পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন। আয়তনের দিক দিয়ে রাশিয়ার পর এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর কিয়েভ। এ দেশে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান বসবাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় দেড় শতাংশ। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের মুসলমানরা রমজান মাস গভীর নিষ্ঠা ও একতার সঙ্গে পালন করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রমজান পালনে এসেছে ভিন্নতা। এ যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীতে প্রায় ২০ হাজার মুসলিম কর্মরত আছেন। তাদের অধিকাংশই রয়েছেন যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর মুসলিম সেনা সদস্যদের মধ্যে আলোচানার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন সাঈদ ইসমাগিলভ, যিনি একজন মুফতি ও ইমাম। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি আশা ও ভয়ের সংমিশ্রণে রমজান পালন করছেন।
নাগরিক জীবনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খাওয়া, না পান করা, ধূমপান ও গালিগালাজ থেকে বিরত থাকা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সামরিক যোদ্ধাদের জন্য এটি আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। যুদ্ধক্ষেত্রে দিনের বেলা পানি ছাড়া কাটানো মানে দুর্বল হয়ে পড়া। আর খোলা জায়গায় নামাজ পড়া মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া।
সাঈদ ইসমাগিলভ ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একজন মুসলিম কর্মকর্তা। ১৫ বছর বয়স থেকে কোরআন পড়াই তার আত্মা ও মনের জন্য একমাত্র শান্তির উৎস। তিনি দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি তাতার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইউক্রেনের মুসলিমদের ধর্মীয় সংস্থা ‘উম্মাহ’-এর মুফতি ছিলেন তিনি এবং ইমাম হিসেবে ২০ বছর একটি মসজিদে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তিনি প্রথমে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং পরে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি ১৩ বছর মুফতির দায়িত্ব পালন করেছি। তাই অবশ্যই আমি প্রতি বছর রোজা রাখি। এটি যুদ্ধাবস্থায় আমাদের চতুর্থ রমজান এবং আমরা রোজা রাখছি। আমরা মসজিদে ইফতার করি, নামাজ পড়ি, তারপর তারাবি পড়ি। মুসলিমরা এখানে একত্র হন। যখন আমি ফ্রন্টলাইনে থাকি, তখন দিনের বেলা নামাজ পড়া কঠিন হয়ে যায়। কারণ তখন যুদ্ধসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে অন্য সময়ে পড়ে নিই।’
যুদ্ধের আগের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘রমজান মাস ইমামদের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। তারাবির নামাজের আগে আমার মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ থাকত। আমি মসজিদে আসার আগেই হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে তারাবির জন্য অপেক্ষা করত।’
২০২২ সালে যখন তিনি প্যারামেডিক হিসেবে কাজ করছিলেন তখন তারাবি পড়ার জন্য তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন মুসলিম চিকিৎসাকর্মী। ২০২৩ সালে দোনেৎস্কের যুদ্ধে যখন তিনি ছিলেন তখন তার নামাজের জামাতে যোগ দিতেন স্বেচ্ছাসেবী ব্যাটালিয়নের যোদ্ধারা। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা একসঙ্গে নামাজ আদায় করতাম, রাতে তারাবি পড়তাম এবং দিনে দেশের
জন্য যুদ্ধ করতাম তখন এক অভূতপূর্ব অনুভূতি হতো। আমি ইমাম হিসেবে তারাবি পড়াতাম, আর তাতে পাঁচ থেকে পনেরো জন মুসলমান অংশ নিত।’
এ বছর একা একাই তার তারাবি আদায় করতে হচ্ছে। প্রতি রাতে তারাবির নামাজে কোরআনের এক পাড়া তেলাওয়াত করেন, যাতে পুরো মাসে কোরআন খতম করতে পারেন। তার সঙ্গে কেউ নামাজ আদায় করে না, তবে কাছের যোদ্ধারা তার কোরআন তেলাওয়াত শোনেন। তিনি বলেন, ‘আমার সহযোদ্ধারা এটি পছন্দ করেন। তারা বলেন, এটি খুব প্রশান্তিদায়ক।’
গত বছর রমজানে ইউক্রেনের মুসলিম সেনাদের জন্য প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক ইফতার আয়োজন করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রাজধানী কিয়েভে ক্রিমিয়ার তাতার কালচারাল সেন্টারে ইফতারের আয়োজন করা হয়। এ বছরও জেলেনস্কি মুসলিম সেনা সদস্যদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেন। (সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত)
প্রাভডা ডটকম থেকে ভাষান্তর আতিকুর রহমান