শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪ এএম

আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি ওরফে আহমেদ আল-শারার মতো সিরিয়ার জনগণও উভয় সংকটে পড়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে ইদলিবের সুরক্ষিত নিরাপদ ঘাঁটি থেকে অভিযান শুরু করার সময় জোলানি ও তার যোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল বড়জোর আলেপ্পো পর্যন্ত দখল করা। অথচ বাশার আল-আসাদের শাসনভিত মাত্র ১১ দিনে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে। বিদ্রোহীরা পৌঁছে যায় রাজধানীতে এবং জোলানি নিজেকে দামেস্কের মসনদে আবিষ্কার করেন। অন্তর্রর্তী সরকার গঠন করার পর জোলানির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ দেশকে স্থিতিশীল করা। কিন্তু কয়েক দশকের স্বৈরশাসন রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রায় অকেজো করে ফেলেছে। সিরিয়ার বেসামরিক প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে পলাতক প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যই ছিল প্রধান মানদণ্ড। ফলে আমলাতন্ত্র অযোগ্য অদক্ষ কর্মীতে সয়লাব। এদিকে একনায়কতন্ত্রের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর জনগণ দৃশ্যমান পরিবর্তন চায়। আসাদবিরোধী সংগঠনগুলোর মধ্যে মতাদর্শিক পার্থক্য রয়েছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, মাত্রাহীন দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা দেশটির খাদ্য সরবরাহ, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি জরুরি সেবার অবকাঠামোকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জোলানি জেনেশুনে হয়তো বিষ পান করেছেন। তবে বিষক্রিয়ায় প্রাণ হারাবেন নাকি নীলকণ্ঠ হবেন, সেটাই প্রশ্ন। অন্যদিকে সিরিয়ার মানুষ আসাদ পরিবারের বিকল্প হিসেবে কট্টরপন্থি সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠীকে তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হিসেবে প্রত্যাশা করেনি। এই মুহূর্তে দেশের যে অবস্থা তাতে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করাও যুক্তিযুক্ত নয়। বাশারের বিদায়ে সিরিয়ার ব্যাপারে নতুন করে ছক সাজাচ্ছে বৃহৎ পরাশক্তিগুলো। সীমান্তে ক্রমাগত উসকানি দিচ্ছে তুরস্ক ও ইসরায়েল। হায়াত তাহরির আল-শামসের নেতা শারার ওপরই তাই সিরিয়ার নাগরিকদের ভরসা রাখতে হচ্ছে। সিরিয়া ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে সেই ব্যাপারে ঝানু বিশ্লেষকরাও নিশ্চিত হতে পারছেন না।

সিরিয়ার আকাশে আফগানিস্তান, লিবিয়া নাকি তিউনিসিয়ার ছায়া?

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ ইয়াকুব ইমাদ যেমন আশঙ্কা করছেন, সিরিয়ার পরিণতি তার দেশ আফগানিস্তানের মতো হতে যাচ্ছে। মিডল ইস্ট মনিটর-এ প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণে তিনি স্বীকার করেছেন যে, দুই দেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শাসনতান্ত্রিক পার্থক্য রয়েছে। তবুও আশরাফ গনির সরকারকে যেভাবে বিদ্যুৎগতিতে তালেবান উৎখাত করেছিল তার সঙ্গে হায়াত তাহরির আল-শামসের সাম্প্রতিক সাফল্য মিলে যায়। তালেবান মাত্র এক সপ্তাহের অভিযানে কাবুল দখল করেছিল। হায়াত তাহরির তেমনি দ্রুততার সঙ্গে একের পর এক এলাকা কব্জা করেছে।

নব্বইয়ের দশকে আফগানিস্তানে নাজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটায় যে মুজাহিদীন গোষ্ঠীগুলো, সৈয়দ ইয়াকুবের মতে, হায়াত তাহরির সেই মুজাহিদীনদের কিছু মতাদর্শ অনুসরণ করে। আর নাজিবুল্লাহর কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে আসাদের বাথ পার্টির খানিকটা মিল পাওয়া যাবে। আফগানিস্তান ও সিরিয়া উভয় দেশেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিয়া জনগোষ্ঠী বাস করে। তবে আফগানিস্তানে স্মরণাতীত কাল থেকে সুন্নিরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে আলাওয়িরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আলাওয়িরা নিজেদের শিয়া দাবি করলেও তাদের আচারপ্রথা ও বিশ্বাসে অনেক ভিন্নতা রয়েছে। আসাদের পতনের পর প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে প্রভাবশালী আলাওয়িরা সাময়িকভাবে পিছু হটেছে। নৃ-তাত্ত্বিক বৈচিত্র্যও দুই দেশের একটি বৈশিষ্ট্য। তবে আরব, তুর্ক ও কুর্দরা সিরিয়ার একেক অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আর আফগানিস্তানে পশতুন, তাজিক, উজবেক ও হাজারাদের একই অঞ্চলে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাস করতে দেখা যায়। তবে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত। সিরিয়ার নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে হায়াত তাহরির নারীদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তালেবান যা এখনো করতে পারেনি। সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক পার্থক্যও দৃশ্যমান হচ্ছে। হায়াত তাহরিরের প্রধান নেতা আল-শারা দেশে-বিদেশে বৈঠকে এবং মিডিয়ার সামনে হাজির হচ্ছেন পশ্চিমা কোট-প্যান্ট গায়ে চরিয়ে। তালেবান নেতারা সচেতনভাবেই পশ্চিমা পোশাক প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। তাদের সাধারণত দেখা যায় আফগানিস্তান/পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে।

তালেবানরা যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। পক্ষান্তরে চার বছরের আগে সিরিয়ায় কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে হায়াত তাহরির আল-শামস। উভয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর পতাকা সাদা এবং তা কালিমাখচিত কিন্তু হায়াত তাহরির জাতীয় ঐক্যের প্রতি সংহতি জানাতে সিরিয়ার আসাদবিরোধী দলগুলোর পতাকাটিও অনুমোদন করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন, সম্ভাব্য টানাপড়েন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, ভঙ্গুর সামাজিক কাঠামো ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে সৈয়দ ইয়াকুবের মতামত হলো, উভয় দেশের চ্যালেঞ্জগুলো প্রায় একইরকম। জরুরি সংস্কার ছাড়া তালেবান কিংবা হায়াত তাহরির কেউই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না। রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি তাদের মূল এজেন্ডা হওয়া উচিত।

এদিকে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিবিয়ার প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাজলা মোহামেদ এল-মাঙ্গুস লিখেছেন, সিরিয়ার পরিস্থিতি দেখে তার গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ার কথা মনে পড়েছে। গাদ্দাফির পতনের পর তারা সরলমনে বিশ্বাস করেছিলেন যে, লিবিয়া আজাদ হয়েছে। তবে বিপ্লবের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস খুব দ্রুত অশনি বাস্তবতায় রূপ নেয়। লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ও জাতীয় ঐক্যের সরকারের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়। সালাফি মতাদর্শের কট্টরপন্থি গোষ্ঠীগুলো বেনগাজি দখল করে। যুদ্ধবাজ সর্দাররা লিবিয়াকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। উদ্বাস্তু হয় ৪ লাখ মানুষ।

তবে হনুমানের লেজে আগুন লাগলে লংকা যেমন পুড়ে ছাই হয় তেমনি লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উখাত করে ইউরোপ পড়েছে নতুন বিপদে। গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা। বর্তমানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার জন্য যারা মরিয়া তাদের ৯০ শতাংশই যাচ্ছে লিবিয়া হয়ে। নাজলা মোহামেদ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, লিবিয়ায় বিপ্লবের পর বারাক ওবামা, ফ্রান্সের সারকোজি ও ব্রিটেনের ডেভিড ক্যামেরনসহ ন্যাটোর নেতারা লিবিয়ার পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের বক্তব্যগুলো ছিল আদতে কথার ফুলঝুরি। লিবিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন পূরণে বিশ^নেতারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেনি।

ধীরে ধীরে লিবিয়া একসময় ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সিরিয়ার কপালেও একই পরিণতি জুটতে পারে। শান্তি ও বিশৃঙ্খলার মধ্যবর্তী অবস্থায় সিরিয়া দুলছে। হায়াত তাহরির-এর প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর মদতে যেকোনো সময় শুরু হতে পারে ক্ষমতার রক্তক্ষয়ী লড়াই।

সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার এখন যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তিউনিসিয়ার রাজনীতিবিদ জায়িদ লাজারি নিজ দেশে বিপ্লব-পরবর্তী মাসগুলোতে তা স্বচক্ষে দেখেছেন। ২০১১ সালে একনায়ক জয়নুল আবেদিন বেন আলীর পতনের পর তিউনিসিয়ার উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বিষয়কমন্ত্রী হন লাজারি। তিউনিসিয়া যদিও সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের শিকার হয়নি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষম ছিল, তবুও দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে তাকে ভীষণ হিমশিম খেতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তার এক নম্বর পরামর্শ হলো, ক্ষমতা হস্তান্তরের সর্বগ্রহণযোগ্য ও নিখুঁত রাস্তা খোঁজার চেয়ে মৌলিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে মনোযোগী হোন। এনাহাদা পার্টি তিউনিসিয়ার জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজে তিন বছর সময় ব্যয় করেছিল। এখন এসে লাজারির মনে হয়, ওটা ভুল ছিল। নতুন সংবিধান তৈরির জন্য আমরা বেন আলির সরকারকে উৎখাত করিনি। আত্মমর্যাদা, রুটি-রুজির নিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান পাওয়ার আশায় আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। আর এটা করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। সেটা করতে হলে সরকারের সঠিক জায়গায় সঠিক লোকটিকে অর্থাৎ যোগ্য মানুষকে বসাতে হবে। কেবল একই মতাদর্শের নিয়োগ করলে চলবে না।  লাজারি জানিয়েছেন, তারা যখন দক্ষ যোগ্য লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দিতে শুরু করলেন, কায়েমি স্বার্থপর ঝানু রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতা আসে। চারদিক থেকে এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো রাষ্ট্র গঠনের কাজটিকে অগ্রাধিকার তালিকায় না-ও রাখতে পারে। তবে এর কোনো বিকল্প নেই। আসাদকে উৎখাতের উত্তেজনা অল্প কিছুদিন পরই মিইয়ে যাবে। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এখনই শুরু না করলে জনগণের ক্ষোভ ক্রমে বাড়বে।

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সিরিয়ার ৯০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে দারিদ্র্যের কবলে আক্রান্ত। সম্প্রতি এক মাস ধরে সিরিয়ার নানা প্রান্তে সফর করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্মী মোহাম্মেদ আলা-গানেমের মনে হয়েছে, ক্ষমতায় কে আছে তা নিয়ে অধিকাংশ মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা শুধু আশ্বস্ত হতে চায়, টেবিলে পর্যাপ্ত খাবার আছে এবং খালি পেটে তাদের ঘুমাতে হবে না। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে নিঃস্ব অর্থনীতিতে গতি এবং বিশৃঙ্খল জনজীবনে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার ওপরই নির্ভর করছে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য।

লেখক: বিশ্লেষক ও অনুবাদক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত