শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ

রোগী দেখার ফি বেঁধে দেওয়ার পক্ষে ৯৬% মানুষ

  • সরকারি হেলথ কার্ড চায় ৯৩%, স্বাস্থ্য বীমা ৬৯%
  • ৯৮% চায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কমপক্ষে একজন এমবিবিএস ডাক্তার থাকুক
  • আসলে চিকিৎসক ফি মোট চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্র ১০%: বিশেষজ্ঞের মত
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

দেশের ৯৬ শতাংশ মানুষ মনে করে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে সরকারের চিকিৎসকের রোগী দেখার ফি বেঁধে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ৯৭ শতাংশ মানুষ চায় সরকার ওষুধের মূল্য, ৯৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ চায় ডায়াগনস্টিক বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য, ৯৫ শতাংশ মানুষ চায় অস্ত্রোপচার ফি এবং ৯৪ শতাংশ মানুষ চায় চিকিৎসা সরঞ্জাম-যন্ত্রপাতির মূল্য সরকার বেঁধে দিক।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জনমত জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সুনির্দিষ্টভাবে ১২ ধরনের পদক্ষেপের কথাও বলেছে মানুষ। বিবিএস গত মাসে ৬৪ জেলার শহর ও গ্রামের ৮ হাজার ২৫৬টি পরিবারের ওপর এ জরিপ করে।

জরিপে উঠে আসা চিকিৎসকদের রোগী দেখার ফি বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তার গ্রামে এখনো ১০০-২০০ টাকা ফি নেন। সহকারী অধ্যাপক ৪০০-৫০০, সহযোগী অধ্যাপক ১০০০ ও অধ্যাপকদের কেউ কেউ ১৫০০-২০০০ টাকা ফি নেন। কিন্তু রোগীর প্রেসক্রিপশন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা বিল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মোট চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্র ১০ শতাংশ চিকিৎসকদের ফি, বাকি ৯০ শতাংশ খরচ অন্যগুলোতে।’

‘কিন্তু চিকিৎসকদের ফি বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে মানুষ যে মতামত দিয়েছে, সেটারও মূল্য আছে’— জানিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘জরিপের জন্য প্রশ্ন এভাবে করা উচিত ছিল, আপনার অসুখ হলে চিকিৎসায় কী পরিমাণ খরচ হয়, সেই খরচকে আপনি অনেক বেশি মনে করেন কি না? তারপর সম্পূরক প্রশ্ন আসত সেই খরচ কোথায় কত ভাগ হয়? তাহলে চিকিৎসকদের ফি বিষয়টি সবার নিচে আসত। তার আগে আসত টেস্ট ফি, ওষুধ খরচ। সুতরাং এটাকে আমি এভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই, চিকিৎসকদের ফি বিষয়ে মানুষ যে মতামত দিয়েছে, এটা আসলে চিকিৎসায় যে উচ্চ খরচ সেটা বোঝাতে চেয়েছে। মূল সমস্যা হলো রোগীর “আউট অব পকেট” ব্যয়। সেটা কমাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের ফি বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে কখনো কখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কখনো কখনো আলোচনা হয়েছে। স্বাস্থ্য নীতিমালাতেও এ ধরনের কিছু কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগের চেষ্টা হয়নি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে রোগীর চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি। সে কারণে তারা মনে করছে চিকিৎসকদের ফি বেশি হচ্ছে।’

বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পক্ষে ৯৭% মানুষ

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ মনে করে সবার জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ৯৮ শতাংশ মানুষ মনে করে সব স্তরের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সব ধরনের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা থাকা উচিত। তারা গ্রামাঞ্চলের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কমপক্ষে একজন এমবিবিএস বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকা উচিত বলেও মত দিয়েছে।

গ্রাম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রকে কমিউনিটি ক্লিনিক ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা প্রদানে কার্যক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রথম কেন্দ্র হওয়া উচিত বলে মনে করে ৯১ শতাংশ মানুষ।

শহরাঞ্চলে ওয়ার্ড স্বাস্থ্যকেন্দ্র চায় ৯২% মানুষ

জরিপে ৯২ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো শহরাঞ্চলের ওয়ার্ড পর্যায়েও একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালুর পক্ষে মত দিয়েছে। শহর এলাকায় এসব ওয়ার্ড স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কমপক্ষে একজন এমবিবিএস বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাখা উচিত বলে মনে করে ৯৩ শতাংশ মানুষ।

অন্যদিকে, ৯৯ শতাংশ মানুষ চায় জরুরি রোগী পরিবহনের জন্য সব হাসপাতালকে যুক্ত করে সরকারিভাবে সপ্তাহের সাত দিন দিবারাত্রি ২৪ ঘণ্টা জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা উচিত।

এ ছাড়া বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা পেতে প্রথমে প্রাথমিক সেবাদানকারী এমবিবিএস বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে রেফারেল নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে মনে করে ৭১ শতাংশ মানুষ।

হেলথ কার্ডের পক্ষে ৯৩%

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবার জন্য সরকারিভাবে স্বাস্থ্য পরিচয়পত্র বা হেলথ কার্ড চালু করার পক্ষে ৯৩ শতাংশ মানুষ। আর স্বাস্থ্য বীমা চালুর পক্ষে ৬৯ শতাংশ মানুষ ও বিপক্ষে ২৬ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের ৬৮ শতাংশ ও শহরের ৭২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বীমা চায়।

জরিপে বলা হয়, স্বাস্থ্য বীমা চালু করা হলে একজন মানুষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন বা না করেন, প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি বা অর্থ প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা হচ্ছে যদি প্রয়োজন হয় এ বীমা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বা তার পরিবারের বেশিরভাগ চিকিৎসার খরচ, যেমন পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, টেস্ট করা, ওষুধ কেনা ও অস্ত্রোপচারসহ হাসপাতালের ব্যয় বহনে সাহায্য করবে।

জরিপে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্য বীমার সম্পর্কে জানে না বা এ সম্পর্কে আগে কখনো শোনেনি দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ। এ সম্পর্কে শুনেছে বা জানে ৩৮ শতাংশ মানুষ। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য বীমা সম্পর্কে জানে না ৬২ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ৫১ শতাংশ মানুষ।

১১ বিষয় অপরিহার্য বলছে মানুষ

স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে ১১টি বিষয়কে অপরিহার্য করার মত দিয়েছে মানুষ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭২ শতাংশ মানুষ চায় টিকা প্রদানসহ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সরকারের অপরিহার্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে বিবেচনা করুক।

এরপর ৬৯ শতাংশ মানুষ স্যানিটেশন ও পুষ্টিসহ স্বাস্থ্য সচেতনতাসংক্রান্ত প্রচার, ৬২ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা সেবা, ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাথমিক জরুরি চিকিৎসাসেবা, ৪৬ শতাংশ প্রাথমিক ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেবা, ৪৪ শতাংশ অপরিহার্য ওষুধ, ৩৭ শতাংশ মৌলিক নিরাময় সেবা, ২৬ শতাংশ উচ্চতর জরুরি চিকিৎসাসেবা, ২২ শতাংশ উচ্চতর ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ১৮ শতাংশ উচ্চতর নিরাময় সেবা ও ১১ শতাংশ মানুষ অপরিহার্য নয় এমন অন্যান্য ওষুধকে অপরিহার্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মত দিয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার পক্ষে ৬২% মানুষ

জরিপে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনার পক্ষে মত দিয়েছে ৬২ শতাংশ মানুষ। তারা চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারের পরিবর্তে একটি স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থায় পরিচালিত হোক। তবে এর বিপক্ষে মত এসেছে ২৮ শতাংশ মানুষের।

বর্তমানে জনস্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম, যেমন সামষ্টিক গবেষণা, পরিকল্পনা, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন, রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম, যেমন টিকা প্রদান ইত্যাদি এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের রোগীদের চিকিৎসা প্রদান কাজ ও স্বাস্থ্যশিক্ষা মেডিকেল শিক্ষা একই ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। প্রচলিত এ ব্যবস্থার পরিবর্তন চায় ৭০ শতাংশ মানুষ। তাদের মতে, এগুলোকে পৃথক করে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করা দরকার।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চায় ৬৩ শতাংশ মানুষ ও ২৫ শতাংশ মনে করে এখন যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক।

এ ছাড়া দেশের সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো (যেমন জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল, কিডনি হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, ক্যানসার হাসপাতাল, যক্ষ্মা হাসপাতাল ইত্যাদি) স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে ৬৮ শতাংশ মানুষ ও এ বিপক্ষে মত এসেছে ২৩ শতাংশের।

এখন স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসন ব্যবস্থা যেমন নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের ক্ষমতা উন্নয়ন পরিকল্পনা ইত্যাদি কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পরিচালিত হয় কিন্তু ৬২ শতাংশ মানুষ চায় এ ব্যবস্থাগুলো স্থানীয় পর্যায়ে অর্পণ করা বা বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে এবং ২৫ শতাংশ মানুষ এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলার পক্ষে।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে হাসপাতালের ক্ষমতা চায় ৭৬% মানুষ

সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর খালি পদে সাময়িকভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষমতা স্থানীয় হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের থাকা উচিত বলে মনে করে ৭৬ শতাংশ মানুষ।

বর্তমানে সরকারি চিকিৎসক ও নার্সদের বদলি করার বিধান থাকলেও সহায়ক কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বদলির বিধান নেই। কিন্তু ৭৬ শতাংশ মানুষ মনে করে সহায়ক কর্মচারীদেরও (যেমন ক্লিনার, ওয়ার্ড বয়, গার্ড ও অ্যাম্বুলেন্সচালক) চাকরি বদলিযোগ্য হওয়া উচিত। এর বিপক্ষে মত এসেছে ২০ শতাংশের।

উঠে এসেছে ১২ ধরনের পদক্ষেপের কথা

দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সুনির্দিষ্টভাবে ১২ ধরনের পদক্ষেপের কথা উঠে এসেছে জরিপে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ মানুষ হাসপাতালগুলোতে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের কথা বলেছে। ১৪ শতাংশ বলেছে আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহের কথা। সুলভমূল্যে মানসম্পন্ন ওষুধের প্রাপ্যতার পদক্ষেপ নিতে বলেছে ১৩ শতাংশ মানুষ।

এ ছাড়া ৮ শতাংশ করে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, নিরাপদ পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিশেষ সচেতনতা বাড়ানো, ৬ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পারিবারিক পরিকল্পনার ব্যবস্থা, ৫ শতাংশ টেলিমেডিসিন সেবা চালু, ৪ শতাংশ করে অপুষ্টি দূর করা, বেসরকারি খাতের সহযোগিতা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা গ্রহণের পক্ষে মত দিয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত