প্রখ্যাত উত্তর-ঔপনিবেশিক পণ্ডিত এবং বিশ্বজনীন বুদ্ধিজীবী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্ভবত তার লেখা ‘সাবঅল্টার্ন কি কথা বলতে পারে?’ বইটির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যেখানে তিনি দাবি করেছেন যে, জ্ঞানের অভিজাত ব্যবস্থাগুলো সাবঅল্টার্ন (প্রান্তিক গোষ্ঠী) কণ্ঠস্বরকে ফিল্টার আউট বা ছাঁকনি দিয়ে পৃথক করে দেয়; যাতে এমনকি যখন সাবঅল্টার্ন কথা বলে, তখনো শোনা যায় না। সম্প্রতি নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) একটি বক্তৃতায় আফ্রিকান-আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ডু বয়েসের নামের ভুল উচ্চারণ করার জন্য স্পিভাক একজন তরুণ ছাত্রকে তিরস্কার করেন। তবে এতে বড়সড় তোলপাড় পড়ে যায় যে, স্পিভাক এ তিরস্কারের মধ্য দিয়ে সাবঅল্টার্নের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিয়েছেন, যেই আচরণকে তিনি নিজেই আজীবন নিন্দা করে এসেছেন। তবে বিষয়টি এত সরল নয়, বরং অনেক জটিল।
স্পিভাকের ২১ মে ডু বয়েসের ‘গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি’ বিষয়ে বক্তৃতাটির লক্ষ্য ছিল আরও ন্যায়সংগত গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মগুলোকে আন্ডারলাইন করা, যা ব্যক্তিগত স্বার্থকে (আমার অধিকার) নয় বরং ‘অন্যান্য মানুষের’ অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়, বিশেষ করে সাবঅল্টার্নদের জন্য। যখন তিনি লিখছিলেন, ডু বয়েসের মনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯০০-এর দশকের গোড়ার দিকে নিপীড়িত এবং বর্ণবাদী কৃষ্ণাঙ্গদের কথা, কিন্তু স্পিভাক বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তার এ উদ্বেগ যুক্তিসংগতভাবেই আজকের সব প্রান্তিক মানুষের (দরিদ্র, লিঙ্গ এবং যৌন সংখ্যালঘুদের, দলিত, প্রতিবন্ধী, ফিলিস্তিনি, ইত্যাদি) জন্য প্রযোজ্য।
হাইতিয়ান বংশোদ্ভূত একজন প্রান্তিক কালো-আমেরিকান পণ্ডিত ডু বয়েস। তার মর্যাদার কথা মাথায় রেখে স্পিভাকের বক্তৃতাটিতে বারবার তার নাম সঠিকভাবে উচ্চারণের গুরুত্বের দিকে ফিরে এসেছে। ডু বয়েস নিজেই ইংরেজিতে জোর দিয়েছিলেন, ফরাসি নয়। আর তাই তিনি নিজের নামের উচ্চারণ করতেন ডু বয়েস, ফরাসি কেতায় দু বোয়া বলে নয়।
কিন্তু স্পিভাকের বক্তৃতার পরের প্রশ্নোত্তর পর্বে যার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেখানে একটা বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। একজন স্নাতক ছাত্র, আনশুল কুমার, স্পিভাককে সাবঅল্টার্ন সম্পর্কে কথা বলার ক্ষেত্রে তার নিজের সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থা নিয়ে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার প্রশ্নটি সম্পূর্ণ করতে পারছিলেন না, কারণ স্পিভাক তাকে বারবার বাধা দিয়েছিলেন, প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি কে (যার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ব্রাহ্মণ স্টাডিজ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক’), এবং তারপর তিন-তিনবার করে তার ভুল উচ্চারণকে স্পিভাক সংশোধন করে দেন। ডু বয়েসের নাম নিয়ে তিরস্কার করার অভিযোগ করে আনশুল কুমার যে ব্রাহ্মণ নিয়ে পড়াশোনা করছেন, তা উল্লেখ করে তাকে আরও ভালোভাবে এ ব্যাপারটি জানা উচিত বলে মত দেন স্পিভাক।
ব্যাপারটি আরও খারাপের দিকে যায় যখন কুমার উদ্ধত ভঙ্গিতে স্পিভাককে একজন ব্রাহ্মণ বলে অভিযুক্ত করেন (যেটি স্পিভাক অস্বীকার করেন) এবং তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ‘যদি এই তুচ্ছ ব্যাপারটি শেষ হয়ে যায়, আমি কি প্রশ্নটিতে যেতে পারি?’ স্পিভাক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি একজন ৮২ বছরের নারী যিনি আপনার প্রতিষ্ঠানে পাবলিক স্পিকিংয়ে অংশ নিচ্ছি এবং আপনি আমার সঙ্গে অভদ্র আচরণ করছেন।’ সভাপতির ইশারায়, স্পিভাক তারপর কুমারের উত্তর না দিয়ে অন্য শ্রোতা সদস্যের প্রশ্ন নিতে শুরু করেন।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেটে বিতর্কের ঝড় ওঠে। কেউ কেউ ছাত্রটির পক্ষ নিয়েছিল। তারা তাকে ধমকানো এবং থামিয়ে দেওয়ার জন্য স্পিভাকের সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে, অনেকেই স্পিভাকের পক্ষে অবস্থান নেন সঠিক উচ্চারণের শিক্ষাগত এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনের ওপর জোর দেওয়ার জন্য। কুমার স্পিভাকের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম এক্স (প্রাক্তন টুইটার) ব্যবহার করেন, এমনকি (অমার্জনীয়ভাবে) অশোভন শব্দ প্রয়োগ করে, লিখেছেন ‘... (প্রকাশ অযোগ্য) বেটির এত আস্পর্ধা যে দু বোয়ার উচ্চারণে আমাকে তিনবার থামিয়ে দিয়েছিল। সাবঅল্টার্ন কি আসলেই কথা বলতে পারে?’
তারপর, কুমার একজন দলিত এই খবরের আলোকে, স্পিভাক আত্মরক্ষা করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, ঘোষণা করেছিলেন যে, “অংশুল কুমার নিজেকে [বক্তৃতায়] দলিত হিসেবে চিহ্নিত করেননি। অতএব, আমি ভেবেছিলাম তিনি একজন ব্রাহ্মণবাদী, যেহেতু তিনি বলছিলেন যে তিনি একটি ব্রাহ্মণ স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা।... একজন বৃদ্ধ মহিলা শিক্ষক হিসেবে একজন পুরুষ ছাত্রের মুখোমুখি হচ্ছেন... আমার আহত মন্তব্য যে আমি তার প্রশ্ন শুনতে চাইনি তার ইঙ্গিতই ছিল এই প্রতিবাদ।’
ঘটনাটি একটি চায়ের কাপে ঝড়ের মতো মনে হতে পারে, তবে আমি মনে করি এর গুরুত্বপূর্ণ বিস্তৃত সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। এক স্তরে, এটি ‘উচ্চারণের রাজনীতি’ এর দীর্ঘকাল ধরে চলা অনুশীলনের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যার অধীনে সামাজিক অভিজাতরা ভাষার ‘সঠিক’ শব্দচয়ন, ‘ভদ্র’ সম্বোধন, ‘সঠিক’ উচ্চারণের মাধ্যমে নিম্ন শ্রেণির ওপর তাদের আধিপত্য জাহির করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মোচড়টা হলো এই যে, বক্তৃতায় স্পিভাকের উচ্চারণের রাজনীতির লক্ষ্য হলো অভিজাত ক্ষমতা নয়, বরং সাবঅল্টার্ন ভয়েস একজন কালো হাইতিয়ান-আমেরিকান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সুস্পষ্ট আকাক্সক্ষা। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ভুলবশতই হোক, কুমার এই মূল বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন, কারণ এটি রাজনৈতিকভাবে তার প্রো-সাবঅল্টার্ন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
যদিও তার বার্তার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর স্তরে স্পিভাক ভালোভাবে বেরিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু আমরা এখানে খেলার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ভুলে যেতে পারি না। একজন বিশিষ্ট এবং প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী হিসেবে, যার কাজ (এবং শব্দ) এই অনুষ্ঠানে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু, তিনি একজন কর্র্তৃত্বশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অবস্থান করছেন, যা কনিষ্ঠ পণ্ডিত, কুমারকে উপদেশ দেওয়ার প্রয়াসে এটির সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এই অন্তর্নিহিত স্তরে, স্পিভাক নিজের ক্ষমতা তুলে ধরে বিপজ্জনক শিকার হয়েছেন। আইরনি হচ্ছে তিনি নিজেই যার বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করেছেন : অভিজাতরা সাবঅল্টার্নের কণ্ঠকে উপেক্ষা করে এবং নিঃশব্দ করে।
সত্য, এটি বিতর্কিত হতে পারে যে, কুমার যদিও নিজেকে সাবঅল্টার্ন বলে দাবি করেন : আদতে তিনি একজন দলিত হলেও, তিনি একটি মর্যাদাপূর্ণ, অভিজাত ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জেএনইউতে স্নাতক করা ছাত্র, যেই সুবিধা কম মানুষের জন্য সংরক্ষিত। স্পিভাক একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন : ‘সাবঅল্টার্ন এবং দলিত শব্দগুলো বিনিময়যোগ্য শব্দ নয়। ঊর্ধ্বগামী শ্রেণি-সোপান পার হওয়া দলিত ব্যক্তি এবং অ্যাকাডেমিক পরিচয়ে ঊর্ধ্বগামী শ্রেণি-গতিশীলতার একটি উপকরণ। অবশ্যই তার নতুন বিশেষাধিকারটি সমগ্র দলিত সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করার জন্য ব্যবহার করা উচিত, বিশেষ করে সাবঅল্টার্ন দলিতদের জন্য, যারা অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না।’
এত কিছু সত্ত্বেও, এই কথা অনস্বীকার্য যে, কুমার আলোচ্য বক্তৃরার সময় অধস্তন অবস্থানে ছিলেন এবং স্পিভাকের প্রো-সাবঅল্টার্ন রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষক হিসেবে তার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা (তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশ এবং ভারতে আদিবাসী বা আদিবাসী শিশুদের জন্য স্কুল পরিচালনা করেছেন) রয়েছে, তার শ্রোতাদের কি নির্দিষ্ট সম্মান এবং নম্রতার সঙ্গে জড়িত করা তার দায়িত্ব ছিল না? তিনি কি ভদ্রভাবে ছাত্রের উচ্চারণ সংশোধন করতে পারতেন না এবং এরপরও তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন না? এই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক কারণ তিনি সবেমাত্র ডু বয়েস নিয়ে একটি আলোচনা শেষ করেছিলেন, যেখানে আলোচ্য ছিল কীভাবে সমালোচনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক হতে হবে, নৈতিকভাবে অন্যের কাছে খোলামেলা হতে হবে। সেখানে আলোচনা ছিল এ গণতান্ত্রিকতা হবে তাদের পরিচয় বা অবস্থান নির্বিশেষে (এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে কেন কুমারকে নিজের দলিত পরিচয়টাই তুলে ধরতে হবে, যাতে স্পিভাক তার কথা শোনেন?)
প্রকৃতপক্ষে, এই জাতীয় ডু বয়েজিয়ান গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সত্য হতে, (অন্ততভাবে) অধস্তন শ্রোতা সদস্য তাকে (তার ভুল উচ্চারণের মাধ্যমে, তার প্রশ্নের মাধ্যমে) চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করছিলেন, এটি একটি সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত, বাধা নয়। ব্যাপারটিকে নিচের থেকে একটি প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ হিসেবে দেখা উচিত, একটি কর্র্তৃত্ববিরোধী নীতি-নৈতিকতা যার জন্য উৎসাহ এবং সমর্থন প্রয়োজন যদি আমরা আজ একটি ন্যায়সংগত গণতন্ত্রের দিকে কাজ করতে চাই।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
লেখক: টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড আরবান চেঞ্জের ক্রিটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক