বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সংকটে জর্জরিত চরনজিরের বাসিন্দারা

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৬ এএম

দক্ষিণ-পূর্বদিকে তেঁতুলিয়া ও উত্তর-পশ্চিমে বুড়াগৌরাঙ্গ নদী। এর মাঝখানে অবস্থিত ‘চরনজির’। এই চরের যাতায়াত ব্যবস্থা শুধুই নৌপথ নির্ভর। পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নে এ চরের অবস্থান। দুর্গম এই চরে জনবসতি আছে, কিন্তু তাদের জন্য নেই কোনো নাগরিক সুবিধা। লেখাপড়া করার জন্য নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য নেই সাইক্লোন শেল্টার। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়নি কোনো বেড়িবাঁধ। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নেই একটিও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বিশুদ্ধ পানির জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত গভীর নলকূপের অভাব। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থাও এখানে গড়ে ওঠেনি। এই নেই আর নেইয়ের মধ্যেই জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছে নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ‘চরনজির’-এর মানুষ।

চরনজির বুড়াগৌরাঙ্গ ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় ভেসে ওঠা একটি দ্বীপের নাম। চল্লিশের দশকে ভেসে ওঠা এই দ্বীপটি ষাটের দশকে সরকারি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এরপর পাশের এলাকার লোকজন এসে চাষাবাদ শুরু করেন। আর এই চাষাবাদকে কেন্দ্র করেই আশির দশকে জনবসতি গড়ে ওঠে এখানে। সময়ের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এখনো কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে পড়েছে শতাধিক শিক্ষার্থীরা। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা আটকে আছে আদর্শলিপি বইয়ের মধ্যে। জলোচ্ছ্বাস কিংবা ঘূর্ণিঝড় হলে আতঙ্কে থাকেন এই চরের বাসিন্দারা। বর্তমানে চরটিতে এক হাজারের মতো মানুষের বসবাস। তবে এই চরে জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ২০২২ সাল থেকে চরনজিরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ ও জাগোনারী’র প্রদৃপ্ত প্রকল্প।

চরের বাসিন্দা আব্দুর রব হাওলাদার বলেন, ‘আমার পাঁচ ছেলেমেয়ে। কিন্তু আমি আমার এক সন্তানকেও লেখাপড়া করাতে পারিনি। আমি এই চরে বসবাস করি ৩০ বছর ধরে। আমাগো এই চরে কোনো সুযোগ-সুবিধা আমরা পাই না। এই চরে একটা স্কুল নেই, রাস্তা নেই, একটা টিকার কেন্দ্র পর্যন্ত নেই। এক কথায় এই চরে কিছুই নেই। আমরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত। আমাদের দিকে সরকার যেন একটু তাকায় এটাই আমাদের দাবি।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের পাশের পুকুরে এক নারী থালা-বাসন ধোঁয়ার কাজ করছেন, তার পাশেই তাদের ব্যবহৃত খোলা টয়লেট। তা জেনেও গৃহস্থালি কাজে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হয় এ পরিবারকে। কারণ নদীঘেরা এই চরের চারপাশে পানি থই থই করলেও তা লবণাক্ত। বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব। হাতেগোনা ছয়-সাতটি গভীর নলকূপ আছে। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে তা পর্যাপ্ত নয়।

চরের কোমলমতি শিশুরা জানায়, চরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় তারা কোনো লেখাপড়া করতে পারছে না। স্কুল না থাকার কারণে তাদের যে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। তাদের দাবি, এই চরে যেন স্কুল করে দেওয়া হয়।

মাঠপর্যায়ে কাজ করা প্রদৃপ্ত প্রকল্পের ফিল্ড ফেসিলেটেটর জুয়েল মাহমুদ বলেন, ‘চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রদৃপ্ত প্রকল্প কাজ করছে। ইতিমধ্যে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তাঘাট, পুকুর খনন ও সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছে। চরের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ জীবনমান উন্নয়নে আরও কাজের প্রয়োজন।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসান বলেন, ‘ইতিমধ্যে চরনজিরবাসীর প্রাথমিক শিক্ষা, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির সংকটের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজ শুরু করেছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপ এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের জন্য প্রয়োজনীয় টয়লেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চরটির শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্কুল নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত