
আমাদের হাজারো সমস্যার মধ্যে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অন্যতম। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশে ১১ জুলাই ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালিত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে নানা নির্দেশনা জারি করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এ দেশে বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের জন্য সুখবর হলো, দেশের মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৬০ সালে এ ভূখণ্ডের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক কোটি, যা বর্তমানে অনেক গুণ বেড়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ১৯৮৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে পৌঁছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালন করে আসছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এর দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে প্রায় ১২৩ বছর। ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটিতে। এরপর ৩২ বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩০০ কোটিতে। ১৯৭৪ সালে অর্থাৎ ১৫ বছর পর বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪০০ কোটিতে। ৫০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আরও কম। মাত্র ১৩ বছরে ১৯৮৭ সালে জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে বৃদ্ধি পায়। প্রতি ১২ বছরে বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ কোটি করে। ১৯৯৯ সালে ৬০০ কোটি। ২০১১ সালে ৭০০ কোটি। সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বরে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায়, প্রায় ৮০০ কোটিতে।
এভাবে বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে ১০০০ কোটি অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়াতে সমস্যার বেড়াজালে আমরা আটকে যাচ্ছি, জনসংখ্যা বানের পানির মতো বাড়ার কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেশ উদ্বেগজনক। বিবিসি ও ইউএনএফপির প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হলো ‘ঢাকা’।
জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে খাদ্যাভ্যাস ও অপুষ্টির কারণে। সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা ও ওজন স্তরের ধ্বংসসহ বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। তার ওপর ঘাড়ে চাপছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে একমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি।
সরকারের একক প্রচেষ্টায় এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে না। দিবস পালনের সুফলও সুদূর পরাহত। যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে আগে সেই স্থান চিহ্নিত করতে হবে। ওই এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুফল-কুফল বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। আলোচনায় শামিল করতে হবে সাধারণ জনগণকে। শহরের বস্তিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। কারণ এরা অশিক্ষিত। নিম্নশ্রেণির মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়। তারা এ পদ্ধতিকে সহজভাবে মেনে নেয় না, গুরুত্বও দেয় না। দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে না আবাদি জমি। বাড়ছে পরিবারে সদস্য সংখ্যা, বাড়ছে না আয় রোজগার। বাড়ছে প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম। আয়-ব্যয়ের তাল মেলানো যাচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বদৌলতে আগের চেয়ে বর্তমানে মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারব- মৃত্যুহার কমেছে ঠিকই, জন্মহার বেড়ে গেছে। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন জীবনে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা নিঃস্বার্থভাবে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এ বিভাগের পরিবার কল্যাণ সহকারীরা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে এখনো বেশকিছু কুসংস্কার রয়েছে। কুসংস্কার দূর করে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পরিকল্পনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালালে হয়তো এর সুফল আগামী প্রজন্ম পাবে। নতুবা সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমাদের এগোতে হবে একটা বিষয় নির্ধারণে। আর সেটি হলো ‘পরিকল্পিত পরিবার’। এ সময়ে পরিকল্পিত পরিবারের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে সম্প্রতি কিছু নিয়মকানুন সৃষ্টি হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। পরিবার পরিকল্পনা সহকারীরা যার যার এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে নিজের ছবি তুলে নির্দিষ্ট গ্রুপে দিতে হবে। অফিসাররা এগুলো মনিটরিং করে। কোনো কর্মী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেনো ছবি পোস্ট করল না তা জানতে চায় সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। এভাবে যদি কর্মীদের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহলে তাদের মনমানসিকতা কোন পর্যায়ে থাকতে পারে, তা ভাবার বিষয়। কর্মীরা কলুর বলদের মতো মাঠে কাজ করবে সারাদিনমান। আবার কর্তাদেরও হাজিরা দেখাতে হবে, স্ব-স্ব এলাকায় পৌঁছে সাড়ে ৯টার মধ্যে নিজের ছবি পোস্ট করে! এভাবে হলে নারীরা নিয়ম পালনে অধিকতর মনোযোগী হবে না।
সম্ভবত পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের নারী কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন তেমন করেন না সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। যে কোনো কাজে উৎসাহিত করা গেলে সন্তোষজনক আউটপুট আসে। কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক চাপে রাখলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিশ্চয় ব্যাঘাত ঘটবে। সরকারের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সমস্যা হতে পারে। বিজ্ঞজনদের অভিমত, বর্তমান ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম বিষয় হচ্ছে, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া। এ নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অর্থ পাচারকারী কারা, যদি সেই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, তাহলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সহজ হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে, এরা এরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন।’ তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক। কিছু টাকা পাচারকারীর নাম এসেছে পত্রপত্রিকায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদকের কিছু তৎপরতাও দেখেছে জনগণ। কিন্তু এ পর্যন্তই। পরবর্তী সময় এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আর কোনো শোনা যায়নি।
ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি। সবাই জানেন, এই গ্রুপের মালিকানায় বাংলাদেশে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও একাধিক ব্যাংক আছে। এটা কোনো জাদুমন্ত্রে ঘটেনি। ইসলামী ব্যাংক থেকে তারা একাই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর আগে দুটি ভুয়া কোম্পানি খুলে, একই ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা নেওয়া হয় ঋণের নামে এবং আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ উঠে এবং কিছুক্ষণ পরে মিলিয়ে যায় তেমনি বাংলাদেশের দুর্নীতিসংক্রান্ত সংবাদের পুকুরে এসব খবর ঢেউ তুলে মিলিয়ে যায় বারবার। কিন্তু জনগণ হারায় তাদের সম্পদ আর আমানত। বিপরীতে সম্পদে ফুলে উঠে এসব প্রতিষ্ঠান।
বিশ^ব্যাপী টাকা পাচার নিয়ে কাজ করা যে সংস্থাটি বহুল পরিচিত সেটি হচ্ছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বা জিএফআই। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জিএফআই বাংলাদেশসহ ১৩৪টি দেশের অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেখানে অন্য সব দেশের হালনাগাদ তথ্য থাকলেও বাংলাদেশের তথ্য ছিল পুরনো, ছয় বছর আগের, অর্থাৎ ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যেও আবার সেখানে ২০১৪ সালের হিসাব ছিল না! ২০১৪ সাল বাদ দিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের যে তথ্য দিয়েছে জিএফআই, সেখান থেকে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণের একটা গড় ধারণা পাওয়া যায়। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছিল। রিপোর্ট প্রকাশকালের বিনিময় হার হিসেবে ধরলে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) ওই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। আবার রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ২০১৫ সালের পর থেকেই জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। তথ্য নেই বলে কি দেশ থেকে টাকা পাচার থেমে আছে? এক বাক্যে উত্তর হবে, না।
এই খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে, সুইস ব্যাংকগুলোতেও বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, আবার আকস্মিকভাবে কমছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছিল, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বেড়েছে।
সরকারের দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের অন্যতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার সত্যতা কিছুটা তিনি পেয়েছেন। আর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া ২৮টি ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের অবৈধ অর্থের প্রবাহের বড় উৎস হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ‘গ্র্যান্ড’ বা মহা দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ, যেমন চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার, ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারি ও দ্রুত অবলোপন, জাল-জালিয়াতি, অবৈধভাবে কর্মরতদের বিদেশিদের অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন এবং বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়ে ও প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন লঙ্ঘন করে তা পাচার। আর অর্থ পাচারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের আধুনিক জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ। এসব দেশও আবার প্রলোভনের জাল বিছিয়ে রাখে। ফলে বিনিয়োগ ভিসা, স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বসবাসের অনুমোদন, বিভিন্ন সেকেন্ড হোম প্রকল্প ও নমনীয় বিনিময় হারের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নাগরিকদের অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করছে।
এখানেই শেষ নয়, টাকা পাচারের পাশাপাশি চুরির ঘটনাও আছে। সম্প্রতি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে নির্মিত বলিউডের তথ্যচিত্র ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ মুক্তি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ চুরির ঘটনা সারা বিশে^ আলোড়ন ফেলেছিল। মনে করা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক অপরাধগুলোর একটি। ২০১৬ সালের সেই ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সাল পিকচার্স হোম এন্টারটেইনমেন্ট।
এক দল হ্যাকার কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদের সামান্য একটি ভুল টাইপের কারণে আরও ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রক্ষা পায় বাস্তব এই গল্পই দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, ৫ কারণে টাকা পাচার হয়। এগুলো হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। ক্ষমতার ছায়া এবং ছোঁয়া পেলে তা যে আলাদিনের চেরাগের চেয়ে দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়িয়ে দিতে পারে, তার নজির অনেক। তাদের এই সম্পদ তারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দেশে দেশে জমা করছেন। অর্থ পাচারের বড় কেন্দ্র দুবাই, এরপর সিঙ্গাপুর হলো নিরাপদ পাচার কেন্দ্র।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ। শোষণমুক্ত দেশ গড়ার সেই আবেগের পেছনে প্রশ্ন ছিল কারা শোষণ করে? ফলে শত্রু যেমন ছিল তেমনি শত্রুকে চিনে নেওয়ার তাগিদ ছিল। রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছে; তেমনি গান, কবিতা, নাটক, সিনেমার ভূমিকাও কম নয়। সেই সময় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রাজনৈতিক পোস্টারের ভূমিকা কম ছিল না। যে ঐতিহাসিক পোস্টার ’৭০-এর নির্বাচনে জনমতকে প্রভাবিত করেছিল তা হলো সোনার বাংলা শ্মশান কেন? সেদিনের বৈষম্য ও লুণ্ঠনের চিত্র এমনভাবে ফুটে উঠেছিল সেই সাদামাটা পোস্টারের লেখায়। এই পোস্টার কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়নি। আজ স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রশ্ন তুলতে হবে বৈষম্য এত তীব্র কেন? পুঁজিবাদী শোষণ, দুর্নীতি, টাকা পাচার মিলে সোনার বাংলাকে ফাঁকা এবং ফাঁপা করে ফেলেছে যে শাসক গোষ্ঠী, তাদের চিহ্নিত করাই শুধু নয়, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলাটাও জরুরি।
দৈনিক ইত্তেফাকে কলাম লিখতেন- ‘মোসাফির’ নামে। অসাধারণ শব্দনৈপুণ্যে বিদ্ধ করতেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানকে। সেইসময় অসংখ্যবার তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে আজ ছাপা হলো, সেই উপসম্পাদকীয়
পারতসাধ্যে পাকিস্তান রেডিও শুনি না। সরকারী প্রচারযন্ত্রে এই ধরনের একতরফা প্রচারের নজির বিশেষত: নির্বাচনকালে দুনিয়ার কোন গণতান্ত্রিক দেশে নাই। গত ১৫ই নভেম্বর ঢাকা মেল ধরিবার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ৬টা হইতে রাত্রি সাড়ে ৮টা পর্যন্ত একটি প্ল্যাটফরমে অবস্থান করিতেছিলাম। সেখানে একটি ট্রানজিস্টারে ৬টা ৭টা ও রাত্রি ৮টার তিনটি নিউজ বুলেটিনেই অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেবের প্রচারিত একটি বিবৃতি একইভাবে প্রচার করা হইল। বর্তমান শাসনামলে পুঁজিপতি শিল্পপতিদের সৌভাগ্য ও উন্নতিকে দেশবাসীর উন্নতি-অগ্রগতি বলিয়া চালাইবার প্রচেষ্টাই ছিল এই বিবৃতির লক্ষ্য। আর সেই বিবৃতি দুই ঘণ্টার মধ্যে তিনবার প্রচারিত হইলে শ্রোতাদের মনে বিরক্তিভাব না জাগিয়া পারে না, রেডিও কর্তৃপক্ষের সেদিকেও নজর নাই। কর্তার ইচ্ছায় কের্তন! তাই শ্রোতাদের ভাল লাগুক আর না লাগুক, শুভ প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হউক আর যাই হউক, তার প্রতি লক্ষ্য দিবার এখতিয়ার তাঁদের নাই। আফসোস হয় কর্তাব্যক্তিদের জন্য- যারা জানেন যে, রেডিও এবং অন্যান্য প্রচারযন্ত্র মারফত ছয় বৎসর ধরিয়া একতরফা প্রচার চালাইয়াও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় নাই এবং হয় নাই বলিয়াই সর্বত্র বর্তমান শাসক ও শাসন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভ দেখা দিয়াছে। এই ত্যক্তকর নিউজ-বুলেটিন প্রচারের পরে হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বেতার ভাষণ শ্রুত হইল।
প্রথম দিকে তিনি ভাল ভাল কথাই বলিয়াছেন নির্বাচনকালে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় জনগণের সহযোগিতার কথাই বলিয়াছেন। পর্যুদস্ত ছদ্মবেশী কনভেনশনপন্থী প্রার্থীরা এখানে-ওখানে গু-ামির আশ্রয় নিলেও প্রদেশের প্রধান প্রশাসক হিসাবে গভর্নরের এই আবেদনের একটা নৈতিক দিক রহিয়াছে। কিন্তু আফসোস, এই আবেদনটুকু শেষ হইতেই তিনি রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া বেতার মারফত এমন কতকগুলি কথা বলিলেন যাহা শুধু বিতর্কমূলকই নয়, বিভ্রান্তিমূলকও বটে। তিনি অবশ্য মি. হাশিমুদ্দীনের মতো নির্লজ্জ দাবী করিতে ভরসা পান নাই যে, কনভেনশনপন্থীরা শতকরা ৮০টি আসন দখল করিতেছে। তবে তিনি নির্বাচকমন্ডলীর নির্বাচনে শতকরা ৮৫ জন ভোটারের অংশগ্রহণকে বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সমর্থন বলিয়া দাবী করিয়াছেন। এবং রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে কটাক্ষের সুরে বলিয়াছেন যে, জনগণের যদি ভোটাধিকার না থাকিবে, তাহা হইলে দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করা হইতেছে কেন? গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির নিকট হইতে এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা কেহ আশা করে নাই। সুস্পষ্ট নীতির ভিত্তিতে নির্বাচকম-লীর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে।
মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নার নেতৃত্বে জনগণের ছিনাইয়া নেওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়া পাইবার দাবীতেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে। এই ৪০ বৎসরের মধ্যে ইউনিয়ন বোর্ড ইলেকশনে কখনও গোটা দেশবাসীর মধ্যে এইরূপ প্রাণচাঞ্চল্য ও জাগরণ লক্ষ্য করা যায় নাই; স্থানীয় লোকজনেরাই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইহাতে উৎসুক্য প্রদর্শন ও অংশগ্রহণ করিয়াছে। আজিকার দাবী হইল আইন পরিষদের প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার ফিরাইয়া পাওয়া এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলকে স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে মর্যাদার সহিত অব্যাহত রাখা। তাই যাঁরা এই নির্বাচনে জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করিয়া রাখার পক্ষে জনগণের সম্মতি বলিয়া প্রচার করিতে পারেন, তাদের সত্যের প্রতি যে কোন শ্রদ্ধা নাই তাহা না বলিয়া উপায় থাকে না। আমার নিজ অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি যে, একদম কাট্টা কনভেনশনপন্থী চেয়ারম্যান-মেম্বাররও আইয়ুব সাহেবকে ভোট দিবেন এই কথা বলিতে পারিতেছেন না। তারাও মিস জিন্নাকে ভোট দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিতেছেন; বড় জোর দুই-এক জায়গায় তাঁরা বলিতেছেন, জনগণ যাকে ভোট দিতে বলিবেন, সেদিকেই তাঁরা ভোট দিবেন।
আমরা জানি, আইয়ুব সাহেব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিবার জন্য যে কোনো পন্থা অবলম্বন করিতে পারেন। তার কারণও আছে। কিন্তু যাঁরা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া জনমতের এবং দেশবাসীর স্বার্থে বিরুদ্ধাচরণ করিয়া কর্তার ইচ্ছায় কের্তন করেন কিংবা নিজেকে অতিভক্ত ও উৎসাহী বলিয়া প্রমাণ দিতে চেষ্টা করিতেছেন, তাঁদের উদ্দেশে আমাদের কিছুটা বক্তব্য আছে। আইয়ুব সাহেবের নিজ প্রদত্ত বিবৃতি মতেই তিনি যখন ১৯৫৮ সালের ৮ই অক্টোবর ‘বিপ্লব’ অনুষ্ঠান করেন, তখন সামরিক হেড কোয়ার্টারে মাত্র চারিজন জেনারেলকে তিনি এই বিপ্লবের কথা জানান। জনাবরা একবার তাকাইয়া দেখুন, যাদের সহযোগিতায় সামরিক অভ্যুত্থান মারফত তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, আজ তাঁরা কোথায়। তাদের একজনও তাঁর সাথে আছেন? তাঁদের একজনও সাথে নাই; সবাইকে অপসারণ করা হইয়াছে; জেনারেল আজমের সহিত নীতির প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেওয়ায় তিনি তো এখন মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নার একজন পহেলা কাতারের সমর্থক। এই তো গেল চারিজন জেনারেলের কথা। জেনারেল ছাড়া যে-সকল বেসামরিক লোকজনকে তিনি বড় বড় পদ দিয়া সমর্থক সাজাইয়াছিলেন, তাঁরাই-বা আজ কে কোথায়?
কোন ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নাই। রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার তথা আমাদের সকলের অধিকার যাঁরাই মানিয়া নিবেন, দলমত নির্বিশেষে তাঁরা সকলেই আমাদের বন্ধু। জনগণের সরাসরি ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচনের নীতি স্বীকৃত হইলে জনগণই ভোটের মাধ্যমে কোন্ ব্যক্তি বা কোন্ দলকে শাসনক্ষমতায় বসাইবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে। তাই যাঁরা জনগণকে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দিতে নারাজ, তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করা ছাড়া উপায় কি?
আইয়ুব সাহেবের অসুবিধা কোথায়, তাহা আমরা কিছু কিছু জানি। তিনি আজ জনমতের চাপে পড়িয়া সামরিক অভ্যুত্থানের দায়িত্ব এড়াইতে চাহিলেও তাঁর তৎকালীন বিবৃতি-বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়া দেখানো হইয়াছে যে, তিনিই ছিলেন এই ‘বিপ্লবের’ প্রকৃত অধিনায়ক। তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরিয়াও নেই যে, তিনি নিজে উদ্যোগী হইয়া ‘বিপ্লব’ অনুষ্ঠান করেন নাই, তাহা হইলে তাঁকে সোজাভাবে জিজ্ঞাসা করা যায়, তিনি ছয় বৎসর ক্ষমতা ভোগ করার পরেও আজও দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিতে তথা জনগণকে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরাইয়া দিয়া গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তনে অনিচ্ছুক কেন? প্রকৃত অবস্থা হইল, তিনি যে শাসনতন্ত্র রক্ষা করিবার শপথ গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করার ব্যাপারে তাঁর হাত ছিল। তিনিই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়া তিন দিনের মধ্যে তাহা ভংগ করিয়া তিনি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক শাসকের দুইটি পদই দখল করেন। তিনিই জনগণের সুখ-শান্তি বিধান, দেশ হইতে দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতির উচ্ছেদ, মুনাফাশিকারী- চোরাকারবারীদের শায়েস্তা করার এবং দেশ হইতে কোটারী স্বার্থের মূলোচ্ছেদ করিয়া দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে-সকল প্রতিশ্রুতি দিয়া ছিলেন একে একে সেগুলিকেও ভঙ্গ করিয়াছেন।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর দুই মাস যাইতে না যাইতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং আজ উহা গগনচুম্বী; অবাধ অর্থনীতির নামে তিনি মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী- শিল্পপতিকে অবাধ মুনাফা অর্জনের সুযোগ দিয়াছেন; এক শ্রেণীর পুঁজিপতি-শিল্পপতি ও আমলাতন্ত্রের যোগসাজশে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতি ও অনাচার ব্যাপক আকার ধারণ করিয়াছে; শাসন-ব্যবস্থার ব্যয় হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিলেও ব্যয়ভার কমাইবার পরিবর্তে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে; বৈদেশিক দেনা তেত্রিশ গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এভাবে দেশ দেনায় ডুবু ডুবু এবং অপরদিকে দেশের সম্পদ ও ঐশ্বর্য মুষ্টিমেয় লোকের কুক্ষিগত হইয়া পড়িয়াছে এবং এই কুক্ষিগত হইয়া পড়িবার ফলে শুধু মুনাফাশিকারীরাই আসকারা লাভ করে নাই, এই স্বার্থবাদী ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এবং এক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ গণবিরোধী আমলাতন্ত্রের বদৌলতে দেশের সর্বত্র দুর্নীতির তা-ব নৃত্য সৃষ্টি হইয়াছে।
মৌলিক গণতন্ত্রীদের ইলেকটোরাল কলেজে পরিণত করাও এই ধরনের জনগণকে ডিঙ্গানোর একটি ব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলের সত্যিকার উন্নয়ন বিধানই যদি তাঁর কাম্য হইত তাহা হইলে ইউনিয়ন কাউন্সিলের হস্তে উৎপাদনমূলক কার্যে ব্যয় করিবার জন্য অর্থ প্রদান করিতেন। ১০ কোটি মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জনগণের ভোটাধিকার মাত্র ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর উপর ন্যস্ত করিয়া ইহাদেরও বিব্রত করিতেন না, আর জনগণকেও বিক্ষুব্ধ করিতেন না। কেনাবেচার আশ্রয় নেওয়াই যে আইয়ুব উদ্ভাবিত এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য, তাহাও আজ দেশবাসীর নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে।
যেখানে আজ জনগণের ভোটাধিকার ফিরাইয়া পাইবার সুনির্দিষ্ট ইস্যুর উপর ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে, যেখানে আজ ছদ্মবেশী প্রার্থীরাও কোথায়ও ‘আইয়ুব সাহেবকে ভোট দিব এই কথা বলিয়া ভোট যাচনা করিতে ভরসা পাইতেছে না, সেখানে গৃহকোণে বসিয়া আইয়ুব সাহেবের অনুগ্রহভোগীরা দাবী করিতেছেন যে, এই নির্বাচনে আইয়ুব সাহেবের সমর্থনে ৮০% আসন দখল করা হইতেছে প্রসঙ্গতঃ সম্মিলিত বিরোধী দল হইতে যাদেরকে কনভেনশনপন্থী বলিয়া স্বীকার করিয়া লওয়া হইতেছে, তারাও প্রকৃত প্রস্তাবে কোথায়ও কনভেনশনপন্থী বিশেষত: আইয়ুব সাহেবকে ভোট দিবেন এ পরিচয় দিতে পারেন নাই। তাই তাঁদের জয়ী হওয়ার প্রশ্ন অলীক হইলেও ইহার গূঢ় উদ্দেশ্য হইল ভোট ক্রয়ের পথ খোলা রাখা। এটা তাঁদের শেষ প্রচেষ্টা। কিন্তু জনসাধারণের বিরুদ্ধে সৃষ্ট বেড়াজাল যেমনি একে একে গণজাগরণের মুখে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পড়িতেছে, তেমনি এই শেষ প্রচেষ্টাও একইভাবে ব্যর্থ হইবে।
১৯৪৬ সালের পাকিস্তান ইস্যুর উপর নির্বাচনেও একই অবস্থা লক্ষ্য করিয়াছি, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও তাহাই দেখিয়াছি। গ্রামীণ জনগণের ঐক্য ও সচেতনতাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সম্ভব করিয়াছিল; ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয় তাদের দ্বারাই সম্ভব হইয়াছিল। যুক্তফ্রন্টের দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও জনগণের এই ছত্র বৃথা যায় নাই। কারণ, সেই বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষা বিরোধীরা নিরস্ত হয় এবং বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। সেই বিজয়ের ফলেই এই প্রদেশে বিনাবিচারে আটক প্রথা রদ করা হয় এবং এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ইহা একটি নজির হইয়া দাঁড়ায় : এই বিজয়ের ফলেই দেশবাসী ১৯৫৬ সালে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র লাভ করে; এই বিজয়ের সুফল হিসাবেই শিল্প-বাণিজ্য বিকেন্দ্রীকরণ করিয়া প্রদেশের হতে অর্পিত হয়; এই বিজয়ের ফলেই দেশে জনগণের সরাসরি ভোটে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি সম্পূর্ণ করা হয়। সেই কায়েমি স্বার্থবাদ আজ পাকিস্তানের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়া বসিয়াছে, যারা দেশের শিল্প-বাণিজ্য ও সম্পদকে নিজেদের কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়া আপামর জনগণকে পথে বসাইয়াছে, হয়তো তাদেরই পর্যালোচনায় আইয়ুব সাহেব দেশের সেই গণতান্ত্রিক অগ্রগতিকে এক আঘাতে গতিহীন করিয়া রাখিয়াছিলেন।
আজ জনতা জাগিয়াছে, রাষ্ট্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হইয়াছে। এক্ষণে দুনিয়ায় এমন কোন শক্তি নাই, যাহা জনগণের এই অগ্রগতিকে প্রতিহত করিতে পারে। জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য যে সকল ফন্দি-ফিকির আঁটা হইয়াছিল, তাহাও একে একে নস্যাৎ হইতেছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচন আগে দেওয়া হইয়াছিল এই আশায় যে, সেখানে ভয়-ভীতি-ত্রাস সৃষ্টি করিয়া এবং একচেটিয়া পুঁজিপতি শিল্পপতিদের অর্থে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নির্বাচন প্রভাবিত করা যাইবে এবং তাহা দেখাইয়া রাজনীতি-সচেতন পূর্ব পাকিস্তানিদের মনোবল দাবাইয়া দিয়া কিস্তিমাত করা যাইবে। ফল দাঁড়াইয়াছে বিপরীত। সেখানেও ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি হইয়াছে। এক্ষণে সেখানে নির্বাচকম-লীর সদস্যদের ট্রেনিং প্রদানের বাহানা তুলিয়া এবং মৌলিক গণাস্থার প্রতি ভুয়া দরদ দেখাইয়া তাঁদেরকে বাগে আলিবার নিষ্ফল চেষ্টা চালাইতে হইতেছে। মুখে নির্লজ্জ বাগাড়ম্বর করা হইলেও পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষাও করুণ ও শোচনীয়। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
লেখক: তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া
প্রতিষ্ঠাতা, দৈনিক ইত্তেফাক ১৮ নভেম্বর, ১৯৬৪
সব পেশার চরিত্র এক নয়। যে কারণে কিছু পেশাকে চিহ্নিত করা হয় ‘জরুরি’ হিসেবে। দেশের কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে সেই পেশার মানুষদের রাস্তাঘাটে চলাচল থাকে নির্বিঘ্ন। সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় চলাচলের ওপর তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বাকি জনসাধারণের জন্য তা বহাল থাকে। সেই পেশার মধ্যে প্রথমেই থাকে চিকিৎসক (অ্যাম্বুলেন্সসহ), দমকল বাহিনী, সাংবাদিক এবং বিশেষভাবে বিবেচিত কয়েক শ্রেণির মানুষ। এর মানে হচ্ছে, সরকার মনে করছে এসব পেশার মানুষদের কর্মক্ষেত্রে বা বাইরে স্বাভাবিক চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করা উচিত হবে না। ফলে তাদের সবসময়ই থাকতে হয় সেবার মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু খোদ হাসপাতালেই যদি মানুষদের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় পুলিশের অজুহাতে, বিষয়টি তখন হয়ে ওঠে অমানবিক। মৃত্যুপথ মানুষকে হাসপাতাল থেকে যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়, তখন একটা বিতর্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। একমাত্র পুলিশি হয়রানির ভয়ে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছে রোগী ভর্তি না করতে। সে ক্ষেত্রে রোগী যতই সংকটময় পরিস্থিতিতে থাকুক না কেন, পুলিশি জটিলতা শেষ না করে কোনো হাসপাতালই দায়িত্ব নেয় না রোগীর সেবা করার। কিন্তু এর সমাধান তাহলে কী?
আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমাধান নেই। একমাত্র এ ধরনের নিয়মের আধুনিকায়ন এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তই মুমূর্ষু মানুষকে ফিরিয়ে আনতে পারে মৃত্যুর মুখ থেকে। এর জন্য পুলিশ ও চিকিৎসক কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা দরকার। সেটা লিখিত বা অলিখিত, মুখ্য বিষয় তা নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, রোগীর জীবন বাঁচানো। সেটা কী ধরনের রোগী, তার বিবেচনা কখনই হাসপাতাল বা ক্লিনিকের থাকা উচিত নয়। তারা শুধু তৎক্ষণাৎ পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করবে। পাশাপাশি সেই ঘটনার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রোগী হাসপাতালস্থল ত্যাগ করতে পারবে না। এরকম একটি আইন থাকলেই আর কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে রোগীও সুস্থ থাকল, আইনি জটিলতাও থাকল না। ফলে হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে আপত্তির আর সুযোগ নেই। বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে উভয় কর্তৃপক্ষকে।
শুক্রবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘হাসপাতালের দরজা বন্ধ পুলিশ কেসের ভয়ে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে এ বিষয়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা যাচ্ছে, নুর ইসলাম (৭০) গত ৭ আগস্ট ফজরের নামাজ শেষে ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন যুবক মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে নিয়ে যান স্থানীয় স্পেশালাইজড মেডিকেল কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে তাকে ৪০ মিনিটের বেশি সময় রাখা হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরে এক আত্মীয় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পথেই তার মৃত্যু হয়।
মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলামের মতো সারা দেশে অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিভছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দায়িত্বহীনকা-ে। ‘পুলিশ কেস’, ‘আইনি ঝামেলা আছে’ প্রভৃতি কথা বলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও বদলায়নি তারা। নানা অজুহাতে দুর্ঘটনায় আহত বা অপরাধীদের আক্রমণে মারাত্মক আহত রোগীদেরও ফিরিয়ে দিচ্ছে তারা দ্বিধা ছাড়াই। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনায় আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি তারা বিবেচনা করেন। গুরুতর আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। গুরুতর আহত রোগী মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে ভুল বুঝে হাসপাতাল ভাঙচুর করে। টাকা পরিশোধ করতে চায় না। এসব ঘটনায় মামলা হলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কখনো চিকিৎসা দিতে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। ফলে জটিলতা এড়াতে চিকিৎসাদানে মালিকপক্ষ কড়াকড়ি আরোপ করে।
এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্রুত একটি সমাধানের পথ বের করবেন, সেটাই প্রত্যাশা। জনগণকে যেন কোনোভাবেই বিনা চিকিৎসায় জীবন দিতে না হয়।
১৯৩৪ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন কবি, গীতিকার ও গায়ক অতুলপ্রসাদ সেন। তার জন্ম ২০ অক্টোবর ১৮৭১ সালে ঢাকায়। বাল্যকালে বাবাকে হারিয়ে তিনি মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কিছুদিন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। পরে বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসে কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, পরে তিনি লিবারেলপন্থি হন। সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থের বৃহৎ অংশ স্থানীয় জনকল্যাণে তিনি ব্যয় করেন। বাংলাভাষীদের কাছে তিনি একজন সংগীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তার গানগুলো প্রধানত স্বদেশিসংগীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে ব্যক্তিজীবনের বেদনা তার গানে কমবেশি প্রভাব ফেলেছে। রবীন্দ্র-প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যারা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯০২ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি আইন ব্যবসা উপলক্ষে লখেœৗতে অতিবাহিত করেন। সে সময় তার বাংলোয় প্রায় সন্ধ্যায়ই গানের আসর বসত। সেই আসরে গান শোনাতে আসতেন আহম্মদ খলিফ খাঁ, ছোটে মুন্নে খাঁ, বরকত আলী খাঁ, আবদুল করিম প্রমুখ। বাংলা সংগীতে তিনিই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। ‘মোদের গরব, মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটিতে তার মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। এ গান বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের মধ্যে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়েছে। গানটির আবেদন আজও অম্লান।
ভারতের ভিসা পাওয়া নিয়ে পাকিস্তান দল যে জটিলতার মধ্যে ছিল সেটার অবসান হয়েছে। অবশেষে ভারতের সরকার পাকিস্তান দলের জন্য ভিসা অনুমোদন করেছে।
সোমবার ক্রিকেট বিষয়ক ভারতীয় ওয়েবসাইট ক্রিকবাজ এই খবর জানিয়েছে। ভিসা অনুমোদনের ফলে বাবর আজমের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান দল এখন বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে ভ্রমণ করতে পারবে। আগামী ৫ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া ১০ দলের আসরে শেষ দল হিসেবে ভিসা পেয়েছে পাকিস্তান।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ অংশ নিতে আগামী বুধবার ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা রয়েছে পাকিস্তান দলের। তবে যাত্রার ৪৮ ঘণ্টা আগেও ভিসা না পাওয়াকে 'অস্বাভাবিক দেরি' হিসেবে উল্লেখ করে উদ্বেগ জানায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। তারা বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির দ্বারস্থও হয়। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এসেছে ভিসা অনুমোদনের খবর।
ক্রিকবাজ জানিয়েছে, আইসিসির একটি সূত্র তাদেরকে পাকিস্তান দলের ভারতের ভিসা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ভিসা পেতে দেরি হওয়াকে স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে ওই সূত্র।
সবশেষ এশিয়া কাপের মূল আয়োজক ছিল পাকিস্তান। তবে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশটিতে যেতে চায়নি ভারত। ওই আসরে ভারতের সবগুলো ম্যাচ হয় শ্রীলঙ্কায়। একটি বাদে সুপার ফোরের বাকি সব ম্যাচ আর ফাইনালও অনুষ্ঠিত হয় দ্বীপ দেশটিতে।
ভারত নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় হাইব্রিড মডেলে এশিয়া কাপ আয়োজনের প্রস্তাব আসে পাকিস্তানের কাছ থেকেই। এর আগে ভারত দল পাকিস্তানে না গেলে পাকিস্তানও ভারতে বিশ্বকাপ খেলতে যাবে না বলে হুমকি দিয়েছিল পিসিবি। যদিও নিজেদের সেই সিদ্ধান্ত থেকে পরে সরে আসে তারা।
বিশ্বকাপের আগে আগামী শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অফিসিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচে মাঠে নামবে পাকিস্তান। তিনদিন পর তাদের আরেকটি প্রস্তুতি ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপে বাবরদের প্রথম ম্যাচ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। আগামী ৬ অক্টোবর হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচটি।
বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধে আইনের যে ধারায় শাস্তি দেওয়ার হয়, দণ্ডবিধি বা পেনাল কোড নামে আইনটি ১৬৩ বছরের পুরনো। বিচারের দিক-নির্দেশক হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধি (দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বা সিআরপিসি) নামে পদ্ধতিগত আইনটিও ১২৫ বছর আগের তৈরি। এ ছাড়া ১৫১ বছরের বেশি পুরনো (১৮৭২ সাল থেকে প্রচলিত) সাক্ষ্য আইন (অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট)। ব্রিটিশ আমলে তখনকার প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে তৈরি এ আইনগুলোর কাঠামো নিয়ে আপত্তি না থাকলেও আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ মানুষের প্রশ্ন আছে সময়, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে আইনগুলোর সংস্কার এবং যুগোপযোগী না করা নিয়ে। বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে ৭৬ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। আইনের সংস্কার নিয়ে বছরের পর বছর দাবি উঠেছে জোরেশোরে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসব আইনের আলোকে, অনেক বিশেষ আইন হয়েছে। সেগুলোর অনেক ধারাতেও অসংগতি ও অস্পষ্টতার বিষয়টি নানা সময়ে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সংস্কারের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত।
১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত দণ্ডবিধিতে ৫১১ ধারার ৪৫৯টি শাস্তিসংক্রান্ত। এর মধ্যে আটটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৮৯৮ সালে তৈরি হওয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬৫ ধারার বেশিরভাগই বিচারের লক্ষ্যে দিকনির্দেশনা সংক্রান্ত। এ ছাড়া ১৫১ বছরের বেশি পুরনো (১৮৭২ সাল থেকে প্রচলিত) ও ১৬৬টি ধারা সংবলিত সাক্ষ্য আইনে (অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট) ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য অবমাননাকর একটি ধারা গত বছর নভেম্বরে বাতিলসহ এ আইনে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ আমলে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয় সংশোধনীতে। আইন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সাক্ষ্য আইনটিকে আরও যুগোপযোগী ও সংস্কারের অংশ হিসেবে চলতি বছরেই তারা সুপারিশসংক্রান্ত প্রতিবেদন দেবেন।
আইনের সংস্কার প্রশ্নে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়েছে দেশ রূপান্তর। প্রায় অভিন্ন সুরে তারা বলেন, আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্য হলো ‘দশজন অপরাধী খালাস পেলেও একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পান’। ফলে বিচারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং আইনের ভাষা হতে হয় সহজ ও অযান্ত্রিক। একই সঙ্গে বিচারপ্রত্যাশীর ভোগান্তি লাঘবে দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হয়। তাদের মতে, প্রায় ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক সময়ে মানুষকে প্রজা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর প্রভাব পড়েছে ওই সময়ে তৈরি আইনগুলোতে। যেখানে শুধু শাস্তিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে একশ, দেড়শ বছরে অপরাধের ধরন, ভিন্নতা, অপরাধে প্রযুক্তিগত ব্যবহারসহ বদলেছে অনেক কিছু। বিপরীতে আইনগুলোতে নগণ্য কিছু সংশোধনী ছাড়া সংস্কার হয়নি।
পুরনো আইনের সংস্কার না হওয়াকে মামলাজটের কারণ উল্লেখ করে আইনজীবীরা আরও বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, আদালতের সময়সহ বিচারপ্রত্যাশীর অর্থ ও সময় সাশ্রয়, অপরাধীর পুনর্বাসন, সংশোধন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তেমন কিছুই নেই আইনগুলোতে। অন্যদিকে আইনের অপপ্রয়োগ কিংবা দুর্বলতায় প্রায়ই নির্দোষ ব্যক্তিকে নির্যাতন, জেলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের জন্য আইন। কিন্তু ব্রিটিশরা কর্তৃত্ব ও নিপীড়নমূলক অনেক আইন করেছে মানুষকে শোষণ, শাসন ও লুণ্ঠন করতে। তখন তো আর নাগরিক ও মানবাধিকার নিয়ে এত কথা হতো না। তাদের লক্ষ্যই ছিল কথায় কথায় স্বাধীনতাকামীদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া। তিনি বলেন, ‘এখন তো আমরা ব্রিটিশদের উপনিবেশে নেই। কিন্তু ৫৪ (বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার) ১৬৭ ধারার (রিমান্ড) মতো নিপীড়নমূলক আইনগুলোসহ আরও অনেক কিছু রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে মাত্র কয়েক দিনে একটি ভালো সংবিধান হলে এখন মানুষের জন্য যুগোপযোগী আইন কেন হবে না?’
সম্প্রতি ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নিয়োগ পাওয়ার পরদিন গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি মামলাজটকে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ লক্ষ্যে আইনের সংস্কার বড় বিষয় উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষের দুর্গতি ও কষ্ট লাঘবে সরকার নিশ্চয়ই এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবে।’ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
আইন সাময়িকী ডিএলআরের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যথার্থই বলেছেন। আমরাও আইনের সংস্কার চাই। শুধু ফৌজদারি কিংবা দণ্ডবিধি নয়, এসব আইনের আলোকে আর্থিক অপরাধ, মানি লন্ডারিংসহ এমন কিছু আইন আছে যেগুলোর অনেক কিছুর সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।’
কিছুদিন আগে ভারত সরকার ব্রিটিশদের তৈরি ফৌজদারি আইন ব্যাপক সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে।
সংস্কারের রূপরেখা আলোর মুখ দেখেনি : পুরনো ফৌজদারি আইনের সংস্কার নিয়ে ২০১১ সালে একটি রূপরেখা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রতিবেদন দিয়েছিল আইন কমিশন। এতে আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্যটিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থান করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একজন নির্দোষ ব্যক্তি যাতে সাজা না পায় এবং একজন অপরাধীও যাতে খালাস না পায়।’ আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে প্রশ্নের অবতারণা করে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে ৩৩টি সুপারিশ করে কমিশন। এর মধ্যে তদন্ত ও বিচারের ত্রুটি কাটাতে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করতে স্থায়ী, পেশাদার ও দক্ষ পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য শুধু হাতেকলমে না লিখে টেপ রেকর্ডার, ভিডিওতে রাখা, ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সঙ্গে সাক্ষীর বক্তব্য রেকর্ড করা, মিথ্যা ও তুচ্ছ অভিযোগকারীকে জরিমানা, ক্ষতিপূরণ বা কারাদণ্ড দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি দায়রা জজকেও ক্ষমতা দেওয়া, বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে মুলতবির সময় সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া, মামলার কার্যক্রম স্থগিতের সময়সীমা ৩০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের তাগিদ দেয় কমিশন। এ ছাড়া কারাগারের চাপ কমানো এবং আসামিকে সংশোধনের লক্ষ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অভিযোগ গঠনের সময় দোষ স্বীকার করলে সাজা রেয়াত দেওয়া, যুক্তিতর্কের কারণে মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় তা লিখিত আকারে জমা দেওয়া, আদালতের সংখ্যা অনুপাতে আপিল আদালত প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে কমিশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিশনের ওই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোর্শেদ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিবেদন দেওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে কমিশন অবহিত নয়।
দণ্ডবিধির অনেক ধারার অসংগতি ও অস্পষ্টতা নিয়ে আইন ও বিচার সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই আইনে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু গণপিটুনিতে মৃত্যু, অর্থনৈতিক অপরাধের মতো আরও কিছু বিষয়ে আইনে কিছু নেই। অন্যদিকে পুরনো এ আইনে এখনো ১০ টাকা, ১০০ টাকা ও ২০০ টাকার মতো অর্থদণ্ডের বিধান রয়ে গেছে। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার তিনজন (একজন অবসরে) বিচারক এসব আইনে তাদের বিচারিক অভিজ্ঞতার বিষয়টি দেশ রূপান্তরের কাছে তুলে ধরেন। সংগতকারণে তারা তাদের নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানান। একজন বিচারক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রসিকিউশনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সমন্বয়ে একটি ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম হয়। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে শুধু বিচার বিভাগকে শুনতে হয়। পুরনো আইনগুলোতে এমন অনেক কিছু আছে, যা একটু আধুনিক হলে বিচারকাজে আরও গতিশীল হবে।’ অন্য একজন বিচারক বলেন, ‘বিচারকাজের সময় টাইম (আদালত ও বিচারপ্রার্থীর সময়), কস্ট (বিচারপ্রার্থীর খরছ) এবং ভিজিট (বিচারপ্রত্যাশীর আদালতে আসা-যাওয়া) এ তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইনগুলোতে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা নেই। সংগতকারণে বিচারপ্রার্থীর প্রতি সিমপ্যাথি (সহানুভূতি) ও ইমপ্যাথি (সহানুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু করা) থাকা সমীচীন।’
আইন সংস্কারের উদ্যোগ থমকে দুই বছর ধরে : ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফৌজদারি আইন সংস্কার ও আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককে নির্দেশ দেন। দুদিন পর ফৌজদারি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন করে আইনটি যুগোপযোগী, আধুনিক ও বাংলা ভাষায় প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে চেয়ারপারসন করা হয় মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবিরকে। কমিটিকে অন্যান্য দেশের আইন বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে সমস্যা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের ওয়াকিবহাল একটি সূত্রের তথ্য বলছে, দুই বছর পার হলেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই।
এ বিষয়ে জানতে সচিব ময়নুল কবিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল ধরেননি। সার্বিক বিষয়ে জানতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তার সাড়া মেলেনি। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন মনে করেন, পুরনো আইনগুলোর আমূল পরিবর্তন কিংবা পুরো সংস্কার নয়, যতটুকু করলে বিচারপ্রার্থীর দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে সেটি হতে পারে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘আইনগুলোর প্রসিডিউরে (কার্যপ্রণালি) তেমন ভুল নেই। যেসব ক্ষেত্রে অসংগতি বা অস্পষ্টতা আছে শুধু সেগুলোই আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে অংশীজন হিসেবে অন্যদের সঙ্গে অবশ্যই আইনজীবীদের সম্পৃক্ত রাখা উচিত।’
ন্যায্য পারিশ্রমিক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সীমিত করার দাবি নিয়ে পাঁচ মাস আগে হলিউডে শুরু হওয়া হট্টগোলের অবসান হচ্ছে। আন্দোলনকারী লেখকরা প্রযোজকদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পর ধর্মঘট তুলে নেওয়ার কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, পাঁচ মাস আগে লেখক বা চিত্রনাট্যকারদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন অভিনয়শিল্পীরা। যার কারণে হলিউডে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বন্ধ হয়ে যায় অনেক সিনেমার নির্মাণকাজ। তবে স্থানীয় সময় গত রবিবার হলিউডের লেখক ইউনিয়ন বড় স্টুডিওগুলোর সঙ্গে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে।
সিএনএন বলছে, এই চুক্তির ফলে হলিউডের ইতিহাসের বড় দুটি ধর্মঘটের মধ্যে একটি পক্ষ কাজে ফিরতে সম্মত হলো। এই ধর্মঘটের ফলে প্রায় পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ ফিল্ম ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের চিত্রায়ণ। ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে এর প্রভাব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। তাই এবার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লেখক ও অভিনয়শিল্পীদের কাজে ফেরাতে সচেষ্ট হচ্ছে হলিউডের স্টুডিওগুলো।
লেখকদের সঙ্গে নিষ্পত্তি হলেও এখনই হলিউডের স্টুডিওগুলোর আলো জ্বলছে না। অভিনেতাদের সংগঠন এসএজি-এএফটিআরএ এখনো পারিশ্রমিক ও এআই ইস্যুতে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দাবির পাশাপাশি লেখকদের পারিশ্রমিক ও লভ্যাংশ ইস্যুতে সংহতি প্রকাশ করে ২ মে থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন তারা। এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে বার্তা সংস্থার আহ্বানে সাড়া দেয়নি দ্য অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস, ওয়াল্ট ডিজনি, নেটফ্লিক্স, ওয়ার্নার ব্রস ডিসকভারিসহ অন্যান্য প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্যিক গোষ্ঠী।
চলতি বছরের ২ মে থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘটে ১১ হাজারেরও ফিল্ম এবং টিভি লেখক অংশগ্রহণ করেন, যারা স্ট্রিমিং যুগে উচ্চ বেতন এবং আরও ভালো কাজের দাবি করছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন যে স্টুডিওগুলো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম থেকে যে আয় করেছে, সেই তুলনায় তাদের ক্ষতিপূরণ মিলছে না। লেখকরা নতুন নিয়মও চান, যাতে এসব স্টুডিও টিভি শোগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক লেখক নিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে বড় স্টুডিওগুলোর কাছ থেকে বেশি পারিশ্রমিক চেয়ে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল লেখকদের সংগঠন রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ)। সেই চুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হওয়াতেই মূলত ধর্মঘটের ডাক দেন লেখকেরা। হলিউড আন্দোলনের কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে টেলিভিশন শো ও হলিউডের নির্মাণাধীন সিনেমাগুলো।
বিশ্বকাপ যত এগিয়ে আসছে, বাংলাদেশে বিশ্বকাপ নিয়ে নাটক ততই জমে উঠেছে। একদিন পর দল বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়বে, অথচ এখনো ঘোষণা হয়নি বিশ্বকাপের দল।
এমন অবস্থায় সোমবার মাঝরাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসায় বৈঠকে বসেছিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
বিকেলে বিসিবি সভাপতির পেশাগত কার্যালয়, বেক্সিমকোতে নির্বাচক কমিটির সদস্যসহ বিসিবির বেশ কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বিসিবি সভাপতি। তারপর সন্ধ্যার দিকে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দাবী করা হয় সাকিব ও তামিম ইকবালের ভেতর নতুন দ্বন্দের খবর।
গণমাধ্যমগুলোর দাবী, তামিম ইকবাল জানিয়েছেন বিশ্বকাপে তিনি পাঁচটি ম্যাচে খেলতে পারবেন। অন্যদিকে তামিমের এই দাবী মানলে বিশ্বকাপে না খেলার হুমকি দিয়ে রাখেন সাকিব।
২০১৯ বিশ্বকাপে চোটজর্জর মাশরাফী বিন মর্তুজা দলে থাকায় এবং সবগুলো ম্যাচে খেলায় অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের পরও দলকে বিশ্বকাপে অষ্টম হতে দেখেছেন সাকিব, তাই এই শর্তে তার নেতৃত্বে না থাকার আশংকাই প্রবল। এই দুই জনকে সমঝোতা করার জন্য মাশরাফীকে পাপন দায়িত্ব দিয়েছেন এমন একটা খবরই দাবী করা হয়। যদিও এসবের পক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
ধোঁয়া থাকলে আগুন থাকবেই। তাই মধ্যরাতে, পৌনে ১২টায় সাকিবের বিসিবি সভাপতির বাসভবনে ছুটে যাওয়া আর সিডনি থেকে বাংলাদেশে পা রাখার ঘণ্টা তিনেকের মাথায় তাকে গুলশানের আইভি লেগেসিতে ছুটে আসতে দেখার মাধ্যমেই বোঝা যায়, চূড়ান্ত দল ঘোষণার আগে শেষ মুহূর্তে কোনো মারপ্যাঁচ লেগেছে।
প্রায় ৩ মাস পর আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে তামিম খেলেছিলেন ৪৪ রানের ইনিংস। পরের ম্যাচে আবার তিনি বিশ্রামে, যেটা বিসিবির মেডিক্যাল বিভাগেরই সুপারিশে।
তাই বিশ্বকাপে তামিম কতটা ফিট হয়ে খেলতে পারবেন, আদৌ খেলতে পারবেন কি না এসব নিয়েই হয়তো হয়েছে শেষ মুহুর্তে মধ্যরাতের আলোচনা।
অধিনায়ক, কোচ আর বিসিবি প্রধান মিলে মিনিট চল্লিশেক বৈঠক করেছেন। আগে বের হয়েছেন হাথুরুসিংহে, তার মিনিট দশেক পর সাকিব। কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি, গাড়ির কাঁচটাও নামাননি। আর পাপনের বাসায় যখন এসব চলছে, তখন এক বন্ধুর সঙ্গে বাসায় বসে চাউমিন খাচ্ছেন তামিম!
সাকিব-তামিম একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলেন না, এই খবর পুরাতন। শোনা গেছে সম্প্রতি একটি মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপণের কাজে দুজনের ভেতর সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে। তামিমের খেলা, না খেলা এসব নিয়েও জলঘোলা হওয়ার কারণেই নাকি সাকিবের বিরক্তি বেড়েছে।
তবে দুজনের কারো কাছ থেকেই এসব নিয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তামিম অধিনায়ক থাকা অবস্থায় ইংল্যান্ড সিরিজের আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন 'নাথিং এলস ম্যাটার্স'। সাকিবও স্বভাবসুলভ ভাবেই পাশ কাটিয়ে গেছেন এসব প্রসঙ্গ।
দল ঘোষণার আগের দিনে, মাঝরাতে বিসিবি প্রেসিডেন্টের বাসভবনে কোচ ও অধিনায়কের বৈঠক হতে পারে শেষ মুহূর্তের বোঝাপড়া। যেহেতু একদিন বাদেই উড়াল দিতে হবে। অথবা তামিম সংক্রান্ত ব্যপারে চূড়ান্ত ফয়সালা। উত্তরটা পেতে অপেক্ষা মাত্র কয়েক ঘণ্টার।
২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনকেন্দ্রিক সক্রিয় অবস্থানের পর দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বড় কোনো কর্মসূচি নেই। কর্মসূচি পালন করতে চাইলেও ছাত্রলীগের হামলার মুখে দাঁড়াতেই পারছেন না সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের আশপাশে ছোটখাটো ঝটিকা মিছিল করেই সারছে দলীয় কর্মসূচি। তবে বিএনপির এক দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবারও ক্যাম্পাসে সরব হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল।
জানা যায়, ক্যাম্পাসে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত আড্ডা এবং কর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। আগামীতে ঢাবি ছাত্রদলের নেতৃত্বপ্রত্যাশী নেতারা এসব কর্মকা- পরিচালনা করছেন বলে জানা যায়। আড্ডা দিতে গিয়ে শনিবার রাতে ছাত্রলীগের হামলার শিকারও হন কয়েক জন ছাত্রদল নেতা। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। ‘আমরা দ্রুত ফিরছি, মাত্র কয়দিনের অপেক্ষা’ লিখে স্ট্যাটাস দিতে দেখা যায় তাদের।
এদিকে রবিবার ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের দেয়ালে ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ সে্লাগান লিখে আলোচনা তৈরি করে ঢাবি ছাত্রদল। ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান খন্দকার অনিকের নেতৃত্বে মধুর ক্যানটিন ছাড়াও ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, কলা ভবনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে ২০টির বেশি দেয়াল লিখন করেছে তারা। এসব দেয়ালে ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’, ‘ঘুরে দাঁড়াও বাংলাদেশ’, ‘তারেক রহমান বীরের বেশে আসবে ফিরে বাংলাদেশে’ সে্লাগান লেখা হয়। যদিও এদিন দুপুরের দিকে মধুর ক্যানটিনের লেখা মুছে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশব্যাপী বিএনপির লংমার্চ শেষে অক্টোবরে ঢাকাকেন্দ্রিক টানা আন্দোলন চলবে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও পুরোদমে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্রদল। যত বাধাই আসুক ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কর্মসূচি ও আন্দোলন করতে চান তারা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত স্যাংশন ও বিএনপির সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি চূড়ান্ত রূপ লাভের অপেক্ষা থাকায় নেতাকর্মীরা বেশ উজ্জীবিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলে দাবি ছাত্রদলের নেতাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। অক্টোবরে তা চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আপাতত বিভিন্ন ভাগ হয়ে হয়ে আড্ডা, দেয়াল লিখনসহ নানান কর্মসূচি চলছে। নতুন শিক্ষার্থীরাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের বিনাশ করতে আমরা বদ্ধপরিকর। দেশনায়ক তারেক রহমানের চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষায় আছি আমরা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গতকালও ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা হামলার জবাব হামলা দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে জবাব দিতে চাই। সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিনাশ করতে চাই। ক্যাম্পাস কারও একার সম্পত্তি নয়, যেকোনো সময় আমরা আসব। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা দেশনায়ক তারেক রহমানের আগমনী বার্তা দিতে চাই।’
ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু সামনে নির্বাচন, নির্বাচনকেন্দ্রিক আমাদের কর্মসূচি চলছে। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ দিতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসব। আমরা খুব দ্রুতই আসব। হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল প্রস্তুত আছি। ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে, দাবি আদায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে অচিরেই ক্যাম্পাস থেকে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে আমরা বিজয় নিয়েই ঘরে ফিরব ইনশা আল্লাহ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যায়নি। হামলা-মামলার শিকার হয়েও আমরা নিয়মিত পদচারণা অব্যাহত রেখেছি। আগামীতেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এই ক্যাম্পাসে সরব অবস্থানে থাকবে। ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের অবসান ঘটবে শিগগিরই। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পেলে আমরা চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাব। আমরা প্রস্তুত ইনশা আল্লাহ।’
এদিকে ক্যাম্পাস দখল ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করলে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভোররাতে এসে কেউ যদি দেয়াল লিখন করে, এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে আমরা মনে করি না। আদালত কর্তৃক ঘোষিত অপরাধীকে তারা দেশনায়ক বলছে, তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা বোঝা যায় তারা কতটা অথর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র, এখানে দখলদারিত্বের কোনো বিষয় নেই। যেটি ছাত্রদল বলার চেষ্টা করছে দখল করবে, এই চিন্তা-ভাবনা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যায় না। এসবে আমরা বিশ্বাস করি না। শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যা যা করার দরকার, আমরা তা করতে রাজি আছি। ক্যাম্পাসকে কেউ অস্থিতিশীল করতে চাইলে তা প্রতিহত করা হবে।’
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনে রদবদলের সুযোগ নেই সরকারের। তাই এর আগেই নির্বাচনী প্রশাসনে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি ও রদবদল। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বদলি-পদায়ন হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে বড় পদোন্নতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিবেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২০ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৮ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিসিএসের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে, ২৫তম ব্যাচ ২০০৬ সালে এবং ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে।
জানা যায়, নির্বাচনের সময় ডিসিরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। তাদের যে কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দুটি ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। আর সে সময় বিসিএস নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিসিএসে ছিল নানা ধরনের তদবির। ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ দুটি বিএনপির সময়ে নিয়োগ পেলেও ২৭তম ব্যাচ নিয়োগ পেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কারণ বিএনপির শেষ সময়ে ২৭তম ব্যাচের নিয়োগে বড় ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় তা বাতিল হয়। পরে ফের পরীক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে এ ব্যাচের নিয়োগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২৪তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডিসির পদ থেকে তুলে আনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় যারা ডিসির দায়িত্বে থাকবেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের সবার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো যাচাই করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আর ডিসির পদে রাখা হবে না।
এ ছাড়া নির্বাচনে অন্যতম ভূমিকা পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। বর্তমানে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন ইউএনও পদে, যারা আসন্ন নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এখন ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনওর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারের ২৯১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইকরাম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষা হয় যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ছাত্রজীবনে কে কোন পার্টি করেছিলেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে তা বিবেচনা করা হয় না। বিসিএস কর্মকর্তাদের যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাতে তাকে একজন অফিসার হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। এরপর এসিআর, সুপিরিয়রের মতামত, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতার ভিত্তিতেই একজন কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তবে সরকার যে দল পরিচালনা করে তাদের কিছু নীতিমালা ও উদ্দেশ্য থাকে। কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া বৈধ ও জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা। তিনি প্রলুব্ধ হবেন না, নিরপেক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নির্বাচনী দায়িত্বও দেওয়া হয়, সেটাও নিরপেক্ষভাবে তিনি পালন করবেন।’
গত মে মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জনের পদোন্নতি হয়। জুলাই মাসে পাঁচ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসেই বদলি ও নতুন মিলিয়ে ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার এই ডিসি পদে এবারও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আটজন পিএসকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২১ কর্মকর্তা। এ পদোন্নতিতে মূল বিবেচনায় এসেছে ২২তম ব্যাচ। বর্তমানে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা হলো ৯৪৬ জন। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ২ নভেম্বর ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৭০ জন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অন্তত ১০ জন সচিবের স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন আগামী ১৩ অক্টোবর অবসরে যেতে পারেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান ১৪ সেপ্টেম্বর, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে আবদুস সালামের চাকরি এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩০ অক্টোবর, ইআরডি সচিব শরিফা খান ২৪ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী ২৫ নভেম্বর এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সিনিয়র সচিব কামাল হোসেন ২৯ নভেম্বর অবসরে যাবেন। ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এ ১০ জনের মধ্যে কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব পদে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক অবসরের মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সাবেক চার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে একমাত্র কবির বিন আনোয়ার ছাড়া বাকি তিনজনই স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের মধ্যে অন্যতম ভিটামিন ডি। অতি প্রয়োজনীয় এই ভিটামিনের প্রধান উৎস সূর্যের আলো। তবে আমাদের ব্যস্ত জীবনে রোদ পোহানের সময় কই। অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিস। এসির ভেতর থাকতে থাকতে শরীরে তৈরি হচ্ছে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি। ফলে কম বয়সে হাড়ক্ষয়, পিঠে-কাঁধে ব্যথা, চুল ঝরে যাওয়া, ঘা শুকোতে দেরি হওয়া, হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়।
রেগুলার অফিসযাত্রীরা ভিটামিন ডি-এর অভাবে সবচেয়ে বেশি ভোগে। এরা রোদে বসার সময় পান না। যে কারণে এদের মধ্যে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি খুব বেশি দেখা যায়। ৫০ বছরের বেশি বয়সের পর শরীরে অনেক ধরনের ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়, যার মধ্যে ভিটামিন ডিও একটি। এই বয়সে শরীর সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি তৈরি করতে সক্ষম হয় না। যে কারণে এই বয়সের মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণ করতে হয় অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে। এনআইএইচ-এর একটি রিপোর্ট অনুসারে, যাদের বডি মাস ইনডেক্স ৩০-এর বেশি বা তাদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি তারাও ভিটামিন ডি-এর অভাবের সম্মুখীন হতে পারেন।
কীভাবে বাড়াবেন ভিটামিন ডি?
মাশরুম
মাশরুমে ভিটামিন ডি থাকে। মাশরুম ইউভি রশ্মির সংস্পর্শে এলে ভিটামিন ডি তৈরি করে। এটি খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। কম তেলে রান্না করলে ওজন কমাতে সাহায্য করে।
সি ফুড
কিছু মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকে। রিপোর্ট অনুযায়ী, স্যামন, টুনা এবং ম্যাকেরেল মাছে ভিটামিন ডি থাকে। যদি আমিষভোজী হন তবে আপনি তাদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
দুধ
এছাড়াও দুধে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এতে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে ভিটামিন ডি রয়েছে। বিশেষ করে গরুর দুধে, এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। এর পাশাপাশি সহজে হজম হয়। দই দইয়ে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে। দই হাড় মজবুত করে এবং হার্ট ভাল রাখে।
ভিটামিন ডি পাওয়ার সেরা উপায় কি?
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিটামিন ডি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উৎস হল চর্বিযুক্ত মাছ এবং মাছের তেল। ডিমের কুসুম এবং পনিরে অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়। উপরন্তু, কিছু মাশরুমে কিছু ভিটামিন ডি২ থাকে।
ভিটামিন ডি এর জন্য রোদে বসার সঠিক সময় কোনটি?
অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সকাল ও বিকেল হল রোদে বসার সেরা সময়। দুপুরে ইউভিবি রশ্মি সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। এর মানে হল আপনি কম সময়ে বেশি ভিটামিন ডি পাবেন। কমপক্ষে ১০ মিনিট এবং সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট রোদে বসলে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।