বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম) সাবেক পরিচালক ড. মালা খান টেন্ডার ছাড়াই ১১ ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে তিনি টেন্ডার আহ্বান করে যন্ত্রপাতি ক্রয় দেখান। এর আগেও একইভাবে মালামাল ক্রয়ের পর টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। তিনি ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ক্রয়কৃত মেশিনারিজের মূল্য বেশি দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করতেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে এ অভিযোগের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান শুরুর সুপারিশ করা হয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, বিআরআইসিএম-এর চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার ও সাবেক পরিচালক ড. মালা খানের বিরুদ্ধে যোগ্যতা না থাকলেও গ্রেড-৩ পদের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেওয়া, অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন, টেন্ডার জালিয়াতি, প্রশাসনিক ও গবেষণা কাজে অনিয়ম, পুরস্কার জালিয়াতি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। পরে এসব অভিযোগের সত্যতা জানতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) অধীন প্রতিষ্ঠান বিআরআইসিএমে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান শেষে ওইদিন বিকেলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং বাংলা একাডেমিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের দুটি টিম এ অভিযান চালায়। অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে এনফোর্সমেন্ট টিম। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কমিশন পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।
জানা গেছে, দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট বিআরআইসিএমে অভিযান চালিয়ে যেসব অনিয়ম পেয়েছে তা তুলে ধরে সম্প্রতি কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযানকালে দুদক টিম বিআরআইসিএম-এ গমন করে বিভিন্ন নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, মালা খান ২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ছিলেন। তিনি কেমিক্যাল মেট্রোলজি অবকাঠামো সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে নিজস্ব ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দিয়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন, স্পেসিফিকেশন এবং বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা পাশ কাটিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের মাধ্যমে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মালা খান ক্ষমতার অপব্যবহার করে অফিসিয়ালি নিবন্ধিত নয় এমন মেশিনারিজ আগেই ক্রয় করে পরবর্তীতে টেন্ডারের মাধ্যমে তা ক্রয় করেন। তিনি ঠিকাদারদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশ করে ক্রয়কৃত মেশিনারিজের মূল্য বেশি দেখিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন।
দুদকের অভিযানকালে টেন্ডার ছাড়াই ১১ ধরনের মেশিন ক্রয়ের ঘটনা ধরা পড়ে। এসব মেশিনারিজের মধ্যে রয়েছে- ম্যানুয়েল রোটারি মাইক্রোটম, অটোমেটেড টিস্যু প্রসেসর, মডিউলার টিস্যু, ক্রস স্টেশন, ওয়াটার বাথ, ফিউমহুড, অটোমেটিক র্যাপিড কিট অ্যাসেম্বল মেশিন, ব্যাঙ্গফিল অটো ফিলিং অ্যান্ড লেবেলিং মেশিন-১, ব্যাঙ্গফিল অটো ফিলিং অ্যান্ড লেবেলিং মেশিন-২, ব্যাঙ্গফিল অটো ফিলিং অ্যান্ড লেবেলিং মেশিন-৩ এবং ব্যাঙ্গফিল অটো ফিলিং অ্যান্ড লেবেলিং মেশিন-৪।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মালা খান করোনাকালে ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়ার (ভিটিএম) কিট ক্রয় টেন্ডার ছাড়াই স্থানীয় ভেন্ডরের কাছ থেকে ক্রয় করে বাজারে বিক্রি করেন। পরবর্তীতে টেন্ডারের মাধ্যমে ভিটিএম ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী মালা খান আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে যে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন সেটি ইউজিসির অনুমোদিত নয়। দুদকের অভিযানে তার পিএইচডি ডিগ্রির সার্টিফিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রহণের সত্যতা পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার (গ্রেড-৩) পদে যোগদানের জন্য যেসব শর্তাবলি চাওয়া হয় তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞান গবেষণামূলক চাকরির ক্ষেত্রে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু মালা খানের প্রথম শ্রেণিতে চাকরিকাল ৯ বছরের কম হওয়ার পরও নিয়োগের শর্ত পূরণ ছাড়াই তিনি নিয়োগ পেয়েছেন বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিআরআইসিএম সাবেক পরিচালক ড. মালা খানের প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তা তুলে ধরে কমিশনে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। অভিযানকালে অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পাওয়ায় এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। কমিশন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্ত দেবে সেই মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দুদকের অভিযান পরিচালনার পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মালা খানের কথা হয়, ওইদিন তিনি বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন। তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে, তারা কাগজপত্র তৈরি করে দুদকে অভিযোগ দাখিল করছে। কী কী কাগজপত্র দিচ্ছে তা তিনি জানতেও পারছেন না। তিনি এসব বিষয় দুদককে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছেন। থানায় জিডিও করেছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো তদন্তে প্রমাণিত হয়নি, তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এসব বিষয় জানিয়েছেন।