আমরা গর্বিত জাতি। আমরা গর্বিত মাতৃভাষার জন্য। বায়ান্নর ভাষা সৈনিকরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য রক্ত দিয়েছেন। তারা আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের সম্মানজনক স্থানে। তাই মহান ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তবে তাদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যম হলো, যথাযথভাবে মাতৃভাষার চর্চা করা, দেশের সর্বত্র বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ভাষার বিকৃতি বন্ধ করা। তাহলে আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারব। আর এতেই ভাষাসৈনিক এবং ভাষাশহীদদের সম্মান ও মর্যাদা নিহিত রয়েছে। কিন্তু আমরা কি বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদা দিতে পারছি? আমরা কি বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারি? আমরা কি বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ করতে পেরেছি? অথচ বিশ্ববাসী আমাদের এক ভাষাপ্রেমী জাতি হিসেবেই জানে। দিন দিন বাংলা ভাষার বিকৃতি বাড়ছে। আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে। তাদের অনুসরণ করে একইভাবে অন্যরাও কথা বলে, যা ভাষার বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে অন্য কোনো ভাষার আকর্ষণে মাতৃভাষার আকর্ষণ কমে না যায়। অন্য ভাষা যতই সহজ হোক না কেন, মাতৃভাষা ছাড়া মনের ভাব উত্তমরূপে অন্য কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
মাতৃভাষা মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পরম করুণাময় (আল্লাহ), তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, শিখিয়েছেন মনের ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা আর-রাহমান ১-৪) এখানের শেষ আয়াতে ‘ভাব প্রকাশ’ বলতে প্রত্যেক ব্যক্তির মাতৃভাষাকে বোঝানো হয়েছে, যা বিশেষ শিক্ষাগ্রহণ ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে নিজেই বলতে পারে এবং নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।
একমাত্র মাতৃভাষাতেই মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশ করা এবং বোঝা সহজ। এ জন্য আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন সবাইকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা মানুষকে আল্লাহর বিধান সহজভাবে বোঝাতে পারেন এবং মানুষও আল্লাহর বিধানকে সঠিকভাবে সহজে বুঝতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সুরা ইব্রাহিম ৪) রাসুল (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি। এ জন্যই মহান আল্লাহ কোরআনের ভাষা হিসেবে আরবিকে মনোনীত করেছেন। যেন আরব সমাজের প্রতিটি মানুষ কোরআনের বাণী খুব সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) কোরআনকে আমি আপনার নিজের ভাষায় সহজ করে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা দোখান ৫৮)
পৃথিবীর একেক স্থানের মানুষ একেক ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। আল্লাহতায়ালা তার কুদরত প্রদর্শনের জন্যই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী এবং বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রে বিভক্ত মানুষ ও ভাষার সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তার (আল্লাহর কুদরতের) নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম ২২)
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়া সাল্লাম নিজের মাতৃভাষা আরবিকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি তিনটি কারণে আরবিকে ভালোবাসি। তার মধ্যে একটি হলো, মাতৃভাষার কারণে। মহানবী (সা.) স্বীয় মাতৃভাষা চর্চায় ছিলেন অতুলনীয়। তিনি কথা বলার সময় ভাষা খুব শুদ্ধ ও সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তিনি বলেছেন, আমাকে সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক কথা বলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। (সহিহ মুসলিম ৫২৩)
পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে। মানুষ চাইলে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য যেকোনো ভাষাতেও মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। তবে বিশেষ শিক্ষাগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা সহজ নয়। একমাত্র মাতৃভাষাতেই সর্বোত্তমভাবে সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। ছোট্ট একটি শিশু মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় যখন একটু একটু কথা বলতে শিখে তখন মা যে ভাষায় কথা বলেন, শিশু সেই ভাষাতেই কথা বলতে শিখে। এ জন্যই কোনো বাংলাভাষী মায়ের সন্তান ইংরেজি বা ভিন্ন কোনো ভাষায় কথা বলতে শিখে না। মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বন হচ্ছে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘মাতৃভাষা মাতৃস্তনের ন্যায়। প্রত্যেক জাতির তিনটি করে মা থাকে। জন্মধাত্রী মা, মাতৃভাষা, আর মাতৃভূমি।’
আমরা মাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে। আমাদের বীরেরা মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছে। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করেছে, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ও অনন্য ঘটনা। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। পাকিস্তানিরা ভাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বীর বাঙালিরা তাদের সফল হতে দেয়নি। সেই দিনের আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীসহ সব স্তরের অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন। জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। কারাবরণ করেছেন অনেকে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে এ মাসেই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতি ভাষার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের এমন এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল যেমনটি বিশ্বের আর কোথাও খোঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষার ইতিহাসে এ আন্দোলন ‘মহান ভাষা আন্দোলন’ নামে খ্যাত। বাঙালির মাতৃভাষা ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা হৃদয়ের শুভ্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে বহু প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া, গান, উপন্যাস ইত্যাদি রচনা করেছেন।
বাঙালির গৌরব গাথা এই ইতিহাসকে শুধু বাঙালিই নয়; বরং বিশ্ববাসীও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অনেকেই যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করে। দিবসটিতে বিশ্ববাসী হৃদয়ের সমস্ত শুভ্রতা উৎসারিত করে শ্রদ্ধাভরে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণ করে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করা হয় একুশে বইমেলা। এখানে লেখক-পাঠকদের মহাসম্মেলন ঘটে। বাংলা সাহিত্যে রচিত কাব্য, নিবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে দেশের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক, লেখক ও গবেষকদের নতুন নতুন বই মেলায় নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র। একুশের বইমেলায় ইসলামি বইয়ের স্টল আরও বেশি হওয়া চাই। এবার বইমেলায় ইসলামি বইয়ের যেসব স্টল রয়েছে তাতে পাঠকদের উপচেপড়া ভিড় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ দেশে ইসলামি ভাবধারার অসংখ্য লেখক-পাঠক রয়েছেন। যারা বাংলা সাহিত্যে অনেক বই পুস্তক লেখেন ও পড়েন। একুশের বইমেলায় ইসলামি ভাবধারার বই আরও বেশি বেশি নিয়ে আসা দরকার। শুধু ফেব্রুয়ারিতে নয়, বরং সারা বছর সর্বত্র মাতৃভাষার চর্চা বাড়াতে হবে।