নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘসময় ধরে চলে আসছে এই বিতর্ক। কোনো উপাচার্য তার একক ক্ষমতাবলে অ্যাডহকে (অস্থায়ী ভিত্তিতে) নিয়োগ দেন, কেউ আবার দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেন। তবে ‘বিতর্কিত’ এই নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে পারে না কেউই। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হোক কিংবা বিএনপি। সব আমলের নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরাই এই ‘বিতর্কিত’ নিয়োগ দিয়ে এসেছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবও একই পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বলছেন, পূর্বে যারা নিয়োগ নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন তারা প্রতিষ্ঠানকে সার্ভিস দিতে নয় রাজনৈতিক দলকে সার্ভিস দিতে এসেছে। পটপরিবর্তন হয়েও যদি অন্যায় হয়, তাহলে পূর্বের সঙ্গে ব্যতিক্রম কিছু থাকবে না। বিপ্লব পরবর্তী এই প্রশাসনও যদি এই ‘কলঙ্কের’ পিছু না ছাড়াতে পারে তাহলে জুলাই আন্দোলন ব্যর্থ হবে। তবে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তাড়াহুড়োর মধ্যে নিয়োগগুলো দেওয়ায় বিচ্যুতি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১৮ নভেম্বর আইসিটি সেন্টারে সহকারী প্রোগ্রামার পদে টাকা ২২০০০-৫৩০৬০/- টাকা বেতনে সহকারী প্রোগ্রামার পদে (নবম গ্রেড) অ্যাডহক ভিত্তিতে ৬ (ছয়) মাসের জন্য দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নিয়োগপ্রাপ্ত দুই জন হলেন— শরিফুল ইসলাম ও মোমেন খন্দকার অপি। মোমেন খন্দকার অপি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার স্নাতকের ফলাফল প্রকাশের আগেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত মো. শরিফুল ইসলামেরও একই অবস্থা। তিনিও স্নাতক পাশের সার্টিফিকেট দেখাতে পারেননি।
এই বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। পরবর্তীতে এই নিয়োগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের প্রশাসন। আরও একটি অ্যাডহক নিয়োগ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ দপ্তরের অনুসন্ধান কাম তথ্য অফিসার পদে। যে নিয়োগ নিয়েও ক্যাম্পাসে আলোচনা-সমালচনা হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতেও হয়েছে এ ধরনের নিয়োগ। তবে সেগুলো ছিল রাজনৈতিক। ২০০৪ সালে বিএনপির শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য ফাইসুল ইসলাম ফারুকী ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে। যা নিয়ে ওই সময় তৈরি হয়েছিল আলোচনা-সমালোচনা। ২০১৯ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের কন্যা আনিকা ফারিয়া জামান অর্ণাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন। বাবার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক পরিচয়ে তাকে সেই সময় নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য প্রমাণিত হয়। তাই রাবির সব ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও ২০২১ সালের ৫ মে, এই উপাচার্য তার শেষ কর্মদিবসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, সাংবাদিক, তার বাসার কাজের লোকসহ ১৩৭ জনকে নিয়োগ দেন অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক)। যা সারা দেশব্যাপী সমালোচিত হয়। যদিও এই নিয়োগ পরে অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট।
এসব বিতর্কিত নিয়োগের কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। গত বছরের ২৭ জুন নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে বিধিবিধান ও নীতিমালা অনুসরণ করে সুষ্ঠুভাবে সব নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়।
তবে, পূর্বের মতো নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে ফের নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রশাসনকে সবসময় স্বচ্ছতা, নিয়মমাফিক এবং আইনের মধ্যে চলতে হয়। প্রশাসন যদি এগুলোর ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে প্রশ্ন উঠবেই। নিয়োগ হবে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। এখন পট পরিবর্তন হয়ে যদি অন্যায় হয়, তাহলে পূর্বের সঙ্গে ব্যতিক্রম কিছু থাকবে না। একই রকম কাজ হবে। আমরা প্রতিবার নিয়োগ নিয়ে বিতর্কিত হয় কিন্তু কেউ সতর্ক থাকি না। পার্সোনাল এজেন্ড নিয়ে প্রশাসনে বসলে হবে না। প্রশাসন সবার জন্য। নিজেকে সবার উপরে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটা স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিবারই যারা উপাচার্য হয়ে আসেন এবং নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেন তারা প্রতিষ্ঠানকে সার্ভিস দিতে নয় রাজনৈতিক দলকে সার্ভিস দিতে আসেন। কেউ রাজনৈতিক প্রেশারে পড়ে নিয়োগ দিয়েছেন, কেউ আবার নিজ ক্ষমতাবলে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করেছেন। উদাহরণ অনেক আছে দেখে নেবেন। তবে, এর মানে এই নয় যে, সবাই বিতর্কিত (অ্যাডহক/ দৈনিক দিন মজুর) নিয়োগ দিয়েছে। অনেকেই সুন্দরভাবে প্রশাসন চালিয়ে গেছে। বিপ্লব পরবর্তী এই প্রশাসনও যদি আগের মতো রাবির কলঙ্ক মাখা নিয়োগ দিতে থাকে তাহলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।’
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল আলিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যখনই যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন তার আশেপাশের লোকজনকে নিয়ে কাজ করেন। আশেপাশে থেকেই হয়তো একটা প্রেশার যায়। ইন্টারমেডিয়েট পাশ দিয়ে কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিসার হতে পারে না। হয়তো খেয়াল করেনি বা যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে কিভাবে প্রসেস করেছে এটা একটা প্রশ্ন। সার্টিফিকেট চেক করার দায়িত্ব তো উপাচার্যের না। এইটুকু আস্থা তো রাখতেই হয়। না হলে প্রশাসন চলবে কিভাবে?’
নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। উক্ত কমিটি এই নিয়োগের কোথায় কোথায় বিচ্যুতি ঘটেছে তার রিপোর্ট দেবে। আমি এই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো বিচ্যুতি বরদাস্ত করব না। আমাদের একটু তাড়াহুড়োর মধ্যে নিয়োগগুলো দেওয়ায় বিচ্যুতি হয়েছে।’
নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ চান ছাত্র নেতারা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদি সজীব বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোপূর্বে আমরা যে কয়েকটি বিতর্কিত বিষয় লক্ষ্য করেছি তার মধ্যে অন্যতম হলো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। এ থেকে বের হতে পারেনি পূর্বের কোনো প্রশাসনই। কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে গেলে প্রশাসনের কিছু মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকেই বেশি দায়ী করতে হবে। বর্তমান যে নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক উঠছে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এসে আমরা কখনোই এমনটা দেখতে চাইনি। নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাডহক পদ্ধতি কখনো একটি আদর্শ নিয়ম হতে পারে না। বরাবরই বলে আসছি এখনো বলছি অনতিবিলম্বে একটি নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করে সার্কুলারের মাধ্যমে প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে।’
শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অভ্যুত্থান পরবর্তী রক্তস্নাত বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে এই নিয়োগ আমাদের কাছে মোটেও কাম্য নয়। যে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে রক্তক্ষয়ী এক গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আর কোনো ওপেন-হিডেন কোটা আর লবিং তদবিরের চাকরি ব্যবস্থা থাকবে না। বর্তমান প্রশাসনকে অবিলম্বে এই নিয়োগ বাতিল করে নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে। এসব বিনা সার্টিফিকেট অ্যাডহক নিয়োগে যারা যারা জড়িত তাদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
শাখা ইসলামি ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, আমরা অ্যাডহক নিয়োগের বিপক্ষে। যতদ্রুত সম্ভব সার্কুলার দিয়ে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিবে প্রশাসন সেই আশা রাখি।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাকিব হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কালো আইনের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। অ্যাডহকে যে নিয়োগগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাতিল করে নতুন নীতিমালা করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে নিয়োগের স্বচ্ছতা থাকে। বিপ্লব পরবর্তী প্রশাসনের ওপর অনেক আশা ছিল। কিন্তু তারা যেভাবে কাজ শুরু করেছে ফ্যাসিস্ট আর বর্তমানের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না।’