বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
এদিন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে সঙ্গে নিয়ে ইফতার করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ইফতারের আগে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে পাঁচ মিনিটের বেশি তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তিনি বলেন, ‘অনরার দুঃখ-কষ্ট বুঝিলইবার লাই ও আইসসে। ও বুঝি লই দুনিয়ার মাইনসরে জানাইব অনরারে অনরার দেশত ফেরত পাঠাইবার লাই কি গরার দরকার ইন গরিব (আপনাদের দুঃখ-কষ্ট বোঝার জন্য মহাসচিব এসেছেন। তিনি বুঝে বিশ্ববাসীকে জানাবেন এবং আপনাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কাজ করবেন)।’
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যাবদ জানিয়ে বলেন, ‘কেউ ওনাকে দাওয়াত দিয়ে আনতে পারেন না। উনি নিজ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা দেখতে এসেছেন। আশা করছি, রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সমাধান হবে।’
সবসময় রোহিঙ্গাদের পাশে রয়েছেন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আপনাদের নিরাপদে স্বদেশ ফেরত পাঠানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
এর আগে রোহিঙ্গাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বদেশে ফেরত নিশ্চিতে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় সব করবে বলে জানান জাতিসংঘের মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। এটার জন্য কাজ করছে সংস্থাটি। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে হলে মিয়ানমারের রাখাইনেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন রয়েছে।’
দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের একটি চার্টার্ড ফ্লাইট কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব কক্সবাজার বিমানবন্দরে নেমে বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের উদ্দেশে রওনা দেন। দুপুর ২টা ১০ মিনিটের দিকে রোাহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছান তিনি।
জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা লার্নিং সেন্টার, রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
কক্সবাজার শুধু পর্যটন নয়, অর্থনীতিরও কেন্দ্র : কক্সবাজার শুধু পর্যটন শহরই নয়, বরং অর্থনীতিরও কেন্দ্র বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট ভাগ্যবান। কারণ তাদের একটি সমুদ্র আছে, যা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে উদ্বুদ্ধ করে।’ গতকাল দুপুরে কক্সবাজারে বিআইএএম অডিটরিয়ামে স্থানীয় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি লবণ উৎপাদনকারীদের কাছে জানতে চান, বিদেশি আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে আগ্রহী কি না। কেননা কক্সবাজারের কৃষকদের উৎপাদিত লবণ এখন রপ্তানি করার সক্ষমতা রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা পাইলট প্রকল্প ভিত্তিতে কক্সবাজারে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বায়ুশক্তির (বায়ুপ্রবাহের শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন) সম্ভাবনা সম্পর্কে খোঁজ নেন।
স্থানীয় জনগণকে ভবিষ্যতে সুযোগগুলো কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, কক্সবাজার অর্থনীতির একটি বৃহৎ শক্তি এবং এটি তথ্যপ্রযুক্তিরও একটি শহর হতে পারে। তিনি স্থানীয় জনগণের কাছে তাদের ওপর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চান।
মতবিনিময় সভায় কক্সবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধান উপদেষ্টার সামনে বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি পেশ করেন।
বিমানবন্দর ও পুনর্বাসন প্রকল্প পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টা : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কক্সবাজারের খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন। গতকাল বিকেলে তিনি জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত এ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেন এবং চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন।
পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিরাজুল ইসলাম প্রধান উপদেষ্টাকে প্রকল্পের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, ১২৯টি ভবনে ৪ হাজার ২১৮ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা কক্সবাজারের পর্যটন ও উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। সভায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘আঁরা হতা হৈবল্যা নু আইয়্যি, অনরাত্তু জাইনতো আইস্যিদে (আমরা কথা বলার জন্য আসিনি, আপনাদের কাছ থেকে জানতে এসেছি)।’
এর আগে দুপুরে কক্সবাজার বিমানবন্দরের চলমান নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা। পরিদর্শনকালে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষের (বেবিচক) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিনুল হাসিব প্রধান উপদেষ্টাকে বিমানবন্দরের নির্মাণকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন। বেবিচক থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের শিল্পকর্ম দেখলেন জাতিসংঘ মহাসচিব : উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গাদের তৈরি নানা হস্তশিল্প ও দৈনন্দিন ব্যবহারের পণ্য পরিদর্শন করেছেন। বিকেলে তিনি মাল্টিপারপাস সেন্টারে যান, যেখানে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের তৈরি করা পোশাক, ব্যাগ, বাঁশ ও পাটের পণ্য, কাঠের শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য হস্তশিল্প দেখেন। জাতিসংঘ মহাসচিব এসব পণ্য দেখে প্রশংসা করেন এবং রোহিঙ্গাদের স্বনির্ভর হওয়ার প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করেন বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা নুরুল আমিন।
গণহত্যার বর্ণনা দিলেন রোহিঙ্গারা : উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং মিয়ানমারে তাদের ওপর চালানো গণহত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা শোনেন। বর্ধিত ক্যাম্প ২০, এইচ/২, ব্লক-৩-এর বাসিন্দা বদর আলম বলেন, ‘আমাদের মাঝিরা (রোহিঙ্গা নেতা) জাতিসংঘ মহাসচিবকে মিয়ানমারের অত্যাচারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। কীভাবে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, চোখের সামনে স্বজনদের হত্যা করা হয়েছে, গণহত্যা চালানো হয়েছে সবকিছু তুলে ধরা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দেওয়া শর্তগুলো মেনে নিলে আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি। এ বিষয়টি জাতিসংঘ মহাসচিব ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গাকমিউনিটি নেতারা।’
এ সফরকে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের নতুন বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে ইফতার : উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের সঙ্গে ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ৩৩টি ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লক থেকে ৭০ জন করে রোহিঙ্গা।
পদপিষ্ট হয়ে এক রোহিঙ্গার মৃত্যু : প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও দুজন। দুপুর আড়াইটার দিকে ২০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেলিপ্যাড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি মুহাম্মদ আরিফ হোছাইন। নিহত নেয়ামত উল্লাহ (৫০) ৪ নম্বর ক্যাম্পের মৃত সবি মিয়ার ছেলে। আহত হয়েছেন একই ক্যাম্পের আসাদ উল্লাহর ছেলে আসমত উল্লাহ (১৬) ও বসির আহমেদের ছেলে কলিম উল্লাহ (৬২)। ওসি আরিফ হোছাইন বলেন, ‘ইফতার পার্টিতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় হুড়োহুড়ি করে পাহাড়ের ঢাল থেকে নামতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে তিনজন আহত হন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক নেয়ামত উল্লাহকে মৃত ঘোষণা করেন।’