বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

চাল নিয়ে চালবাজি রোধ জরুরি

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৩ এএম

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার চালের আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করলেও বেসরকারিভাবে আশানুরূপ চাল আমদানি হয়নি এবং কমেনি চালের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত ১ জুলাই থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ১ লাখ ১৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়, যা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল আমদানি না হওয়ায় সরকার ভারত, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা এ মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা যাবে না।  

সরকারি  প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে মোটা চালের দাম এখন ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। মাঝারি চালের দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল  ৫০ থেকে ৫২ টাকা। আর চিকন চালের দাম ৮০ থেকে ৮৪ টাকা, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। বাজার নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে সরকার টিসিবির মাধ্যমে ও স্বল্পমূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু করলেও তার পরিমাণ ও প্রভাব যথেষ্ঠ নয়। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও চাল না পেলে বিষন্ন বদনে বাড়ি ফিরছেন।

উৎপাদন খরচ গত বছরের চেয়ে প্রতি কেজিতে দুই থেকে আড়াই টাকা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার  চলতি আমন মৌসুমে গতবারের চেয়ে প্রতি কেজি ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য তিন টাকা বাড়িয়ে কৃষক ও মিল মালিকদের কাছ থেকে ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না।

খোলাবাজারে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ধান-চালের দাম বেশি থাকায় মিল মালিক এবং কৃষক সরকারি গুদামে প্রত্যাশা মোতাবেক ধান-চাল সরবরাহ করছেন না। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল ক্রয় করেও সরকারি গুদামে চালের মজুদ বাড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টন ধান ও চাল, যা প্রয়োজনের চেয়ে অত্যন্ত কম। দেশে এমন খাদ্যগুদামও আছে, যেখানে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি এক কেজি ধানও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

চালকল মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের গতি মন্থর। তবে অধিকাংশ মিল মালিক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চুক্তি মোতাবেক এখনো চাল সরবরাহ করার আশা পোষণ করছেন। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, বাজারে চালের দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি হলে মিল মালিকরা চুক্তি মোতাবেক সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করেন না। এ জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও মিল মালিকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চাল সরবরাহে ব্যর্থ মিল মালিকদের কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা উচিত।

গত ৮ জানুয়ারি, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সচিবালয়ে তার নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ওই মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারিভাবে ১ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আসার কথা জানান। তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে  ২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য দরপত্র খোলা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে এক লাখ টন চাল আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পাকিস্তান থেকেও ৫০  হাজার টন আতপ চাল কেনার কথা জানান তিনি। সরকারিভাবে এক লাখ টন চাল আসলে চালের দাম অবশ্যই হ্রাস পাবে বলে তার প্রত্যাশা। তার মতে, চালের শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। চলমান ওএমএস কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। টিসিবির মাধ্যমে সারাদেশে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টন চাল বিতরণ করা হচ্ছে। মার্চ মাস থেকে  খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু করা হবে। এ কর্মসূচির অধীনে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে প্রতি মাসে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। অন্যদিকে  মজুদবিরোধী আইন প্রয়োগে জেলা প্রশাসকগণকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তরের  কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই অচিরেই চালের দাম কমতে শুরু করবে।   

আমি মনে করি, চালের বাজার ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হলে ভিজিডি ও ভিজিএফের মাধ্যমে চাল বিতরণের কাজ আরও গতিশীল এবং জোরদার করতে হবে। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে মজুদদার ও অসাধু ব্যবসায়ীগণের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া দেশের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক এবং  ক্ষেতমজুরদের  মধ্যে পল্লী রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পদামে চাল সরবরাহ করতে হবে। দেশের প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানার নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মীদের রেশনের মাধ্যমে কম মূল্যে নিয়মিত চাল সরবরাহ করতে হবে। মিল মালিকদের চুক্তি মোতাবেক চাল  সরবরাহে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে খোলাবাজারে ধানের উচ্চমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে মিল মালিক ও কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ধান-চালের সরবরাহ মূল্য পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। সরকারি গুদামে আর্দ্রতা বেশির অজুহাতে কৃষক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ধান সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষকদের ধানের মূল্য প্রদান করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। প্রতিটি চালের দোকানে বিক্রয় মূল্যের তালিকা প্রকাশ্য স্থানে টানানো নিশ্চিত করতে হবে। দৃঢ় বিশ্বাস, এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে চাল নিয়ে চালবাজি রোধ কমবে এবং চালের বাজারে অস্থিরতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং ভোক্তারাও যৌক্তিক মূল্যে চাল কেনার সুযোগ পাবেন।

 লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)  বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত