পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ, এই বার্তাটাই দেশের ক্রিকেট বোর্ড ও সরকার দিতে চাইছে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজনের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের বহন করা বাসে সন্ত্রাসীদের হামলার পর দীর্ঘদিন ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন করতে পারেনি পাকিস্তান। ধীরে ধীরে সেই ভয়ের চাদর সরেছে, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশিরভাগ দেশই সফর করেছে পাকিস্তান। রাজনৈতিক কারণে আসেনি শুধু ভারত, অনেক জলঘোলা করে এবারও তারা খেলবে দুবাইতে। তবে বাকি ছয় দল ঠিকই চলে এসেছে। মাঠের খেলায় পাকিস্তান দলের শিরোপা জয়ের চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি বহুদলীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজনে ভরসা ফিরে পাওয়ারও মঞ্চ এবারের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি।
১৯৯৬ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছিল লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপলক্ষে স্মৃতিবিজড়িত সেই স্টেডিয়াম সংস্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের অধিনায়ক মোহাম্মদ রিজওয়ান শুরুতেই জানালেন সে কথা, ‘আমরা দেখেছি প্রস্তুতি খুব ভালোভাবেই নেওয়া হয়েছে। যেভাবে গাদ্দাফি স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে, যেভাবে জাতীয় স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে রেকর্ড কম সময়ে কাজগুলো শেষ করা হয়েছে। যেভাবে এখানে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজন করা হবে, সেটা সবারই উপভোগ করা উচিত। সবাই জানে (মাঝের) এই সময়টা কতটা কঠিন ছিল। তবে এই সময়ে আল্লাহ আমাদের অনেক অর্জনের সুযোগ দিয়েছেন। কঠিন সময়ে আমাদের দল অনেক কিছু অর্জন করেছে, কারণ আমরা জাতি হিসেবে অনেক শক্তিশালী আর অনেক কিছু করতে সক্ষম। আমরা গোটা জাতিই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি উপভোগ করব, আর আইসিসির কাছে সবচেয়ে ভালো ফল করব।’
মাঠের উদ্বোধনে আলি জাফরের গানসহ অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাঠে লোক আসে ক্রিকেট দেখতেই। সেখানেই বড় কমতি পাকিস্তানের। চিরচেনা সেই অননুমেয় বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে জিতে পরের ম্যাচেই হেরেছে নিউজিল্যান্ডের কাছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে গা গরমের ত্রিদেশীয় সিরিজে পাকিস্তান খুব একটা আশাবাদী হওয়ার মতো পারফরম্যান্স দেখায়নি। সেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই কয়েক দিনের ব্যবধানে মাঠে নামতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। তার আগে রিজওয়ান শুনিয়েছেন হার থেকে শিক্ষা নেওয়ার সেই চিরচেনা গল্প, ‘অবশ্যই (শিখছি)। আমরা সবসময় শেখার জন্য তৈরি। ফাইনালে দেখবেন আমরা আগে ব্যাটিং নিয়েছি স্রেফ এটা পরখ করে দেখতে যে আমরা কেমন করি, কারণ আগের ম্যাচেই আমরা রান তাড়া করে জিতেছিলাম। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম নিজেদের ঘাটতি কোথায়। যাই দেখতে পেয়েছি, সেটা দূর করতে কাজ করছি। আমরা কঠিন পরিশ্রম করছি, নিজেদের সেরাটা দিচ্ছি, তবে নির্দিষ্ট দিনে প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো খেলতে হবে। সেই সব দিনেই ভালো ফল পাওয়া যাবে যেদিন আল্লাহ আমাদের ভালো কাজের প্রতিদান দেবেন। আমরা আশা করব আগামীকাল (আজ) আমরা অতীতের সব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠব, আর আগের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করব না, আশা করব আল্লাহ আমাদের উত্তম ফল দেবেন।’
পাকিস্তান দলের হয়ে আজ হারিস রউফের মাঠে নামার সম্ভাবনার ব্যাপারে রিজওয়ান জানালেন, ‘গতকাল (সোমবার) সে খুব সম্ভবত ৬-৮ ওভার বল করেছে। তার আগে সে ৬০ শতাংশ সামর্থ্যে বোলিং করত, আজ সে শতভাগ দিয়ে বোলিং করছে। সে পুরো ছন্দে আছে। সে জিমে এবং মাঠে পুরো সামর্থ্য নিংড়ে দিচ্ছে। সে বলছে যে, তার কোনো সমস্যা নেই, তাই আমি ধরে নিচ্ছি যে সে ফিট।’
২০১৭ সালে হয়ে যাওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সবশেষ আসরের শিরোপাজয়ী দলটার নাম পাকিস্তান। তবে অনিয়মিত এই আসরের আট বছর পর ফের মাঠে গড়ানোর পূর্বমুহূর্তে পুরনো সেই সাফল্যের স্মৃতি হাতড়ে খুব একটা লাভ নেই। কারণ ভারতের বিপক্ষে সেই ফাইনালে খেলা ফখর জামান আর বাবর আজম ছাড়া বর্তমান দলে কেউই নেই। বরং বর্তমান অনেকটাই ঘোলাটে। পেস বোলিংয়ে আগের ধার নেই। উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে মাঝের ওভারগুলোয় ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেন স্পিনাররা, অথচ পাকিস্তান দলে মানসম্মত কোনো স্পিনারই নেই! ব্যাটিংয়েও জোয়ার ভাটার খেলা।
অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড ভারতে হয়ে যাওয়া ২০২৩ বিশ্বকাপে খেলেছে সেমিফাইনাল, বাংলাদেশে অবশেষে জিতেছে ওয়ানডে সিরিজ, আর পাকিস্তানের মাটিতে জিতল ত্রিদেশীয় সিরিজ। ক্রিকেটের দুর্গম দূর্গ হিসেবে পরিচিত ভারত সফরে টেস্ট সিরিজও জিতেছে কিউইরা। ব্যাটসম্যানদের স্পিন সামলানোর দক্ষতা, শক্তিশালী পেস বোলিং ইউনিট আর অলরাউন্ড দক্ষতার ক্রিকেটারদের উপস্থিতি, সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ড দলটা দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ। মাঠে নামার আগেই অবশ্য লকি ফার্গুসনকে হারিয়েছে কিউইরা, তার বদলে এসেছেন কাইল জেমিসন। কোচ গ্যারি স্টিড অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা হতাশ নন, ‘কাইল দলে অনেক গতি আর বাড়তি বাউন্স নিয়ে এসেছে, যা পাকিস্তানের কন্ডিশনের সঙ্গে মানানসই। সে দেখিয়েছে ছোট দৈর্ঘ্যরে খেলায় সে কতটা কার্যকর, সে সত্যিই খুব জোরে বল করে, যেটা আমাদের দরকার।’ তারকানির্ভরতার সংস্কৃতি নেই বলেই ব্যক্তির বদলে খুব একটা ভারসাম্য বদলায় না নিউজিল্যান্ড দলে।
এবারের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তাই দল এবং আয়োজক, দুই ভূমিকাতেই অনেক কিছু প্রমাণ করার আসর পাকিস্তানের জন্য। প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তান যেন হয়ে উঠেছে ‘নিরাপদ’, তাদের বিপক্ষে জয়ের সম্ভাবনাই যেন বেশি। অন্যদিকে দেশ হিসেবে অনিরাপদ। এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এর উল্টোটাই প্রমাণ করা দরকার পাকিস্তানের, ‘অনিরাপদ’ প্রতিপক্ষ আর নিরাপদ গন্তব্য।