বাংলাদেশ তখন স্বাধীন হয়নি। ছয় দফা আন্দোলন তখন দানা বাঁধছে দেশে। সেই সময় ইংল্যান্ডে হচ্ছিল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠের সেই আসরে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ইংলিশরা। তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতার মতো, কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেল, কিন্তু কোনো শিরোপা আর ধরা দিলো না ইংল্যান্ডকে। একটা সময় যে রাজত্বে কখনও সূর্য অস্ত যেত না, সেই রাজত্বের ফুটবল আকাশে গত ৫৮ বছর ধরেই কালো মেঘের ঘনঘটা। যে মেঘ ভেদ করে ট্রফি নামক সূর্যের উদয় হয় না।
রবিবার রাতে তাদের সামনে সুযোগ এসেছিল ৫৮ বছরের শিরোপা খড়া ঘোচানোর। সঙ্গে প্রথমবারের মতো ইউরো জেতার। কিন্তু সেটা আর হলো না। ৮৬ মিনিটে আরেক বদলী খেলোয়াড় মিকেল ওয়ারজাবালের গোলে বাজিমাত করে দেয় স্পেন। ১২ বছর পরে আবার ইউরোপের সেরা দেশ হয় তারা। আরও একবার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় হ্যারি কেইনদের।
একইভাবে স্বপ্ন ভেঙেছিল ২০২১ সালের ইউরোতেও। সেবার ফাইনাল হয়েছিল ঘরের মাঠ ওয়েম্বলিতে। খেলা গড়িয়েছিল টাইব্রেকারেও। কিন্তু বুকাওয়ে সাকারা চাপ সামলাতে পারেননি। ইতালির কাছে শিরোপা হারাতে হয় তাদের। যে ইতালি আবার পরের বছর কাতার বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি। তারপর কাতার বিশ্বকাপেও তাদের সামনে সুযোগ ছিল শিরোপা উৎসবে মাতার। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালেই তারা বিদায় নেয় ফ্রান্সের কাছে হেরে।
শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে ফেভারিটের তকমা নিয়েই তারা রাশিয়ায় গিয়েছিল বিশ্বকাপ খেলতে। আসরের শুরু থেকেই দুর্দান্ত ছিলেন অধিনায়ক হ্যারি কেইন। প্রথম ম্যাচেই তিনি হ্যাটট্রিক করে আলোচনায় এসেছিলেন। একের পর এক ম্যাচ দুর্দান্ত জয় তুলে নিয়ে উঠেছিল তারা সেমিফাইনালে। সেখানেও তারা অদম্য গতিতে ছুটে যাচ্ছিল। ম্যাচের ৫ মিনিটেই জন ট্রিপারের গোলে এগিয়েও গিয়েছিল ইংলিশরা। কিন্তু ৬৮ ও অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে ১০৯ মিনিটে গোল হজম করে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হেরে শেষ হয়ে তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা। পরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও বেলজিয়ামের কাছে ২-০ গোলে।
সবশেষ দুই ইউরো আর দুই বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোট চারটি আসরে তারা ফেভারিট হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছিল। কিন্তু তকমা গায়ে মাখলে যে চাপ আসে সেটা সামলানোও জানতে হয়, যা তারা পারেনি। হেরে বিদায় নেয় নকআউট পর্ব থেকে। সবচেয়ে বেশি হৃদয় বিদারক ইউরোর ফাইনালে এসে হার। যেন বারবার তীরে এসে তরী ডুবে তাদের।
এই হারের পর ইংল্যান্ডকে তুলনা করা হচ্ছে ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে। যারা বারবার তীরে এসে তরী ডুবায়। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও ভারতের কাছে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয় তাদের। তাদেরও আছে একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা। সেটা ১৯৯৮ সালে আইসিসি নকআউট ট্রফি। তেমনি আবার ইংল্যান্ডেরও আছে সেই ১৯৬৬ সালের সেই বিশ্বকাপ জয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার মতো নিউজিল্যান্ডও ক্রিকেটের চোকার্স হিসেবে খ্যাত। তারাও বারবার তীরে এসে তরী ডুবায়। খেলেছে ওয়ানডে বিশ্বকাপে পরপর দুই ফাইনাল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলেছে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। কিন্তু কোনোটাতেই জিততে পারেনি তারা। তবে তাদেরও আছে একটি বৈশ্বিক শিরোপা। আর সেটা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অভিষেক আসরের ট্রফি জয়। আর সাদা বলে ব্যর্থতার কারণে দলটির অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন ও হ্যারি কেইনকে একইসঙ্গে চোকার্স বলে মন্তব্য করা হচ্ছে। তবে কিউই কেইনের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি থাকলেও হ্যারির কোনোটাই নেই।
ক্রিকেট আর ফুটবলের এসব দলই প্রমাণ করে, ট্রফি শুধু সেরাটা দিয়েই জেতা যায় না। কখনও কখনও ভাগ্যের সহায়তাও লাগে। ঠিক যেমনটা আর্জেন্টিনার বেলায় ছিল ৩৬ বছর। ব্রাজিল ভোগ করছে গত ২২ বছর ধরে। ইংল্যান্ডেও ঠিক সেই সময়টাই পাড় করছে। আর তাই সমালোচনা সহ্যের পাশাপাশি অপেক্ষা করতে হবে আরও ৪ বছর। আগামী ২০২৮ সালে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে যৌথভাবে ইউরো আয়োজন করবে ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ সালে যেমন ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিল, দেখার অপেক্ষার চার বছর ইউরোর ট্রফিও উঁচিয়ে ধরতে তারা পারেন কিনা!