শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

মরুর বুকে পুতিন-ট্রাম্প বৈঠক

আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:৪৯ এএম

প্রায় তিন বছর ধরে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। দীর্ঘ এ যুদ্ধে ইউক্রেনের ২০ শতাংশ ভূখণ্ডের দখল রাশিয়ার হাতে রয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বেশ কয়েক মাস ধরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর ক্রমেই লোকবল সংকটে জর্জরিত হয়ে উঠছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। পশ্চিম রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ছোট একটি এলাকা দখল ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য নেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এ যুদ্ধ অবসানের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এরই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে নতুন ট্রাম্প প্রশাসন। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসে সৌদি আরবে পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক আইনপ্রণেতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞাত এক সূত্রের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। একনজরে আসন্ন এ বৈঠক ও যুদ্ধের অবসানে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান দেখা নেওয়া যাক।

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক

যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ কর্মকর্তাদের বৈঠক হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য মাইকেল ম্যাককল জানিয়েছেন, দ্রুতই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ও হোয়াইট হাউজের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ সৌদি আরব সফর করবেন। তবে ইউক্রেন-রাশিয়াবিষয়ক আলোচনার জন্য ট্রাম্পের নিয়োগকৃত বিশেষ দূত কিথ কেলোগ এ সফরে থাকবেন না। সেই সঙ্গে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কারা অংশ নেবেন, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের সাইডলাইনে তিনি আরও বলেন, শান্তি স্থাপন ও সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে এ বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞাত এক সূত্র সৌদি আরবে মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তাদের বৈঠক আয়োজনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়নি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের একটি প্রতিনিধিদল সৌদি আরব সফরের পর এ বৈঠকের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে। একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক সংবাদমাধ্যম পলিটিকোও। এর আগে গত বুধবার পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ও পুতিন সম্ভবত সৌদি আরবে দেখা করবেন। বৃহস্পতিবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রুশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা তৃতীয় কোনো দেশে বৈঠক করতে সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেন, সৌদি আরবের নাম আলোচনায় এসেছে, তবে এখনো বৈঠকের স্থান চূড়ান্ত হয়নি। বিশ্লেষকদের ধারণা, যুদ্ধ বিষয়ে দুই নেতা আলোচনার ধারা অব্যাহত রাখা ও তৃতীয় কোনো দেশে সাক্ষাৎ আয়োজনের মাধ্যমে পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফরের ব্যাপারে একমত হতে পারেন।

আমন্ত্রণ পায়নি ইউক্রেন

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ বৈঠকে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। শুক্রবার জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, সৌদি আরবে হওয়া এ আলোচনায় ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ সময় সম্ভাব্য এই শান্তি আলোচনা সম্পর্কে নিজের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেছেন জেলেনস্কি। তিনি বলেন, কৌশলগত অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসবে না কিয়েভ। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিয়েভের দূতরা সৌদি আরবে উপস্থিত থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আলোচনার প্রস্তুতি সম্পর্কে তারা পুরোপুরি অবগত নন। জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও তুরস্ক সফর করবেন। এ সফরের দিনক্ষণ বিষয়ে জেলেনস্কি বিস্তারিত না জানালেও তিনি বলেন, আসন্ন এ সফরে যুক্তরাষ্ট্র বা রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার কোনো পরিকল্পনা নেই তার।

জরুরি সম্মেলন ডেকেছে ইউরোপ

গত ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বুধবার পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে পৃথক ফোনালাপ করেছেন, যা ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তাদের আশঙ্কা শান্তি প্রক্রিয়া থেকে ইউরোপকে বাদ দেওয়া হতে পারে। সেই আশঙ্কা স্পষ্ট হয়েছে শনিবার ইউক্রেন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত কিথ কেলোগের ঘোষণায়। তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের আসন্ন আলোচনায় ইউরোপকে যুক্ত করা হবে না। এ উদ্বেগ থেকে ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেন বিষয়ে জরুরি সম্মেলনের ডাক দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ওই সম্মেলন হবে। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোসøাভ সিকোরস্কি বলেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর উদ্যোগে জরুরি ওই সম্মেলন ডাকা হয়েছে। তবে মাখোঁ এখনো সম্মেলনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেননি।

প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ সম্মেলনে যোগ দিতে পারেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। সেই সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এটা স্পষ্ট যে, ইউরোপ পরিচালনায় ন্যাটোকে আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে। এ মাসের শেষদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যুক্তরাষ্ট্র যাবেন স্টারমার। ট্রাম্পের কাছে তিনি ইউরোপের নেতাদের অবস্থান তুলে ধরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিয়ার স্টারমার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ঐক্য ধরে রাখা নিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্য কাজ করবে। ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে লড়াই বন্ধে ২০১৫ সালে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়েছিল, যা মিনস্ক চুক্তি নামে পরিচিত। ব্যর্থ ওই চুক্তি ইউরোপকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ন্যাটোসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের নেতাদের মতপার্থক্যের জেরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

ল্যাভরভ ও রুবিওর ফোনালাপ

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শনিবার ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে জো বাইডেন প্রশাসনের আরোপ করা একতরফা নিষেধাজ্ঞা অপসারণের বিষয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে মস্কো। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ল্যাভরভ ও রুবিও ফোনালাপে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমস্যা সমাধানের জন্য যোগাযোগ বজায় রাখতে সম্মত হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, পারস্পরিক বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ সহযোগিতার স্বার্থেই আরোপ করা একতরফা নিষেধাজ্ঞা অপসারণের বিষয়ে যোগাযোগ করা হবে। তবে কোন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়নি।

রাশিয়া বলছে, ল্যাভরভ ও রুবিও ইউক্রেনের মীমাংসা, ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে চাপ দেওয়ার জন্য তাদের পারস্পরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া

নিজ ভূখণ্ডে ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক আয়োজনকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদি আরব। এক বিবৃতিতে সৌদি কর্র্তৃপক্ষ জানায়, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সৌদি আরব তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। জল্পনা রয়েছে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও সেই বৈঠকে অংশ নিতে পারেন।

আসন্ন ট্রাম্প-পুতিন সম্মেলনের জন্য চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ আয়োজক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তবে মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট পল সেলেম মনে করেন, নিরপেক্ষ স্থান হওয়ায় সৌদি আরব একটি যৌক্তিক পছন্দ। এর ব্যাখায় তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের কঠোর অবস্থানের কারণে কোনো ইউরোপীয় দেশে এ বৈঠক আয়োজন সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক অধ্যাপক খাত্তার আবু দিয়াব বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে জেনেভার মতো স্থান বেছে নেওয়া হতো। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবার বিকল্প হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, সৌদি আরব পুতিনের সঙ্গে সফলভাবে পারস্পরিক স্বার্থ ও আস্থার ভিত গড়ে তুলেছে। পুতিনের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। তবে সৌদি আরব আইসিসির সদস্য দেশ না হওয়ায় সেখানে গেলে পুতিনের গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নেই। এ বিষয়টিও সৌদি আরবকে বেছে নিতে সহায়তা করেছে। সেই সঙ্গে তেল ও কৌশলগত অংশীদারত্বসহ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ও প্রাধান্য পেয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত