প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতেই এই আয়োজন। নারী দিবস ঘিরে তরুণরা জানিয়েছেন তাদের ভাবনা। তাদের লেখায় বিবৃত হয়েছে সমাজের দর্পণে নারীর আশা-আকাক্সক্ষা ও বর্তমান অবস্থা মানুষ হয়ে নারীর পাশে গতকাল পালিত হয়েছে নারী দিবস। প্রতিপাদ্য বিষয়ে ছিল ভালো ভালো কথা, হয়েছে অনেক আলোচনা, অনেক সংলাপ, আরও কত কী! কিন্তু পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলছে ভিন্ন কথা। ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে উপায় নেই সেসব দেখলে।
আমাদের এই যে যাপিত জীবন, প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়ানো, পথচলা তার উদ্দেশ্য একটাই; একটু ভালো থাকা, নিজেকে ভালো রাখা। চারপাশের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা। যখন আমরা একটা খারাপ খবর শুনি সবারই একটু হলেও মন খারাপ হয়ে যায়। এমন কিছু কি আমরা করতে পারি যেটুকু আমাদের ভালো রাখে আমরা সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি?
হ্যাঁ, ভালো কিছু তো করতেই পারি! সেটা কি খুব কঠিন কিছু? নাহ, সহজ, যা অন্যের পথচলাকে আরও সহজ করে দিতে পারে। কিন্তু এই ছোট ও সহজ কাজ, একটু ভালোবাসার অনুভূতি, ভরসার হাত আর নির্ভরতার চোখ বদলে দিতে পারে নারীর পৃথিবীকে। আমাদের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা সবার জীবনটাকে সুন্দর, সহজ ও নিরাপদ করতে পারে কেবল নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটু পরিবর্তন আনলে। কী করতে হবে? নারী হিসেবে তার প্রতিটি পদক্ষেপ বিচারকের ভূমিকায় না দেখে দেখতে হবে একটু সহানুভূতিশীল মন নিয়ে। যে মানুষটা দিন-রাত পরিশ্রম করে এত সুন্দর করে সংসারটা গুছিয়ে রেখেছে তার কাজে একটু যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যতেœর হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তার দিকেও। যে মেয়েটা তার মেধা দিয়ে আকাশ ছুতে চায় তারপাশে দাঁড়াতে হবে সমর্থন নিয়ে। আমাদের বোনদের নিরাপত্তা দিতে আমরা কি পারি না পাশে দাঁড়াতে?
কাজগুলো কি খুব কঠিন? না, একদমই না। তাহলে আমরা পারছি না কেন? কেন এত ফুলের মতো নিষ্পাপ প্রাণ ভুলে যাচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। মানবিকতা ভুলে তখন সমাজের সবাই হয়ে যাচ্ছি বিচারক। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে নারী। এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
আছে। প্রতিকার বা প্রতিরোধ সবকিছুতেই মিশে আছে একটা শব্দ; তা হলো সচেতনতা। আমরা কি মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বা কর্তব্য নিয়ে সচেতন? আমার নিজের ঘরে আমার মেয়ে, মা, বোন, স্ত্রী কি নিরাপদ? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন আমার ছেলে, ভাই, আমার চাচা, মামা, খালু, দুলাভাই; তারা কি অন্য কারও হুমকির কারণ? এটুকু সচেতনতা কি আমার পরিবারে আমি নিশ্চিত করতে পারছি?
নাকি সব সময় ভেবেছি এসব শুধু ঘটে পত্রিকার পাতায় আর টেলিভিশনে। খরগোশের মতো চোখ বন্ধ না করে থেকে আমরা কি একটু নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারি? আর সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্যি হলো, বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে কমবেশি এসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে যায়, তার বেশিরভাগই পরিচিতদের দ্বারা নিজের পরিবারেই ঘটে। ফুলের মতো প্রাণগুলো অকালে ঝরে যাচ্ছে, কারণ আমরা সচেতন হতে পারছি না সবাই মিলে। পত্রিকার পাতায় একটা মুখ কিছুক্ষণ ভাবিয়ে তুলছে, পরক্ষণেই ভুলে যাচ্ছি। একটু ভালোবাসা, একটু ভরসার হাত বাড়িয়ে, একটু নির্ভরতার জায়গা তৈরি করে, আমি-আপনিই বদলে দিতে পারি গোটা পৃথিবীকে। আর সেই সঙ্গে কিছু কাপুরুষকে শক্তভাবে দমন করে বাংলাদেশকে করতে পারি নিরাপদ। কিন্তু করছি না কেন? সেই নিরাপদ বাংলাদেশ কতদূরে? প্রশ্নটা সবার কাছে, উত্তরটা শুধু নিজের কাছে।
রুবাইয়া তানজিম
প্রাক্তনী, বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
নারী ও বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা
আমাদের সমাজব্যবস্থায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়নের পথে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। নারীর জন্য আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য এখনো এক বড় সমস্যা। নারীদের প্রতি অবমাননা, নির্যাতন এবং নিপীড়ন বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিতে জোরালো গুরুত্ব দেওয়া হলেও বাস্তবে এই অধিকার বাস্তবায়িত হয় না। নারীরা শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এবং কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার পায় না। যদিও সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং আইনের প্রবর্তন হয়েছে, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবার ও সমাজের মধ্যেও নারীদের চাওয়া এবং ইচ্ছার মূল্য কম দেওয়া হয়। এই বৈষম্য দূর করতে নারীর প্রতি সামাজিক মনোভাব এবং সমাজের নানা পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলোর পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি স্তর তথা পরিবার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আলেম সমাজ এবং সরকারের এগিয়ে আসা। নারী ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতায়িত নারী শুধু নিজের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটায় না, বরং পুরো সমাজ এবং দেশের উন্নতির জন্য অবদান রাখে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানোর জন্য শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
দেশের নারীদের উন্নয়নের জন্য সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। নারীদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আরও উন্নতি করা জরুরি।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীদের অবস্থা ও অধিকার নিয়ে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য এবং অসম্মান এখনো সমাজের পদে পদে রয়ে গেছে।
নারীর অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পুরো সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। নারীরা যদি প্রাপ্য মর্যাদা, সমান অধিকার ও সুযোগ পায় তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশ।
অহিদুল ইসলাম অন্তর
সাংবাদিক
আমাদের চাওয়া খুব সামান্য
স্কুলের শিক্ষিকাদের জন্য স্টাফরুমে যেদিন ডিভান আনা হলো, অনেকেই এ নিয়ে হাসাহাসি করেছে, বিরক্ত হয়েছে। চাকরি করতে এসেছে এখানে, সোফায় শুয়ে বসে আরাম করবে?
হ্যাঁ করবে। ঘরে হোক বা কর্মক্ষেত্রে নারীদের এটুকু খেয়াল যতœ করা উচিত। এবং এই খেয়াল আমাদের চারপাশের পুরুষেরাই রাখেন। দাঁড়িয়ে থেকে একের পর এক ক্লাস নেওয়ার পর যখন স্টাফ রুমে ফিরে মা হতে যাওয়া আমাদের কোনো সহকর্মী ক্লান্তিতে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকেন, আবার কেউ তীব্র পেট ব্যথায় কাতরে ক্লাস শেষ করেন, কিন্তু কোথাও পান না একটু মাথা রেখে আরাম করার ফুরসৎ। কাজের জায়গা হলেও দিনের বেশিরভাগ সময় আমাদের যেখানে থাকতে হয় সেই কাজের জায়গাটুকুও একটু স্বস্তির, আরামদায়ক হওয়া প্রয়োজন। এই প্রয়োজনটুকুই বুঝে সেদিন আনা হয়েছিল স্টাফরুমে ডিভান। হ্যাঁ, এটুকুই। আমরা নারীরা আমাদের চারপাশের পুরুষদের থেকে এ রকম একটু-আধটু যতœই আশা করি।
ঘরে ফিরলে আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলে যখন কাপ হাতে চা এগিয়ে দেয়, ওর বাবা যখন চট করে বানিয়ে ফেলে সন্ধ্যার নাশতা, তখন কিন্তু নিজেকে খুব সুখী মনে হয়। রাজ্যের ক্লান্তি মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। এই যে আমাদের রান্নাঘরটা, এটা যে শুধু নারীরই নয় এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। নারীর কাজকে সহজ করতে বা তাকে একটু আরাম করতে দিতে ঘরের পুরুষ সদস্যটিরও মাঝেমধ্যে হাতা খুন্তি হাতে নিলে কিন্তু ক্ষতি নেই। বাচ্চার মায়েদের বাচ্চা সামলে, ঘরে-বাইরে সমানতালে করতে হয় কাজ। কর্মজীবী মা হলে তো কথাই নেই। স্বামী, সন্তান, সংসার নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়-সুযোগই হয় না। তবে এই ভাবনাটুকু যদি পাশে থাকা পুরুষ সদস্যটি ভাবেন, তবেই কিন্তু মেলে শান্তি, স্বস্তি। নারী কিন্তু ঠিক এতটুকুই চায়। ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। বছর ঘুরে ঘুরে ৮ মার্চ আসে আর এমন সেøাগান দেখি। কিন্তু আদৌ কি অধিকার, সমতা মিলে? বরং চারদিকে নারী, শিশু ধর্ষণের মতো ভয়ানক সব খবরে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকি। কন্যার উন্নয়নের বদলে কন্যাকে নিয়ে হয় ভীষণ দুশ্চিন্তা। পুরুষ শব্দটাই যেন কেমন ভয়ের হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ভয় নয়, আমরা নারীরা বা আমার কন্যারা একটু নিরাপদ সুস্থ সুন্দর জীবন চায়। চায় সহযোগিতা, সম্মান, ভালোবাসা।
সাদিয়া জামান
সহকারী শিক্ষক, আফরোজ খান মডেল স্কুল, ময়মনসিংহ