দেশে বহু অপরাধের তদন্ত হলেও সেগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় না। অভিযোগ রয়েছে, তদন্তকারীরা প্রতিবেদনগুলো লুকিয়ে রাখেন। ঘটনাবলির সঙ্গে কারা যুক্ত বা যুক্ত নয়, তাও জানা সম্ভব হয় না। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা অধিকারবঞ্চিত হন। প্রতিবেদন ঠিকঠাকমতো জমা না হওয়ায় ঠিকমতো বিচারকাজও হয় না। এর ফলে ৮০ শতাংশ আসামিই খালাস পেয়ে যায়। এমনটাই জানা গেছে দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, দেশে ফৌজদারি মামলার তদন্তে ঘাটতির কারণে অভিযুক্তদের দোষ প্রমাণের হার কমবেশি ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশ আসামিই খালাস পেয়ে যায়। থানা-পুলিশের একেকজন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে অনেক মামলা থাকে। তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নানা কাজেও সক্রিয় থাকতে হয়। তদন্তে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না তারা।
অনেকের বিরুদ্ধে প্রভাবশালীর চাপে তদন্ত ভিন্ন খাতে অথবা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আছে। তদন্তে বড় ধরনের দুর্বলতা থাকলে তা রায়ের আগেই নজরে আনা সম্ভব। সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অসম্পূর্ণ প্রতিবেদনের বিষয়ে অভিমত দিয়ে আবার তদন্তের কথা বলতে পারেন। আবার চার্জ গঠনের সময় বা বিচার চলাকালে পুলিশ প্রতিবেদনে দুর্বলতা ধরা পড়লে স্বপ্রণোদিত হয়ে পুনরায় তদন্তের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। কারণ অসম্পূর্ণ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচার হলে আসামিপক্ষ রেহাইয়ের সুযোগ পায়। সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি দম্পতির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে লুকোচুরি সর্বজনবিদিত। পুলিশের তিনটি ইউনিট এ মামলার তদন্ত করেছে। সর্বশেষ তদন্ত করছে পিবিআই। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ১১৫ বার পেছানো হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর গভীর রাতে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তাতে দুজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ছয় বছর পর এ মামলার রায় হয়।
বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তার অবহেলায় মূল পরিকল্পনাকারীরা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, ‘ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় অস্বচ্ছ তদন্তকাজ প্রতিরোধ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানে বিত্তশালী ও ক্ষমতাধররা প্রায়ই দায়মুক্তি পেয়ে যায়। অপরাধ করেও প্রভাব খাটিয়ে তারা সহজেই তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যায়। অনেক মামলা আছে, যেখানে পুলিশ, অপরাপর তদন্ত সংস্থা, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন দিয়ে অপরাধীকে সাহায্য করেছে। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই তারা এমন বেআইনি কাজ করে থাকে। এ রকম অসৎ ও উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত চলতে পারে না। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তার জবাবদিহি থাকতে হবে। এ মামলার বাদী তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি।’
বছর চারেক আগে মামলার সাজার অনুপাত নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তাতে দেখা যায়, নারী নির্যাতন মামলার ৯৫ শতাংশ আসামিই খালাস পাচ্ছে। ধর্ষণ মামলার ৮৮ শতাংশ, দ্রুত বিচার আইনের মামলার ৮৭ ও হত্যা মামলার ৭৬ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। তারা অনেকটা চাপে পড়ে তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বাদীদের জানান না। ইউনিট চিফদের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও তা চাপা পড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, একের পর এক ঘটছে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনা। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন হলেও কিছুদিন পরই থমকে যায় তদন্ত। আড়ালে থেকে যায় প্রকৃত ঘটনা। কারণও অজানা থেকে যায়। দুর্ঘটনা বা নাশকতা রোধে তৎপর নয় সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ। ঘটনার পর প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসলেও আদতে এসব লোকদেখানো তৎপরতা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এহেন আচরণ দেশের বিচার তথা সমাজের ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতার প্রতি চরম এক হুমকি। অচিরেই এই অবস্থার নিরসন করে দেশে বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি।