মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশ মেলাতে চায় না বিএনপি

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৫, ০৫:৩৯ এএম

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একই কাতারে ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে আসা সমীচীন নয় বলে মনে করে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। গতকাল রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেওয়া পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মতামতে দলটি এ কথা তুলে ধরেছে। এ ছাড়া আরও চারটি দল গতকাল সংস্কার বিষয়ে নিজ নিজ প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে জমা দিয়েছে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে মতামত জমা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের মতামত তারা যে স্প্রেডশিট আমাদের দিয়েছেন সেটা এবং বিস্তারিত মতামত তার ওপর দুটিই একসঙ্গে দিয়ে এসেছি। অন্যগুলো কয়েক দিন পর বিস্তারিত মতামত দেব। যেগুলোতে একমত হওয়া উচিত সেগুলোতে একমত হয়েছি। আর সেগুলো আমাদের ভিন্নমত দেওয়া প্রয়োজন সেগুলোতে আমরা মতামত সহকারে দিয়েছি। মোটামুটি আমরা পুরোপুরি সহযোগিতার মধ্যে আছি।’

দুপুর ১টায় সংসদ ভবনের এলডি ভবনে সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে বিএনপির মতামত হস্তান্তর করে। এ সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ছিলেন। ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যানের সঙ্গে সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী মুনীর হায়দার উপস্থিত ছিলেন।

সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ৬ মার্চ বিএনপিসহ ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে ‘চিঠি ও স্প্রেডশিট’ পাঠিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানাতে বলা হয়। রবিবার পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দেয়।

এদিন বিএনপি ছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী-বাসদ) ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন তাদের মতামত জবাব দেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর কয়েকটি সংস্কার কমিশনের পাশাপাশি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়। এ কমিশনের প্রধান হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা।

‘৭১ আর ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান এক হতে পারে না’ : সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উনারা একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একই কাতারে ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে এসেছেন, যেটা আমরা মনে করি সমীচীন নয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের অংশটি সংবিধানের অন্য জায়গায় কীভাবে চতুর্থ তফসিল যুক্ত করা যায় সেটা পরে আলোচনা করা যায়। এখানে সরকারের কোনো লেজিটেমেসির অভাব আছে বলে আমরা মনে করি না। এ সরকার সাংবিধানিকভাবেই গঠিত হয়েছে। আর্টিকেল ১০৬ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অ্যাডভাইজরি রোল হিসেবে যেটা আছে সেটার ভিত্তিতে এ সরকার শপথ নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাইকে যুক্ত করেই এ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সাজাতে চাই, বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো সংস্কার করতে চাই, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য বৈষ্যমহীন একটি সত্যিকার সুশাসন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য। যেখানে সবারই মর্যাদা থাকবে সাম্য থাকবে।’

‘গণপরিষদ ও গণভোট নির্বাচন নয়’ : সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গণপরিষদ নিয়ে অনেকে বক্তৃতা দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্র হয়েছে, সেখানে সংবিধান রচনা করা দরকার, রাষ্ট্রের সংবিধান নেই, সেজন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিনিধিত্ব আকারে গণপরিষদ গঠন করা হয়। সেটা নির্বাচনের মাধ্যমে হতে পারে, সিলেকশনের মাধ্যমেও হতে পারে। সেই গণপরিষদ একটা সংবিধান প্রণয়ন করে এবং সেটা গৃহীত হওয়ার পর সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়। এখানে আমাদের রাষ্ট্র কি নতুন হয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র পুরাতন রাষ্ট্র। ৫৩-৫৪ বছর। আমাদের একটা সংবিধান আছে, সেই সংবিধানের হয়তো গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে। তবে রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করা দরকার নতুনভাবে এর সঙ্গে আমরা একমত নই। সেজন্য আমরা সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনী এনেছি। যারা গণপরিষদ দাবি করছে তারাও ৬৯টা প্রস্তাব দিয়েছে সংশোধনের জন্য। আমরা একটু কম দিয়েছি। এগুলো আলোচনা করে আমরা একটা বৃহত্তর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের একটা ব্যাপক সংশোধিত সংবিধান পেতে পারি। সেই সংবিধানকে তারা নতুন সংবিধান বলতে পারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখানে গণপরিষদের কোনো প্রয়োজন নেই।’

বিএনপির মতামত : দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্প্রেডশিটে ২০টির মতো প্রস্তাবনা সুপারিশ ছিল। ২০টার মধ্যে আমরা ১১টাতে সরাসরি একমত আর ৭-৮টাতে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। শুধু একটি প্রস্তাবে আমরা ভিন্নমত পোষণ করেছি। কারণ ওখানে একটা আইন সংশোধনের বিষয় রয়েছে।’

প্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে ২৬টা বিষয়ে প্রস্তাবনা আছে। সেখানে আমরা এর প্রায় অর্ধেক বিষয় একমত। আর বাকি অর্ধেক বিষয়ে আমাদের মতামত-মন্তব্য আছে। বিস্তারিত আলাপ-আলোচনায় একটা জায়গায় আসা যাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ‘এসব প্রস্তাবনার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কর্মকর্তাদের সচিব পদোন্নতির জন্য পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেজ থেকে। সেখানে বিদ্যমান এসএসবি বাতিলের একটা সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে আমরা একমত নই। তার পরিবর্তনে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করার একটা প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনে রাজনীতিকরণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেজন্য আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আরেকটা বিষয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে প্রস্তাবনা দেওয়া আছে, সে বিষয়ে আদালতের রায় আছে। আদালতের রায় বহাল থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাইনি। আমরা স্টেটাস কো (স্থিতিবস্থা) রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করি।’

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘কমিশনের প্রায় সব প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। যেহেতু আপনারা জানেন, আমরা আমাদের ৩১ দফা প্রস্তাবের মধ্যে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য অনেক প্রস্তাব ওখানে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের আর্টিকেল ১১৬ আমরা পরিবর্তন বা সংশোধনের সুপারিশ করেছিলাম। যাতে করে বর্তমানে সংবিধানের বিদ্যমান প্রভিশন তাতে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট করবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে। এখানে প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্র্টের হাতে রাখতে চাই। সেটা আমাদের প্রস্তাব। যাতে করে সুপ্রিম কোর্টের আলাদা একটি সেক্রেটারিয়েট হবে সেই প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে বাজেটে কী হবে না হবে সেটা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে সেটা আমরা মন্তব্যে দিয়েছি।’

‘নিম্ন আদালতের জন্য আলাদা কাউন্সিল’ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনারা জানেন সেটা অলরেডি পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের রায়ে এটা বহাল হয়েছে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে আদলে লোয়ার জুডিশিয়ারির জন্য লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছি। যাতে একটা জবাবদিহি থাকে নিম্ন আদালতের জন্য। এখানে সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লোয়ার জুডিশিয়ারির জবাবদিহি কতটুকু নিশ্চিত কীভাবে করা যাবে, সেটা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। বিচার বিভাগের যেসব প্রস্তাবনা তারা দিয়েছে তার সবগুলোর সঙ্গে আমরা একমত এবং আমাদের নিজস্ব অভিমতও আছে। বিচার বিভাগের চার-পাঁচটি বিষয়ে একটু মন্তব্য সহকারে মতামত দিয়েছি।’

নির্বাচনসংক্রান্ত সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারবিষয়ক রিপোর্টে দেখা যায় উনারা ২৭টার মতো প্রস্তাব দিয়েছেন। তাতে অধিকাংশ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমরা ঠিক বুঝতে পারেনি, নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচনব্যবস্থা-সংক্রান্ত রিপোর্টে কিছু কিছু বিষয়ে সংবিধানের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নির্বাচনী সংস্কার নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। আমরা সেই বিষয়ে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক রিপোর্টে মতামত দিয়েছি।’

‘ইসির স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না’ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একটি বিষয়ে আমাদের মতামত পজিটিভলি দিয়েছি। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন। এই ইসির ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য সংস্কার কমিশন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। যেগুলো আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ। যেমন এনআইডি। এটা যদি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া হয় তাহলে ইসিকে বারবার এনআইডি বিষয়ে সহযোগিতার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে। তার চেয়ে বর্তমানে যে বহাল আছে, অবশ্য একটা আইন আছে, যেটা আওয়ামী লীগের আমলে করেছে যে, এনআইডির কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আইনটি এখনো বাতিল করা হয়নি। এ আইনটি বাতিল করে এনআইডির কার্যক্রম পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখা উচিত।’

সীমানা নির্ধারণও নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখা উচিত বলে বিএনপি মনে করে বলে জানিয়ে সালেহউদ্দিন বলেন, ‘সীমানা নির্ধারণ ইসির আইন আছে এবং সাংবিধানিক এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশনের সেই আইনে সামান্য একটা প্রিন্টিং মিসটেক ছিল সেটা আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয়ে সেটা গিয়েছে কিন্তু এখনো সংশোধন হয়নি। না হওয়ার কারণ ইসি এখনো ডিলিমিটেশন সংক্রান্ত কোনো শুনানি করতে পারছে না। তার ফলে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাব, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনীটা দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখা হোক। আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে রাখার বিষয়টা আমরা নাকচ করছি।’

সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্প্রেডশিটে উনারা সংবিধানের প্রস্তাবনা উল্লেখ করেনি। সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রস্তাবনা যেটা প্রিয়াম্বল নামে আমরা চিনি। সেটা পুরোপুরি সংশোধনের বা পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকটা রিরাইটিংয়ের মতো। সেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে এক কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে। যেটা সমচিত বলে আমরা মনে করি না। এটাকে অন্য জায়গায় রাখার বা তফসিল অংশে রাখার বা স্বীকৃতি দেওয়ার বিভিন্ন রকমের সুযোগ আছে। সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা পরে প্রকাশ করব। কিন্তু সেই প্রিয়াম্বলটা আমরা চাই। যেটা অষ্টাদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থা যেটা পঞ্চম সংশোধনীর পরে গৃহীত হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের সব অভিপ্রায় হিসেবে সেটা বহাল থাকা উচিত।’

‘রাষ্ট্রের নাম ‘রিপাবলিক’ করা সুপারিশে না’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সুপারিশে উনারা শুরু করেছেন রিপাবলিক দিয়ে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন দিয়ে যেটাকে প্রজাতন্ত্র না বলে জনগণতন্ত্র বা নাগরিকতন্ত্র বা পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাংলায় বলছেন যে, জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। বাংলায় উনারা নাগরিকতন্ত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ লিখতে চান। সেটা কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আমরা এ বিষয়ে একমত নই। তাছাড়া মৌলিক অধিকার এবং মূলনীতির ক্ষেত্রে উনার ব্যাপক পরিবর্তনের একটা প্রস্তাব ওখানে রেখেছেন। আমরা প্রস্তাব করেছি, বর্তমানে সাংবিধানিক ধারাগুলো আছে, অনুচ্ছেদগুলো আছে তার মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের প্রস্তাব অনুসারে মূলনীতির মধ্যে যেসব প্রস্তাব আছে; তার হয়তো সংশোধনী আনা যায়। কিন্তু আমরা দলের পক্ষ থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থায় বহাল রাখার জন্য প্রস্তাব করেছি।’

‘মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা’ নামে আলাদা চাপ্টার সংযুক্ত করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘যেটা আসলে অনেকটা আমরা মনে করি, অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে হয়তো যাদের পার্লামেন্টের এক্সপেরিয়েন্স বা রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে অভিমত আসতে পারে বা দিয়ে থাকতে পারেন। মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সেজন্য মৌলিক অধিকারের সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটগুলো সীমিত। এ ছাড়া সোশ্যাল কালচারাল ইকোনমিক রাইটগুলো সেগুলো রাষ্ট্রের সক্ষমতা ওপর ভিত্তি করে গুড গভর্নেন্সের ওপর ছেড়ে দিতে হয়। সেই জায়গায় উনার জিনিসটা একটু মিলিয়ে ফেলেছেন। এমালগেমেট করে ফেলেছে। সেটা আমরা আশা করি আলোচনার সময়ে বোঝাতে সক্ষম হব।’

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে উচ্চকক্ষের আসন ও মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে জানান সালাহউদ্দিন। মহিলাদের সংসদীয় আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হলেও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমতের কথাও বলেন তিনি।

বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘সংবিধানের প্রায় শতাধিক প্রস্তাবের মধ্যে এখানে স্প্রেডশিটে ৫৭টা এসেছে। সেই জায়গায় বিস্তারিত প্রতিবেদন আমরা যুক্ত করেছি। পুরো পুস্তকটাতে তাদের সুপারিশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো এক জায়গায় এসে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেব। অন্যান্য কয়েকটি কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিবেদন আমরা কয়েক দিন পর দেব বলে উনাদের জানিয়েছি।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার চায় : জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে গণভোটের মাধ্যমে গ্রহণ করতে রাজি আছি। গতকাল রবিবার ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে আমরা যে যে জায়গায় সবাই একমত হব, যতটুকু সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, সেটা বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের মাধ্যমেও করা হয়, তা মেনে নেব। আমরা প্রধানত চাই সংস্কারটা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে হয়। এটা যেন নির্বাচিত সংসদের হাতে চলে যায়, এরকমটা না হয়ে আগে হয়। সেটা গণভোট বা সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচন হতে পারে।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ১৫১টি প্রস্তাবে একমত, ১০টি আংশিকভাবে একমত এবং ৫টিতে একমত নয় বলে জানান তিনি।

ঐকমত্য কমিশনের ‘স্প্রেডশিট’ নিয়ে সিপিবির আপত্তি : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো ‘স্প্রেডশিট’কে অস্বচ্ছ, অসম্পূর্ণ ও একপেশে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। দলটি জানিয়েছে, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুধু টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দেওয়া যথাযথ হবে না, বরং ব্যাপক আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। গতকাল রবিবার ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার নিয়ে মতামত জমাদান শেষে লিখিত বক্তব্যে দলটির পক্ষ থেকে এ কথা বলা হয়।

ঐকমত্য কশিমনের কাছে সিপিবির অভিমত তুলে ধরার পর দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সংস্কারের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের সঙ্গে সিপিবি একমত। অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে মৌলিকভাবে দ্বিমত রয়েছে। আমরা বলেছি, অনেকগুলো প্রস্তাবের বিকল্প প্রস্তাব আছে। অনেকগুলো প্রস্তাব একেবারেই নাকচ করে দেওয়ার আছে। কিন্তু এ কাজগুলো করার উপযুক্ত পদ্ধতি টিক চিহ্ন দেওয়া নয়। উপযুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে আলাপ-আলোচনা করা। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করব।’

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘মূল সংস্কার কমিটির প্রস্তাব পড়লে দেখা যাবে, সুপারিশের ১৬৬টি প্রশ্নে অনেক কিছু অস্পষ্ট। আমরা দেখলাম অনেক কিছু যদি শুধু ‘হ্যাঁ/না’- এর মধ্যে থাকি, তাহলে পুরো যে সংস্কার প্রস্তাব সেটা একটা ভুল বোঝাবুঝির জায়গায় যাবে।’

সিপিবির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, জনগণকে স¤পৃক্ত করেই সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে। তাই জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করেই এ পথে এগুতে হবে। যে যে ধরনের মৌলিক সংস্কার আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, একমাত্র জনগণই তার প্রকৃত কারিগর হতে পারে। তাই ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে সংস্কার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে এবং জনগণের মতামতকে ভিত্তি করে আমাদের এ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

সিপিবি মনে করে যে,‘ সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব ও যথাযথ কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনিক কাঠামো গণতন্ত্র, উপযুক্ত বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ এ নীতিমালার ভিত্তিতে মৌলিকভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।

বলা হয়েছে, অর্থনীতি যেহেতু রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ গোটা সমাজের ভিত্তি কাঠামো, তাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার না করে অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধিত  কোনো সংস্কারকেই টেকসই করা যাবে না। এজন্য ‘অবাধ ও খোলা বাজার অর্থনীতি’র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়ে তার পাশাপাশি, সমবায়ী খাত, ব্যক্তি খাত ও মিশ্র খাতসহ প্রতিটি খাতের যথাযথ ও সুপরিকল্পিত ভূমিকা নিশ্চিত করে স্বাধীন জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের পথ সুগম করতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

আরও বলা হয়েছে, নির্বাচন যাতে প্রকৃতই অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য নির্বাচনের আগে এখনই সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জরুরিভাবে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করতে হবে।

‘অপরাপর সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমরা এ সময়ে সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা নিয়ে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে পারব। এ কাজ করার জন্য যত দ্রুত সম্ভব গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে তারাই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ অগ্রসর করবে। জনগণের ওপরই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ছেড়ে দিতে হবে।

সে সময় উপস্থিত ছিলেন দলটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, সম্পাদক ডা. সাজেদুল হক রুবেল ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আসলাম খান প্রমুখ।

সংস্কারের ১১৩ সুপারিশে পুরোপুরি একমত জাতীয় নাগরিক পার্টি : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ১১৩টি প্রস্তাবের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। ২৯টি প্রস্তাবে আংশিক একমত হয়েছে। গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের কমিশনের কার্যালয়ে লিখিত মতামত জমা দিয়েছে নতুন দলটি।

পরে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান।

তুষার বলেন, ‘অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত এবং আংশিকভাবে একমত হলেও আমরা আমাদের মতামত দিয়েছি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা এটা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা বলেছি অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ দাপ্তরিক ভাষা হওয়া উচিত। কথাটা হওয়া উচিত দাপ্তরিক ভাষা।’

‘বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশি বলে পরিচিত হবেন’ কমিশনের এ সুপারিশে দলটি রাজি হয়েছে; তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন যে জাতিসত্তা আছে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে বলে মত দিয়েছে দলটি।

কমিশনের আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনে দলগুলোকে তরুণ-তরুণীদের ১০ শতাংশ মনোনয়ন দিতে হবে। এ প্রস্তাবে জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে তরুণ-তরুণীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২৩ বছর হওয়া উচিত বলে অভিমত দিয়েছে দলটি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত