সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

শীর্ষ ধনী থেকে সংকটের মণি

আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:১০ এএম

বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশযান প্রস্তুতকারক এবং গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের প্রাধান নির্বাহী ইলন মাস্ক। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের (সাবেক টুইটার) মালিকও এখন তিনি। এ ছাড়া নিউরালিঙ্ক, দ্য বোরিং কোম্পানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা সংস্থা ওপেনএআইসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ইলন মাস্কের। আর এসব সংস্থার আয়েই মাস্ক হয়ে উঠেছেন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তবে ইলন মাস্ক এখন শুধু প্রযুক্তি ব্যবসায়ী নন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের সমর্থনে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। পিটিশনে স্বাক্ষরে উৎসাহিত করে ভোটারদের ১০ মিলিয়ন ডলার করে অর্থ পুরস্কার দিয়েছেন, যা নিয়ে ভোটের আগেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। সব মিলিয়ে সবশেষ নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন জানানোর পর থেকে, পুরোদমে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন তিনি। আর এসব কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবে ট্রাম্পের আস্থা অর্জন ও তার নতুন প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছেন ইলন মাস্ক। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তার কিছু কর্মকাণ্ড ও মন্তব্যে সমালোচনার মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন ব্যবসায় থেকে রাজনীতিতে আসা মাস্ক।

অনেকটাই ট্রাম্পের দেখানো পথে হাঁটছেন ইলন মাস্ক। গত বছর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছেন। রাজনীতিতে আসার পর থেকেই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচনায় পর্যবসিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। মাস্ক এগোচ্ছেন অনেকটা একই গতিতে। তিন সপ্তাহ আগে ক্ষমতা গ্রহণকারী ট্রাম্প কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে এরই মধ্যে অনেকগুলো নির্বাহী আদেশে সই করেছেন। আর তার এই সরকারের ব্যয় সংকোচনের দায়িত্ব পেয়েছেন ইলন মাস্ক। ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিশিয়েন্সি (ডিওজিই) বা সরকারি দক্ষতা বিভাগের প্রধান করা হয়েছে তাকে। ডিওজিইর প্রধান হওয়ায় দেশটির লাখো নাগরিকের ব্যক্তিগত ও আর্থিক খাতের তথ্য মাস্কের হাতে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইউএসএআইডি নিয়ে সমালোচনা

যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। গত ২০ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েই বিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব ধরনের বৈদেশিক সহায়তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের নির্দেশ দেন ট্রাম্প। বিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পৌঁছে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করত ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)। ট্রাম্পের ঘোষণার পর সংস্থাটির ব্যয়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন মাস্ক। ইউএসএআইডিকে অপরাধী সংগঠন অ্যাখা দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন নতুন সরকারি কর্মদক্ষতা বিভাগ ডিওজিইর প্রধান ইলন মাস্ক। তার অভিযোগ, সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের টাকায় জৈব অস্ত্র গবেষণায় অর্থায়ন করেছে। পাশাপাশি চীনের উহানে গবেষণা প্রকল্পে ইউএসএআইডির সহায়তার কারণে বিশ্বে কভিড-১৯-এর মতো জীবাণু ছড়ায় বলেও সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন ইলন মাস্ক।

তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর, হোয়াইট হাউজসংলগ্ন ইউএসএআইডি সদর দপ্তরে ঢোকার চেষ্টা চালিয়েছেন মার্কিন সরকারি কর্মদক্ষতা বিভাগের সদস্যরা। সেখান থেকে সংস্থাটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কর্মীদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। তবে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বাধার মুখে সংস্থাটির দপ্তরে প্রবেশ করতে পারেননি ডিওজিইর কর্মীরা। আর তাতেই চটেছেন মাস্ক। ওই ঘটনার জেরে সংস্থাটির শীর্ষ দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বলেও জানা গেছে। পরে বিশ্ব জুড়ে ইউএসএআইডির কর্মীদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো ও ছাঁটাইসংক্রান্ত নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদিও ইউএসএআইডির কর্মীদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ আটকে দিয়েছে ওয়াশিংটনের ডিস্ট্রিক্ট জজ আদালত। তবে ইউএসএআইডির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখেই রয়েছে। কর্মীদের দপ্তরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসন সংস্থাটিকে পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে। ফলে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের ভবিষৎ নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। সংস্থাটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা কর্মসূচিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

এদিকে যে সংগঠনটিকে অপরাধী সংগঠন বলছেন মাস্ক, সেই ইউএসএআইডির কাছ থেকে ৪০ লাখ ডলার তহবিল নিয়েছিলেন ইলন মাস্ক। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তথ্য অনুসারে, গত চার বছরে ইউএসএআইডি মাস্কের ইন্টারনেট কোম্পানি স্টারলিংককে ১০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। মূলত জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকায় স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবস্থা সরবরাহের জন্য এই অর্থ দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ইউক্রেনে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্যও ইলন মাস্কের কোম্পানিকে ৩০ লাখ ডলার দিয়েছিল ইউএসএআইডি।

উগ্রপন্থার বিস্তার

মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নেই। তিনি কট্টর ডানপন্থি ট্রাম্প ও তার মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছেন। এবার তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। তিনি চরম ডানপন্থি মতাদর্শ উসকে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত এক বছরে মাস্ক যুক্তরাজ্যের কট্টর ডানপন্থি ব্যক্তিদের বারবার সমর্থন দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে টমি রবিনসন ও নাইজেল ফারাজের মতো উগ্রপন্থিরা। মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে জাতিগত ঘৃণা ছড়ানো ও উসকানির অভিযোগে রবিনসন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন ও শাস্তি পান। তা সত্ত্বেও তার মুক্তির জন্য সামাজিক মাধ্যমে সরব থেকেছেন মাস্ক। সম্প্রতি মাস্ক দাবি করেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের দায়িত্বে থাকাকালে দলবদ্ধ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। এক্স পোস্টে তিনি লেখেন, স্টারমার ব্রিটেনের ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগী ছিলেন এবং তার বিচার হওয়া উচিত। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের উপমন্ত্রী জেস ফিলিপসকে ধর্ষণের সমর্থক বলে মন্তব্য করেন মাস্ক। এমনকি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে রাজা চার্লসকে নতুন নির্বাচনের ডাক দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বিশ্বব্যাপী মাস্ক তার কট্টর ডানপন্থা উসকে দেওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জার্মানির রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছেন। দেশটির কট্টর ডানপন্থি দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানিকে (এএফডি) প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। গত ডিসেম্বরে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি এএফডিকে জার্মানির শেষ আশার আলো বলে উল্লেখ করেন। সে লেখায় তিনি বলেন, অভিবাসন সীমিত করার মাধ্যমে দলটি দেশকে নিরাপদ রাখতে ও জার্মান সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারবে। তার এই প্রকাশ্য সমর্থন থেকে ধারণা করা হচ্ছে, চলতি মাসে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনে ডানপন্থি এএফডিকে জয়ী করতে সাহায্য করতে চাইছেন তিনি।

বিশ্ব জুড়ে কট্টর ডানপন্থিদের উত্থানে ভূমিকা রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন ট্রাম্প। যেখানে মাস্কও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া মাস্ক প্রকাশ্যে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেয়ির প্রশংসা করেছেন। মিলেয়ির কঠোর অর্থনৈতিক নীতিগুলো ডিওজিই নীতির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তবে ডানপন্থার বিস্তারে মাস্কের এসব প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল না হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে তা প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সরকারি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ

মাস্কের সরকারি দক্ষতা বিভাগের দলটি তার নিজের কোম্পানির লোকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। তবে মাস্ক ও তার সহযোগীদের লাগামহীন মনোভাব নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারা নাটকীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কোষাগারের পাওনা মেটানোর ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ দখল করেছেন। এমনকি ফেডারেল কর্মীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ দিয়ে পদত্যাগ করানোর একটি উদ্যোগে সহায়তা করছেন। একটি ই-মেইলের মাধ্যমে ফেডারেল কর্মীদের কাছে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কর্মীদের কাছে পাঠানো সাম্প্রতিক ই-মেইলের সঙ্গে টুইটার কিনে নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের কাছে পাঠানো মাস্কের ছাঁটাইসংক্রান্ত ই-মেইলটির সাদৃশ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে বিশ্বের শীর্ষ ধনী থেকে ক্রমশ সংকটের মণি হয়ে উঠেছেন মাস্ক।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত