শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

রপ্তানি বহুমুখীকরণেই  শক্তিশালী অর্থনীতি

আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬ এএম

একটি দেশের চালিকাশক্তি হলো অর্থনীতি। এটি দুর্বল হলে বহুমুখী সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো, জনগণের জীবন মান নিম্নমুখী হয়। ফলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রোভার্টি ম্যাপ অব বাংলাদেশ ২০২২-এর ফলাফলে এসেছে এমন তথ্য। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মাসে তৈরি পোশাক, ওষুধ এবং চামড়াসহ ২৭ ধরনের পণ্য বিশ^বাজারে রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে জানানো হয়, জানুয়ারি মাসে দেশে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৪৪৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বছরের ব্যবধানে যা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। কোনো দেশে যখন নানা কারণে অর্থনীতি চাপের ভেতর থাকে তখন মানুষের আয় কমতে পারে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে এবং একই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন ডলার সংকটও দেখা দেয়। এসব থেকে উত্তরণের জন্য অর্থনীতির গতি ফেরানো জরুরি। কিন্তু প্রতিটি দেশের অর্থনীতিই কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। আমাদের দেশের অর্থনীতি এখন যেভাবে পোশাকশিল্প, রেমিট্যান্স, কৃষি ইত্যাদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কোনো দেশ আবার চলছে পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে। যেমন শ্রীলঙ্কা।

আমাদের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সর্ব প্রথমেই রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প। গত কয়েক দশকে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তৈরি পোশাকশিল্প ছাড়া আরও কয়েকটি শিল্প দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ৩৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে ৮১ দশমিক ২৪ শতাংশই রপ্তানি করেছে পোশাক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। এর বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি বাবদ খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ডলার। ওই বছরে নিট আয় হয়েছিল ২ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার বা ৫৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় দেখানো হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। পরে তা সংশোধন করে দেখানো হয়, ৩ হাজার ৮১৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ আমরা পোশাকশিল্পের ওপর গত কয়েক বছরে একটু বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এমন পরিস্থিতি আসতে পারে, যখন পোশাকশিল্পে ধাক্কা লাগবে বা লাগার সম্ভাবনা থাকে।  যে কারণে অর্থনীতির চাপ সামলাতে প্রয়োজন বিকল্প খাত থেকে রপ্তানি আয় অব্যাহত রাখা। এ রকম এক বা একাধিক খাতের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

রপ্তানি আয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে অবদান রাখছে এমন বহু পণ্য রয়েছে। কিন্তু সরকারি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং দক্ষ কারিগর না থাকায় সেসব পণ্য অযতেœ রয়েছে এবং রপ্তানি খাতে কাক্সিক্ষত সাফল্য পাচ্ছে না। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য। চামড়ার ওপর ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৩০টিরও বেশি ট্যানারি। বিশ^ব্যাপী বর্তমানে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের চামড়ার বাজার রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। চামড়ার বাজারের সিংহভাগই রয়েছে চীন ও ভারতের দখলে। এ খাতে একটি বড় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত তদারকি এবং একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাজারটি আমরা ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি। অথচ পোশাকশিল্প বাদ দিলে অনায়াসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আমরা আয় করতে পারি।

অর্থনীতির বিকল্প উৎস হিসেবে সমুদ্র অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যেতে পারে। বিশ্বের কয়েকটি দেশের অর্থনীতি সমুদ্রনির্ভর। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া বর্তমান সময়ে জিডিপিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। গত পাঁচ বছর চীনের অর্থনীতিতে ১.২ ট্রিলিয়ন  মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা চীনের জিডিপির ১০ শতাংশ। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান ছিল ৩৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ২ শতাংশ এবং ৩ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছিল। আমরা কিন্তু সমুদ্র অর্থনীতিকে এখনো অর্ধেকটাও কাজে লাগাতে পারছি না। দুর্বল জায়গা হলো প্রযুক্তি ও দক্ষতা। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ। যদি চাঙা করা যায় তাহলে এটি হতে পারে অন্যতম প্রধান রপ্তানি আয়ের উৎস।

ওষুধশিল্প গত এক দশকে অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর সময়কালে দেশে ওষুধ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫২.৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯২.৫৮ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে রপ্তানি হয়েছে ২২.৭৩ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই মাসে ছিল ১৩.১৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ মেটানোর পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাসহ ১৫১টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। মোট কথা, আমাদের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো একটি বিশেষ খাত বা সেক্টরের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা অর্থনীতিতে যেকোনো সময় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের হাতে একাধিক চমৎকার বিকল্প অর্থনীতির সুযোগ রয়েছে। রয়েছে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের বহুমুখীকরণের সুবিধা। এসব খাতে প্রচুর কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে দেশের বেকারত্বেরও সমাধান হবে। ফলে অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পাবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected] 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত