শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

যন্ত্র কেনায় ‘অযান্ত্রিক’ দুর্নীতি

আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪০ এএম

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। করোনার সময় যন্ত্রটি চালু না হলেও কিনতে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। যেসব বিদ্যালয়ে যন্ত্রটি বসানো হয়েছিল তার সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতি হলেও জবাবদিহি কাউকে করতে হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলতে পারবে আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, বিষয়টি অনেক আগের, কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কিনতে দফায় দফায় সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসূত্র থেকে প্রাপ্ত বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয় ও স্থাপন সম্পর্কিত নির্দেশনার কপিসমূহ দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. এনামুল কাদের খানের সইয়ে ২৮ এপ্রিল, ২০১৯-এ পিডিপি-৪-এর অধীন সিøপ ফান্ড থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন বসাতে বলা হয়। ২৬ জুন, ২০১৯ উপ-সচিব আছমা সুলতানার সইয়ে এক চিঠিতে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনার জন্য টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন চূড়ান্ত করা হয়। ওই বছরের ১ জুলাই টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনটিকে চূড়ান্তকরণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।

তিন মাস পর ২৬ জুনের নির্দেশনা বাতিল করে ১৩ অক্টোবর ২০১৯ আছমা সুলতানার সইয়ে নতুন স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হাজিরা মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২৩ অক্টোবর, ২০১৯ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. রুহুল আমিনের সই করা চিঠিতে নির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সাশ্রয়ী মূল্যে নিজেদের পছন্দমতো মেশিন কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের আইনানুগ শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

সূত্র মতে, ৬৫ হাজার ৬২০টির মধ্যে সর্বশেষ ৩২ হাজার ৫২৫টি মেশিন বসানো হয়। শেষ ধাপে ৬৩ কোটি ৩৩ লাখ ৫২ হাজার ৩৬৬ টাকা খরচ দেখানো হয়, বাকি টাকা বিদ্যালয় থেকে ফেরত নেওয়া হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরার বিষয়ে জানা নেই, তবে প্রাথমিকে রাউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট রয়েছে।’

জেলা-উপজেলা ভেদে দামের তফাৎ আকাশ-পাতাল। গোপালগঞ্জ, খুলনা, ঝালকাঠি, বগুড়া, কুমিল্লা, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় কিছু বিদ্যালয় ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে যন্ত্রটি কিনেছে। অথচ একই জেলা, উপজেলায় অধিকাংশ বিদ্যালয় যন্ত্রটি বসাতে খরচ করেছে ২০-৩৪ হাজার টাকা। কক্সবাজার জেলার কয়েকটি উপজেলার অনেক শিক্ষক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যন্ত্রটি কেনায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন। তারা বলেন, ‘শিক্ষা কর্মকর্তাকে আমরা টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি, কোম্পানি ডিভাইস স্কুলে পৌঁছে দিয়েছে। ২০-৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে অর্ধেকে করতে পেরেছেন।

শিক্ষক নেতা মু. মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার প্রকল্পে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা গচ্চা গেছে, কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হয়েছে। এ অর্থ দিয়ে যদি শিক্ষকদের টিফিন ভাতা বাড়ানো হতো তাহলে শিক্ষকরা উপকৃত হতেন। এর তদন্ত হওয়া উচিত।’

১৪ নভেম্বর, ২০১৯ আছমা সুলতানার জারিকৃত স্পেসিফিকেশন ও স্পষ্টীকরণের আলোকে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন বসানো হচ্ছে কি না তা মনিটর করার জন্য বিভাগীয় উপপরিচালককে আহ্বায়ক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে সদস্য ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে সদস্য সচিব করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ সিøপ ফান্ডের অর্থ দিয়ে বিদ্যালয়ের বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র কেনা যাবে না বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক মো. বদিয়ার রহমান নির্দেশ দেন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার ও স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হওয়ার পরই অনেক উপজেলায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। বিধিমোতাবেক স্কুল কমিটিকে দেখেশুনে বাজার যাচাই করে হাজিরা মেশিন কেনার কথা বলা হলেও কোথাও কোথাও যন্ত্রটি কেনার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেছেন সরকার দলীয় কিছু নেতা, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার; কোথাও কোথাও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার। কতক জেলায় জেলা প্রশাসনের ব্যক্তিরাও নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

গোপালগঞ্জ জেলায় ৭ শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কাশিয়ানী উপজেলায় সিøপ ফান্ডের ৩৭ লাখের অধিক টাকা দিয়ে ১৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন বসানো হয়। প্রতিটি মেশিনের দাম ধরা হয় ২২ হাজার টাকা। অভিযোগ রয়েছে, জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের নির্ধারিত কোম্পানি থেকে জেলার সব প্রধান শিক্ষক যন্ত্রটি কিনতে বাধ্য হয়েছেন। যন্ত্রটি চালু না হলেও অনলাইন চার্জ, এসএসএস চার্জ, সার্ভিস চার্জসহ বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে পুরো অর্থই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। 

রাজবাড়ী জেলার ৪৮১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বালিয়াকান্দি, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী সদর ও পাংশা (কিছু বিদ্যালয়) উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপন করা হয়। ৩৭৬টি বিদ্যালয়ে মেশিন ক্রয় সম্পন্ন হয় ২০১৯ সালে। প্রায় কোটি টাকা খরচ হয়েছে। একটি বিলে দেখা গেছে, ওয়েবসাইট, ডোমেইন, হোস্টিং অ্যান্ড অনলাইন, অটোমেশন সফটওয়্যার বাবদ সাত হাজার টাকা, এক বছরের ইন্টারনেট বিল এক হাজার ৮০০ টাকা, এসএমএস বাবদ ৮০০ টাকা, এক বছরের অনলাইন সার্ভিস চার্জ এক হাজার টাকা, ইউজার চার্জ ৬০০ টাকা ধরা হয়েছে। মেশিন চালু না হলেও বিলে যন্ত্রটি বসাতে দুই হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

ঝালকাঠি জেলার একাধিক প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘স্যারদের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা শতাধিক স্কুল ২৯ হাজার ৫শ টাকা করে দিয়েছি। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এসে সেট করে দিয়েছে। পরে জানতে পারি অনেকেই একই স্পেসিফিকেশন ব্যক্তিগতভাবে অনেক কম টাকায় করেছেন। কেউ আবার প্রায় ৩৩ হাজার ৫শ টাকা খরচ করেছেন।’

বগুড়ার কাহালু উপজেলার কয়েকজন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ‘আমাদের উপজেলাতে ১১-১৫ হাজার টাকার মধ্যে মেশিন সেটআপ করা হয়। এখন অধিকাংশ নষ্ট। পটুয়াখালীর অধিকাংশ বিদ্যালয় দুর্গম এলাকায়, বিদ্যুৎ নেই। রাঙ্গাবালী উপজেলায় ৭১টি বিদ্যালয়, বিদ্যুৎ না থাকায় সেখানে মেশিন বসানো হয়নি।’ 

ঝালকাঠি সদরের একজন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার বলেন, ‘এখানে একাধিক সিন্ডিকেট কাজ করেছে, কয়েকগুণ বেশি দামে দেড় শতাধিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক মেশিন বসানো হয়েছে, বিদ্যালয়প্রতি প্রায় ২৯ হাজার ৫শ টাকা খরচ হয়েছে। তবে চালুর আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।’

উপজেলা শিক্ষা অফিসার জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এ উপজেলায় ১৬০টির বেশি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন বসানো হয়েছিল। এখন কয়েকটি সচল থাকতে পারে। অধিকাংশই নষ্ট। ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলার ৯০৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসানো হয় বায়োমেট্রিক ডিভাইস, যাতে খরচ হয় ২ কোটি ২৬ লক্ষাধিক টাকা। প্রতিটি মেশিনের দাম ২৫ হাজার টাকা ধরা হয়। এ জেলায় কিছু শিক্ষা কর্মকর্তার সিন্ডিকেট থাকায় দ্বিগুণ দাম ধরা হয়েছে যন্ত্রটির। জয়পুরহাটের ৩৬৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসানো হয় মেশিন। ব্যয় হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৮ টাকা।’

পটুয়াখালীর বাউফল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মেশিন বসানো হলেও কার্যক্রম নেই। কিছু বিদ্যালয়ের বিল, ভাউচারে দেখা গেছে, ডিভাইস, ডোমেইন, হোস্টিং, সিম ও বিভিন্ন ইস্যুতে ২০-৩৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ইন্টারনেটের বাৎসরিক চার্জও নেওয়া হয়েছে বিদ্যালয় থেকে অথচ ইন্টারনেট সংযোগই দেওয়া হয়নি। যন্ত্র স্থাপনে মজুরি ধরা হয়েছে ২ হাজার টাকা করে।’

ঝালকাঠি জেলা সদরের প্রধান শিক্ষক ওবায়দুল বলেন, ‘বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন বসানো হয়েছিল, তবে চালু হয়নি।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষায় ডিজিটালকরণের নামে সরকার যেভাবে কেনাকাটার মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে তার জবাবদিহি দরকার। কারণ এ টাকা জনগণের টাকা। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্তের মাধ্যমে এ প্রকল্পের অনুমোদন, অর্থছাড় ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত