারে সফল হবেন। ইমাম তখন সত্যিকারের ইমামে (নেতা) পরিণত হবেন।
দেশ রূপান্তর : ইমামদের নিয়ে আপনার কোনো স্বপ্ন আছে?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : অবশ্যই আছে। আমি মনে করি, দেশের সব ইমামের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকা উচিত। এমন একটা প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ থাকা, যেখানে দুনিয়ার কোনো স্বার্থ থাকবে না, থাকবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকলে দুনিয়াতে লাভবান হবেন, মুক্তি পাবেন পরকালেও। তাদের কাজ হবে, দেশ-জাতি ও ধর্মীয় যেকোনো ইস্যুতে একযোগে ভূমিকা রাখা।
আরেকটা বিষয় হলো- শহর বা শহরতলি এলাকার মসজিদগুলোর ইমামরা মোটামুটি সম্মানী পেলেও মফস্বলের ইমামরা কিন্তু সেভাবে সম্মানী পান না। অনেক জায়গায় দেখা যায়, অনেকদিনের সম্মানী অপরিশোধিত রয়ে গেছে। এ অবস্থা নিরসনে সরকারি-বেসকারিভাবে একটি ফান্ড তৈরি করা, যেখান থেকে ইমামদের বিপদে-আপদে, সংকটে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা যায়।
আমার কাছে মনে হয়, মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে ইমামের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। ইমাম এমন হবেন না, কমিটি থেকে নির্দেশ এলো এটা করেন; ইমাম সাহেব তা পালন করবেন। বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ই তিনি যুক্ত থাকবেন, নিজের মতপ্রকাশ করবেন। ইমামদের উদ্দেশ্যে আমার কথা হলো- আল্লাহ যাকে যে জ্ঞান দিয়েছেন তা চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ইলম অনুযায়ী আমলি জিন্দেগি গঠনে সচেষ্ট হওয়া। মানসিকভাবে আরও উদার হওয়া, পরিচ্ছন্ন মনোভাব ধারণ করা। চিন্তাভাবনা পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করা, সর্বোপরি নিজেকে আগে পরিশুদ্ধ করা।
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি হাফেজদের নিয়ে একটি হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন, কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমন কাজের সঙ্গে আমি অনেক আগে থেকেই যুক্ত। বিগত এক যুগ যাবৎ বাংলাদেশে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা বিভিন্নভাবে হয়। জেলা, থানা, বিভাগভিত্তিক হয়। যার অনেকগুলো মিডিয়াতে আসে না। এসব প্রতিযোগিতা আয়োজনে অনেকেই এগিয়ে আসছেন, আগামীতে আরও এগিয়ে আসবেন বলে আশা রাখি।
বেশকিছু টেলিভিশনেও এখন নিয়মিত হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন ও প্রচার হয়। এসব প্রতিযোগিতাকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। এর দ্বারা কোরআন হিফজে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত অল্প বয়সেই অনেকে হাফেজে কোরআন হচ্ছে। এখানে যেমন গরিবের সন্তানরা আছেন। আছেন সমাজের বিত্তশালী পরিবারের সন্তানও। আরও ব্যাপকভাবে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা আয়োজনে বড় বড় শিল্প পরিবারের এগিয়ে আসা দরকার।
দেশ রূপান্তর : বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জয়ী হাফেজরা ভালোমানের আলেম হয় না, আপনি কী মনে করেন?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলে অনেক পুরস্কারের পাশাপাশি নাম-যশ হয়। পুরস্কার আর নাম-যশের মোহ যাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে তাদের একটা অংশ নিয়ে আমরা ব্যথিত। তারা মেধাবী কিন্তু তাদের মেধার যথাযথ বিকাশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্য আলেম হওয়া কিংবা কোরআন বুঝার জন্য ব্যয় করতে পারছে না। অনেকের শিক্ষাজীবন পূর্ণতাও পায় না। এদিকে তারা অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো- প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে হাতে টাকা আসে, পরিচিত হয় এবং সেটা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাহ্যত নাম-সুনাম হলেও এর দ্বারা সে কিন্তু দুনিয়ার পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখানে আমাদের উস্তাদরা কাজ করবেন, বুঝাবেন, প্রয়োজনে শাসন করবেন। এর পাশাপাশি অভিভাবক ও মা-বাবাসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সচেতন হলে আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
দেশ রূপান্তর : রমজান উপলক্ষে দেশবাসীকে কোনো পরামর্শ দিতে চান কি?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান হলো- রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, রমজান যখন শুরু হয়, তখন আসমান থেকে দুজন ফেরেশতা নেমে আসেন। একজন ফেরেশতা বলেন, হে কল্যাণকামী! তোমরা যারা কল্যাণের পথে আছো তোমরা আরও এগিয়ে চলো। দেশ ও জাতির কল্যাণে আরও এগিয়ে যাও। আরেকজন ফেরেশতা বলেন, তোমরা যারা অন্যায়ের পথে আছো। অন্যায় করে ফেলেছ। এবার থামো! রমজান শুরু হয়ে গেছে। এখন অন্যায়, পাপ, নাফরমানি বন্ধ করো। দেশ ও জাতির ক্ষতি হয়ে এমন কাজ বন্ধ করো।’ রাসুল (সা.) যে শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন, তা সামনে নিয়ে পথ চলা। সব ধরনের অন্যায়-অনাচার পরিত্যাগ করে কল্যাণের পথে ফিরে আসা। অপরকে অন্যায়ের পথ থেকে ফিরে আসতে সহযোগিতা করা।
মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীর দুই বছরের কারাদণ্ড এবং এর ফলে লোকসভায় তার সদস্যপদ হারানোকে শাপে বর হিসেবে দেখছে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস। রাহুলের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন বিজেপির দমনমূলক পদক্ষেপের প্রতিবাদে রাজপথে সরব ভারতের সবচেয়ে পুরনো দলটি। প্রতিবাদে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন গান্ধী পরিবারের আরেক চেনা মুখ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। রাহুলের সংসদ সদস্য পদ খারিজের প্রতিবাদে গতকাল রবিবার পুলিশি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটে ‘সংকল্প সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেস। এতে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘কাপুরুষ ও অহংকারী’ আখ্যা দিয়ে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, ‘চাইলে আপনি আমাকেও গ্রেপ্তার করুন।’ কেবল মোদি পদবি নিয়ে কটাক্ষ করায় ভাই রাহুলের কারাদণ্ড ও সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়ার প্রতিবাদে বিজেপির সাম্প্রতিক প্রবণতার তীব্র সমালোচনা করেন প্রিয়াঙ্কা। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই শহীদের ছেলে। তাকে আপনারা মির জাফর বলেছেন। আমার মাকে অসম্মান করেছেন। আপনার দলের এক মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাহুল তার মায়ের নাম জানেন না। প্রতিদিন আপনি আমাদের পরিবারকে অপমান, অসম্মান করে চলেছেন। অথচ কোনো মামলা হয় না! কারও সাজা হয় না!’
রাহুলকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি বিরোধী ঐক্যের সুযোগ হয়ে উঠতে পারে, সেই উপলব্ধি কংগ্রেসের হয়েছে। সংসদ সদস্য পদ খারিজের ঘোষণার পর যেভাবে বিরোধী দলের নেতারা সরকারের বিরোধিতা ও কংগ্রেসের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে সেই সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসও তাৎক্ষণিক সব বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানায়। পরের দিন রাহুল নিজেও সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদের ধন্যবাদ জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। রবিবার সত্যাগ্রহ মঞ্চ থেকে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও সেই প্রসঙ্গের অবতারণার পর প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘আজ সব দল আওয়াজ উঠিয়েছে। প্রত্যেককে আমরা এ জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। জোটবদ্ধ হতে হবে, কারণ দেশ আজ গভীর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।’
রাহুল ইস্যুতে বিরোধীদের একজোট হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন কংগ্রেসের সুপরিচিত নেতা শশী থারুর। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে শশী বলেন, ‘রাহুল গান্ধীর কারাদণ্ড ও সংসদ সদস্যপদ কেড়ে নেওয়ার ঘটনায় একটি ভালো দিক দেখা যাচ্ছে। এ ঘটনা নজিরবিহীনভাবে বিরোধী ঐক্যের সম্ভাবনা জাগিয়েছে। যারা আঞ্চলিক রাজনীতিতে কংগ্রেসকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে, তারাও আজ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে সদ্য কংগ্রেস সভাপতির পদে লড়া এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘আমরা এখন দিল্লির কেজরিওয়াল, বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, হায়দরাবাদের কে চন্দ্রশেখর রাওকে দেখছি। এই নেতারা আগে কখনোই কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোভাবেই একাত্ম হননি।’
এদিকে মোদিকে অপমানের অভিযোগে রাহুলের সাজার অস্বস্তি হয়ে এসেছে খোদ বিজেপির ঘাড়েও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল বিজেপির এক নারী নেত্রীর মন্তব্য। খুশবু সুন্দার নামের এই বিজেপি নেত্রী ২০১৮ সালেও ছিলেন কংগ্রেস পার্টির নেত্রী। সে সময় তিনি টুইটে লিখেছিলেন, ‘সব জায়গায় মোদি, কিন্তু এটা কী? “মোদি” পদবি দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মোদির নাম পাল্টে দুর্নীতি রাখা উচিত।’ অবশ্য এখন তিনি বলছেন, সে সময় দলের নেত্রীর অনুসরণেই এসব লিখেছিলেন। এর জন্য তিনি দায়ী নন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।