দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলাকালে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত শাহ আমানত সেতু, রাহাত্তারপুল ও বহদ্দারহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় এলাকাগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এদিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে। জবাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কোটা আন্দোলনকারী ২০ জন শিক্ষার্থী, পথচারী ১ জন ও একজন রিকশাচালক আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৯ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ আন্দোলনকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করেছে বলে জানা গেছে।
আহত ২২ জনের মধ্যে একজন কিশোর রিকশাচালক ও পথচারীসহ ৮ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- সরকারি সিটি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরেফিন শুভ (২১), বিজিসি ট্রাস্ট ইউনির্ভাসিটির ছাত্র সাতকানিয়া গরাজিয়া এলাকার নুরুল কবীরের ছেলে সাঈদ (২৪), নগরের ওমর গণি এমইএস কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কুমিল্লা নাঙ্গলকোট থানার কাশীপুর গ্রামের মোহাম্মদ রাসেলের ছেলে মো. শুভ (২২), সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নগরের বাকলিয়া এলাকার মজিবুর রহমানের ছেলে মিনহাজুর রহমান (২৫), নগরের বহদ্দারহাট পূর্ব ফরিদার পাড়ার মৃত মমতাজ আহমদের ছেলে ইসমাঈল হোসেন (৩১), পথচারী শ্রমিক ভোলা জেলার মজিবনগর এলাকার আবুল কালামের ছেলে মো. ইলিয়াছ (২০), আনোয়ারা উপজেলার বুরুমছড়া মৃত মেজাহের হোসেনের ছেলে মো. বোরহানউদ্দিন (২৫), নগরের বাকলিয়া বাস্তুহারা কলোনির আবদুস শুক্কুরের ছেলে রিকশাচালক মো. মোরশেদ (১৫)।
আহতদের মধ্যে সাঈদ, শুভ, ইসমাইল, ইলিয়াছ, বোরহান উদ্দিন ও অজ্ঞাত একজন রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছেন বলে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে সরেজমিন দেখা গেছে, আন্দোলনকারী হাজারখানেক শিক্ষার্থী বহদ্দারহাট মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তাদের বিক্ষোভের মুখে সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় পুলিশ। প্রায় আধাঘণ্টা পর পাল্টে যায় চিত্র। এবার বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে মুর্হুমুর্হু সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী।
পুলিশের আক্রমণের একপর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একদল শুলকবহরের দিকে, আরেকদল মুরাদপুর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের দিকে চলে যান। সাউন্ড গ্রেনেডের জবাবে পুলিশকে লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এর আগে বেলা দেড়টার দিকে বহদ্দারহাট মোড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকে আরাকান সড়কসহ নগরের চান্দগাঁও অংশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থীরা বহদ্দারহাট মোড়ে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় তারা কোটা সংস্কার করা ও আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র হামলায় ৭ জন নিহতের প্রতিবাদে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। এক ঘণ্টার মধ্যেই হাজারখানেক শিক্ষার্থী জমায়েত হন সেখানে। বেলা দেড়টার দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের একটি মিছিল বহদ্দারহাট মোড়ের দিকে আসে। মিছিল থেকে শিক্ষার্থীদের জমায়েতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়।
এরপর শিক্ষার্থীরাও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। বিকাল ২টা পর্যন্ত চলে সংঘর্ষ। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ সরে পড়ে। এর আগে সকাল ১০টার দিকে নগরের বাকলিয়ায় শাহ আমানত সেতুর প্রবেশমুখ অবরোধ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। সেখানে অন্তত আধাঘণ্টা ধরে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে আধা কিলোমিটার দূরে রাহাত্তারপুল এলাকায় গিয়ে জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে বহদ্দারহাটের দিকে চলে যান শিক্ষার্থীরা।
অবরোধে অংশ নেওয়া বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান বলেন, ‘আমরা দেশব্যাপী কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়কে অবস্থান নিয়েছিলাম। পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। পুলিশ আমাদের ওপর টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়েছে। পাঁচ/ছয়জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আমরা হাসপাতালে পাঠিয়েছি।’
অবরোধকারীদের হামলায় পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি করে নগর পুলিশ উপ কমিশনার (দক্ষিণ) আশরাফুল আলম বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের যে আক্রমণাত্মক আচরণ সেটা দেখে মনে হচ্ছে না তারা সাধারণ শিক্ষার্থী। তারা পুলিশের ওপর চড়াও হলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনায় বেশকিছু পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।’
সর্বাত্মক অবরোধের কারণে চট্টগ্রাম নগরের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। রাস্তায় গণপরিবহণ ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়নি। রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশা চলাচলের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত খোলা থাকলেও সেগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। রাস্তায় গাড়ি না পেয়ে কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম নগরের সাধারণ মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।