বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

শুধু ড্রোনই না, শিক্ষাব্যবস্থাও মানুষ মারে

আপডেট : ১০ জুন ২০২৪, ১২:১৬ এএম

যে জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা গণহত্যায় সহায়তা করে সেগুলোকে ভাঙতে হবে। ব্রিটিশ অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ চার্লস টাউনশেডের ‘আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ শীর্ষক সন্ত্রাসবাদবিষয়ক গ্রন্থটি পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভস্থল থেকে এমন ‘অভিযোগ’ করছে নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ। বলা হচ্ছে, বইটি উদ্ধার করেছেন নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ডেপুটি কমিশনার কাজ ডটারি। এই দাবির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হচ্ছে যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তৎপরতায় বিদেশি প্রভাব এবং মৌলবাদী প্রবণতা লুকিয়ে রয়েছে।

এখানে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, মার্কিন পুলিশ কর্তা ডটারির দৃষ্টিতে সন্ত্রাসবাদবিষয়ক বই পড়া কিংবা জানার ব্যাপারটি কার্যত সন্ত্রাসবাদ ঘটানোর অপরাধের সমতুল্য। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের তাঁবুর কাছে সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত বই পাওয়ার ঘটনাটির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ডটারির পদক্ষেপ প্রশ্নাতীতভাবে মার্কিন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকে ধূসর করতে ভূমিকা রাখছে।

সামগ্রিকভাবে, ডটারির পাশে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো রয়েছে। অবশ্য পশ্চিমা দুনিয়ার গণমাধ্যমগুলো গত ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর আগে থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে জনমানসে এমনভাবে তুলে ধরত, যাতে মনে হয়, উগ্রপন্থি আর নরমপন্থি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি ‘সংঘাতপূর্ণ’ পরিস্থিতি রয়েছে। আর ফিলিস্তিনিদের তৎপরতাকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রভাবশালী বয়ানের উল্টো দিকে ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষার বুলিকেও তুলে ধরেছে কিছু গণমাধ্যম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রভাবশালী এই বয়ানের অসারতা ধরা পড়েছে। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্রবিক্ষোভ থেকে এই অসারতার ব্যাখা তুলে ধরা হচ্ছে। ডটারি ভাবতেও পারেননি, তার পদক্ষেপ উল্টোদিকে বন্দুক ঘুরে যাওয়ার মতো হয়ে দাঁড়াবে।

ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের ৫৫৩টির মতো ক্যাম্পাসে আলোড়ন তোলে দাবানলের তেজের মতো। এই আন্দোলনের ঢেউয়ে যুক্তরাজ্যের ৩৫ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের তাঁবু স্থাপন করেছে। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, স্পেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন মুল্লুুকের বিক্ষোভ একটি বৈশ্বিক ছাত্রআন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন বিক্ষোভ থেকে বলা হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক বিভাগ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সম্ভাব্য গণহত্যা সংঘটন এবং এ সংক্রান্ত অধ্যয়ন টিকিয়ে রাখার মতো জ্ঞানকে ভন্ডুল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বলা হয় যে, সাধারণ রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে সন্ত্রাসবাদ আরও ভয়ানক। সন্ত্রাস হচ্ছে সহিংসতার প্রতিনিধিত্বকারী একটি পদ্ধতি। বস্তুত এটি অন্যায্য ও ন্যায্য সংঘাতের মধ্যে একটি রেখা টানার চেষ্টা করে। বিদ্যমান জ্ঞান উৎপাদন ব্যবস্থায়, সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা বেসরকারি নিরাপত্তা গোষ্ঠীর তরফে রাষ্ট্রীয় পক্ষ হিসেবে সন্ত্রাস দমনের নামে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে বৈধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। আবার অ-রাষ্ট্রীয় (নন-স্টেট অ্যাক্ট) পক্ষগুলো যখন সার্বভৌম শক্তি, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী কিংবা রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখন তা অন্যায্য হিসেবে তুলে ধরা হয়।

মার্কিন পুলিশকর্তা ডটারির ‘বই নাটক’ সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত আলাপের দিকে মনোযোগ কাড়ার একটা চেষ্টা, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উঠে আসা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতিমূলক মনোভাবকে সন্ত্রাসের হুমকি হিসেবে দেখাতে মরিয়া। তবে বিষয়টি বুঝতে ডটারির অবস্থানকে ধার করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থাপিত তাঁবুগুলো মোকাবিলা করতে গিয়ে সাঁজোয়া যান ও স্নাইপার মোতায়েনের পাশাপাশি যেভাবে বিপুল সংখ্যায় পুলিশ সদস্য আনা হয়েছে এবং মাটিতে বুটের শব্দের কাঁপন শোনা গিয়েছে; তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সম্মুখরেখার মতো করে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। ফিলিস্তিনিপন্থি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভকে কালিমালিপ্ত করা এবং ডটারির বই নাটকের মধ্যমে তারা আমাদের মনে ধারণা দেয়, সন্ত্রাসবাদের আলোচনাটি বর্ণবাদের কাতারে পৌঁছে গেছে। সন্ত্রাসবাদ দীর্ঘদিন থেকে রাজনৈতিক ইস্যুর পরিবর্তে রোগগত প্রকৃতির (প্যাথলজিক্যাল নেচার) বিষয় হিসেবে আলোচিত। একে দেখা হয়, মানসিক বিভ্রান্তি কিংবা মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা হিসেবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাতকে প্যাথলজিক্যাল সহিংসতা (অস্থিরতা তৈরির প্রবৃত্তি) হিসেবে সাব্যস্ত করে। বলা হয়, অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে উন্মাদের মতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদীরা।

এই ধরনের মনোভাবই সন্ত্রাসবাদের আলোচনায় বর্ণসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটায়। এতে বোঝানো হয়, সংস্কৃতি ও জিনগত কারণে বেড়ে ওঠা এবং আইনের শাসনের মধ্যে বিকশিত হতে না পারা জনগোষ্ঠী সহিংসতাপ্রবণ। বলে রাখা দরকার, ডটারির মতো কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশকর্তা ক্ষমতার অবস্থানে থেকে যেভাবে বর্ণবাদী বয়ানের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাতে তার নিজেরই লজ্জা পাওয়া উচিত। কারণ তার মতো জনগোষ্ঠীর মানুষও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার।

সন্ত্রাস-সংক্রান্ত আলোচনা এখন অযৌক্তিক ও অভব্য কায়দায় শৃঙ্খলাভিত্তিক ব্যবস্থায় (রুলস-বেজড অর্ডার) প্রান্তসীমা তৈরি করে। অর্থাৎ এটি  সার্বভৌম অধিকার, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও জীবনের অধিকারের মতো সর্বজনীন অধিকারকে সীমিত করে দেয়, যা কি না আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের দ্বারা স্বীকৃত। অন্যদিকে, এ ধরনের সন্ত্রাস-সংক্রান্ত আলাপ রাজনৈতিক ও আইনের শাসনের বাইরে থাকা মানুষের বিচারিক শৃঙ্খলায়ও আঘাত করে। যেমন, কাউকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করা, শিশুদের ভবিষ্যৎ সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া, কোনো জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসীদের অনুরাগী হিসেবে ভাবা এবং মায়েদের সন্ত্রাসীর জন্মদাতা মনে করার মতো বিষয়ও দেখা যায়। সত্যিকার অর্থে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সুরক্ষার অভাবে সন্ত্রাস-সংক্রান্ত আলোচনা মানুষকে হত্যার অনুমোদন দেয়। আমরা গাজায় তাকালে দেখব, সন্ত্রাস-সংক্রান্ত আলাপ সেখানে ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা ফেলা, তাদের কেটে টুকরো করা, বাস্তুচ্যুত করা, আটক করা ও নির্যাতন করার অনুমোদন দিয়েছে। এই ধরনের জ্ঞানকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের জীবনকে মৃত্যু তো বটেই, অকাল মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করেছে।

পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই সন্ত্রাসবিষয়ক জ্ঞানের উৎপাদক ও প্রচারক। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলতি গণহত্যার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি শুধু ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আর আর্থিক দেনা-পাওনায়ই শুধু সীমাবদ্ধ নেই। এর সংযোগ আরও অনেক গভীরে। সন্ত্রাসবাদ অধ্যয়ন বিদ্যার ছাতার তলে সন্ত্রাস-বিষয়ক জ্ঞান বৈজ্ঞানিক ও অ্যাকাডেমিক আবরণ পেয়েছে। ৯/১১ হামলার পর এ সংক্রান্ত ৯০ শতাংশ গবেষণা সম্পাদন হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ প্রকল্পের পরই অধ্যয়নের বিষয় হয়ে উঠেছে ব্যাপকভাবে। সন্ত্রাস-সংক্রান্ত জ্ঞানকে ইতিবাচক ভাবধারার চাদরে জড়ানো হয়, যেটিকে কি না পড়াশোনার উপায় হিসেবে তুলে ধরা হয়, সারধারণীকরণ করা হয় এবং যাচাই-বাছাইযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ সংক্রান্ত জ্ঞান নিরাপত্তা শাসনের সঙ্গে যুক্ত এবং সে কারণে সন্ত্রাসবাদ সমস্যাকে প্রতিরোধযোগ্য বলে অভিহিত করা হয়।

সন্ত্রাসবাদ অধ্যয়নের সমালোচক অধ্যাপক রিচার্ড জ্যাকসন মনে করেন, সন্ত্রাস-বিষয়ক জ্ঞান রাজনীতি বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের বিদ্যা হিসেবে অধ্যয়ন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্ত্রাসবাদের জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উৎপাদিত হয়েছিল এবং তা অব্যাহত রয়েছে। এই জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শিক্ষাবিদরা পশ্চিমা সরকারগুলোর সন্ত্রাসবাদবিষয়ক উপদেষ্টার ভূমিকায় রয়েছেন। বিভিন্ন ডানপন্থি সংস্থা, সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা ও নানা নীতিনির্ধারণী গোষ্ঠীতে সন্ত্রাস নির্মূলে ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তি হিসেবে শিক্ষাবিদদের দেখা যায়, যেমনটি অতীতেও দেখা গেছে। সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অধ্যয়ন পশ্চিমা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা এর ওপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে থাকেন। কিংস কলেজ লন্ডন, ইউনিভাসির্টি অব সেন্ট অ্যান্ড্রজ ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মতো জায়গায় এসব অধ্যয়ন সম্ভব। পুলিশ, সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, অস্ত্র উৎপাদক থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদ অধ্যয়নে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। ‘সামরিক-শিল্প-অ্যাকডেমিক (মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-অ্যাকাডেমিক কমপ্লেক্স)’ ত্রয়ীর বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা গণহত্যা সংঘটনের উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করে এবং টিকিয়ে রাখে।

প্রাচ্যবাদ দর্শনে প্রয়াত ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাইদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তা হলো: সাম্রাজ্য (ইমপেরিয়াল) এবং জ্ঞান (এপিস্টেম)। সাইদ বিশ্বায়নের অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলার ভূমিকার সমালোচনামূলক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন; যেখানে তিনি জোর দেন উৎপাাদিত জ্ঞানের ওপর যা বিশ্বে সামরিক এবং আদর্শিক প্রভাব তৈরি করতে পারে।

এ অবস্থায় ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের দাবিনামায় আরেকটি বিষয় যুক্ত করা প্রয়োজন এবং তা হলো, সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত আলোচনার বিলুপ্তি। গাজার আগ্রাসন আমাদের বলছে, সময় এসেছে সন্ত্রাসবিষয়ক অধ্যয়নের শিক্ষাবিদদের, সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী অধ্যয়নের ডিগ্রি এবং কোর্স বিলুপ্ত করার। অ্যাকাডেমিক জার্নাল ও সম্মেলনগুলোকে ভেঙে দেওয়ারও সময় হয়েছে যেখানে এ সংক্রান্ত জ্ঞান প্রচারিত হয়। 

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মুজাহিদ অনীক

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশন অ্যাট গোল্ডস্মিথস, লন্ডন ইউনিভার্সিটি

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত