বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধ জনমুক্তি

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৫, ০২:৩৪ এএম

স্বাধিকার-স্বাধীনতার অভিমুখে অগ্রযাত্রায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের যুগান্তকারী অর্জন। ঊনসত্তরের পটভূমি তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে, চূড়ান্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে। তখন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বাধীনতার সোপান বলা যায়, ঊনসত্তরই নির্ধারণ করে দিয়েছিল একাত্তরের স্বাধীনতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিগত শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে আইয়ুব, মোনায়েম গং কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলার অভিযুক্ত বেশিরভাগই ছিলেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য, বেসামরিক আমলা। জাতিগত বৈষম্যের শিকার বিক্ষুব্ধ বাঙালি সামরিক সদস্যরা সংগঠিত হয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নেন। কিন্তু অভ্যুত্থান ঘটানোর আগেই তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে সামরিক গোয়েন্দারা দ্রুত অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে তাদের আটক করে। দায়েরকৃত মামলায় শেখ মুজিবকে প্রধান অভিযুক্ত করার ফলে মামলা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। অথচ ব্যর্থ হওয়া সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন মামলার দ্বিতীয় অভিযুক্ত নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। তার নেতৃত্বেই সামরিক সদস্যরা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে তাই প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল গণহত্যার প্রথম প্রহরে। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর ভোরে এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে তাকে আটক করে হত্যা করা হয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচার চলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সামরিক আদালতে। অভিযুক্তদের বিচারিক কার্যক্রমের সময় সাংবাদিক আতাউস সামাদের মাধ্যমে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীকে মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন। ওই চিঠি প্রাপ্তির পরই মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের মুক্তি এবং ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেন। ধর্মঘট, হরতাল, হাট-হরতাল, সমাবেশ সংঘটনে বিক্ষুব্ধ দেশবাসী সাড়া দেওয়ার ফলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন এক সময় গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। অচল হয়ে পড়ে পাকিস্তানিদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব। অভ্যুত্থানের তীব্রতর পরিস্থিতি সামাল দিতে আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে মামলা প্রত্যাহার এবং সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিয়েও ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। আইয়ুবের বিদায় এবং তার জায়গায় সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার আগমন ঘটে। নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে পরিসমাপ্তি ঘটে একটি সম্ভাবনায় অভ্যুত্থানের পরিণতি। আমাদের জাতীয়তাবাদীরা নির্বাচনের মুলোয় অতীব সম্ভাবনাময় গণঅভ্যুত্থানকে এগিয়ে না নিয়ে, থেমে যায়। অথচ অনেক জীবনের অপচয় রোধে অভ্যুত্থানেই আমাদের ভূখণ্ডের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব করা অসংগত মনে করার কারণ নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণকেই তারা বেছে নিয়েছিল, মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ববঙ্গের দাবি থেকে সরে গিয়ে।

প্রস্তুতিহীন অরক্ষিত জাতির ওপর নৃশংস গণহত্যা সংঘটনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে স্থানীয় ছাত্র-যুবক এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বিনা বাধায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে দেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। প্রবাসী সরকার গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চলমান থাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পদে পদে আক্রান্ত হতে হয়েছে। জনযুদ্ধে তটস্থ পাকিস্তানিরা বেশুমার হত্যাকাণ্ড ও নারী নিগ্রহে মেতে উঠেছিল। ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধাদের বীরত্বে দিশেহারা হয়ে ওঠে হানাদার বাহিনী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ একে একে হারায় পাকিস্তানি বাহিনী। এছাড়া শিবপুরসহ অনেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আগাগোড়া ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বারংবার আক্রমণ চালিয়েও ওই সব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। যশোর হানাদারমুক্ত হওয়ার পরই ৩ ডিসেম্বের ভারতে বিমান হামলা চালিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা করে পাকিস্তান। ভারত পশ্চিম এবং পূর্ব দুই দিক দিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে বাধ্য করে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পরাস্ত হয় এবং আত্মসমর্পণ করে প্রায় লক্ষাধিক পাকিস্তানি বাহিনী। আমাদের স্বাধীনতার বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন দেশে নব্বই এবং চব্বিশেও দুটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য এই দুটি গণঅভ্যুত্থানও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। কেবল ক্ষমতার হাতই বদল হলো। কিন্তু সব মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলো না। সমাজের অভ্যন্তরে থাকা বৈষম্যেরও অবসান ঘটল না। এ যেন কেবলই কানামাছি, কেবলই অন্ধকার মিলিয়ে গেল সম্ভাবনাময় গণঅভ্যুত্থানগুলো। শাসক বদলেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল গণঅভ্যুত্থানের সীমা।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ব্যক্তিগত স্মৃতি উল্লেখ করছি। ২০ জানুয়ারি হরতালের দিন ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের গতি স্ফুলিঙ্গের মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেখ কাদেরের নেতৃত্বে আমরা আজিমপুর এলাকায় মিছিল বের করি। আজিমপুর শাহসাহেব বাড়ি বটতলার পাশে আসাদদের পারিবারিক বাসায় মিছিল নিয়ে পৌঁছাই। বাসার দোতলা থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে আসাদের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নামিয়ে দেয় তার পরিবারের লোকেরা। এতে দ্রুত মিছিলটি জঙ্গিরূপ ধারণ করে। তীব্র স্লোগানে মিছিলটি জঙ্গি হয়ে ওঠে। আমরা মিছিল নিয়ে এলাকা প্রদক্ষিণ করে নীলক্ষেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পুলিশের গাড়ি এসে লাঠিচার্জ করে, মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

উত্তাল ঊনসত্তরে স্কুলছাত্র আমি স্কুল থেকে বের হওয়া মিছিলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিতাম। মিছিলে মহিউদ্দিন ইউসুফ মন্টু চাচা ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু চাচার নজরে আসার পর আমার নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে পুরানা পল্টন লেনে দাদির হেফাজতে পাঠানো হয়। এক প্রকার গৃহবন্দি করা হয় আমাকে। ২৪ জানুয়ারি হরতালের দিন আমি দাদির হেফাজতে রয়েছি। পল্টন অঞ্চলের মিছিল, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের তীব্র শব্দে উত্তেজিত আমি এক সময় কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যোগ দিই প্রেস ক্লাব থেকে মতিঝিলের পূর্ব দিকের সড়ক অভিমুখে যাওয়া জঙ্গি মিছিলে। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউরের নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। জঙ্গি মিছিলটি দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মোড়ে যাওয়া মাত্র বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পত্রিকার কার্যালয়ের বিপরীতের মুসলিম লীগার লস্করের পেট্রোল পাম্পটিতেও আগুন দেওয়া হয়। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। যে যেদিকে পারে নিরাপদ স্থানের খোঁজে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে, এমনি সময় পুলিশ টিয়ারগ্যাস এবং বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। টিয়ার গ্যাসের তীব্র ধোঁয়া আর পুলিশের লাঠির আঘাত খেয়ে বহুকষ্টে বাড়ি ফিরে আসি।

তিরস্কারের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়াই দাদির সামনে। আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গোসল করার আদেশ দেন। চোখে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণায় গোসলে কিছুটা স্বস্তি বোধকরি। নতমুখে পুনরায় দাদির সামনে দাঁড়াই। দাদির চোখের দিকে তাকানোর শক্তি ও সাহস কোনোটাই তখন ছিল না। দাদি বলেন, ‘তোমার কিছু হলে তোমার বাবা-মাকে আমি কী জবাব দিতাম? তুমি আজ যা করেছ তা-কি সঠিক বলে মনে করো?’ আমি নতমুখে বলি, ‘না’। তিনি বলেন, ‘এটা যদি বুঝে থাকো তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয় এমনটি আর করবে না?’ আমি পুনরায় ‘না’ বললে আমাকে শোবার উপদেশ দিয়ে শেষে বললেন, ‘তুমি তো ফিরেছ। আরেকজন কি ফিরবে, না লাশ হয়ে ফিরবে, জানি না।’ নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু চাচার উদ্দেশ্যে শেষের আশঙ্কার কথাটি তিনি বলেছিলেন। আজও জ্বলজ্বল করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি। যে অভ্যুত্থানে আমাদের মুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সে সম্ভাবনাটিকে নির্বাচন অভিমুখে ঠেলে দিয়ে অভ্যুত্থানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বানচাল করেছিল সুচতুর পাকিস্তানিরা। একাত্তরের মার্চের গণহত্যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করলেও; সেই বিজয় এবং স্বাধীন দেশে ঘটা গণঅভ্যুত্থানের বিজয় সমষ্টিগত মানুষের বিজয়ে পরিণত না হওয়ার কারণে, মুক্তির লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। এই লড়াই আজও চলছে এবং চলবে অবিরাম, সমষ্টিগত মানুষের অধিকার ও মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত