ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে দুই দেশের বাইরে। বাংলাদেশ এই যুদ্ধের কোনো অংশীদার না হলেও দেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে গত কয়েক দিন ধরে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশে নয়, এই যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা চলছে দেশে দেশে। কী হবে যুদ্ধের পরিণতি, কতটুকু বিস্তৃত হবে এই যুদ্ধ, কত দিন চলতে পারে আর ফলাফল কী হতে পারে এসব নিয়ে সামরিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীতে প্রচারমাধ্যম সয়লাব। মানুষ পড়ছে, শুনছে, মতামত দিচ্ছে। এমনকি কেউ বাগ্বিত-াতেও জড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধটা একপাক্ষিক হচ্ছে না। হামলা এবং পাল্টাহামলা চলছে। ক্ষণে ক্ষণে রিপোর্ট পাল্টে যাচ্ছে। বাড়ছে হামলার সংখ্যা, আহত-নিহতদের সংখ্যা। একটা কথা আছে যে, যুদ্ধে সবচেয়ে আগে মৃত্যুবরণ করে সত্য। ফলে কার রিপোর্ট যে সত্য, সেটা যাচাই করা মুশকিল। যুদ্ধরত উভয়পক্ষই তাদের সাফল্য প্রচার করতে থাকে এবং অপরপক্ষের ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে বলতে থাকে। তারপরও এই তথ্যের ভিত্তিতেই মানুষ আলোচনা করতে থাকেন। পাকিস্তানের হামলায় গতকাল পর্যন্ত ভারতে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এ সময় আহত হয়েছেন প্রায় ৫৯ জন। অপরদিকে মঙ্গলবার রাতে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরুর পর পাকিস্তান ও দেশটির নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে ৩২ জন নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ।
ভারত-পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধ, উত্তেজনা আর বৈরিতা নিয়েই চলছে দেশ দুটি। যুদ্ধের প্রথম এবং প্রধান ক্ষেত্র হলো কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরপরই ২১ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধ ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয় আর জম্মু-কাশ্মীর ভাগ হয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ যুদ্ধবিরতি রেখা বা লাইন অব কন্ট্রোল কাশ্মীরকে বিভক্ত করে। এই কাশ্মীর নিয়ে ১৯৬৫ সালেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। ২০১৯ সালেও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ি বহরে হামলা, ৪০ জন সেনা সদস্যের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনা ও ছোটখাটো যুদ্ধে জড়িয়ে পরে দুই দেশ। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাসকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। ফলে মাঝে মাঝেই উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করতে থাকে।
এবারে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার শুরু হয় গত ২২ এপ্রিল। সে দিন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ঘটনার পরপরই এই নৃশংস হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়েছে ভারত। পাকিস্তান এই অভিযোগ নাকচ করে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর উত্তেজনার মধ্যে ৬ মে রাতে পাকিস্তান ও দেশটির নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে হামলা চালায় ভারত। হামলার আগে থেকেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল ভারত। ফলে এটা অনুমান করা যাচ্ছিল যে, ভারত সামরিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। ফলে পাকিস্তান সতর্ক ছিল। একদিকে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা, অন্যদিকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনে ১৯৬২ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে। পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দুই দেশই সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি নিজ নিজ আকাশসীমায় প্রতিপক্ষের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া পরস্পর ভিসা বাতিল, আকাশসীমা বন্ধ, বন্দর ব্যবহার বন্ধসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে দুই দেশ। শুধু সামরিক নয়, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারেও।
প্রভাব পড়েছে বেসামরিক বিমান চলাচলেও। পাল্টাপাল্টি হামলার কারণে পাকিস্তানের করাচি, লাহোর ও ইসলামাবাদের বিমানবন্দরগুলোর কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করা হয়। ১০ মে পর্যন্ত ভারতের ২০টির বেশি বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এই বিমানবন্দরগুলোর বেশিরভাগই উত্তর ভারতে। এসব পদক্ষেপের কারণে ভারতের ৪০০টির বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়। যুদ্ধের শুরুতেই আকস্মিক ও তীব্র আক্রমণ চালায় ভারত। ৬ মে ভারত-পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জায়গায় বিমান হামলা চালায়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, সন্ত্রাসীদের ৯টি ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। আর রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের ৩টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ৫টি বিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সামরিক বা বেসামরিক স্থাপনায় হামলার কথা অস্বীকার করা হলেও একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পাকিস্তান দাবি করেছে। ভারতের হামলার পরপরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, ভারতের হামলার জবাবে নিজস্ব সময়, স্থান ও পদ্ধতিতে প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার তাদের আছে। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার পাকিস্তানের পার্লামেন্টের বাইরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পাকিস্তানে হামলায় ভারতের ৭৫ থেকে ৮০টি যুদ্ধবিমান অংশ নিয়েছিল। ভারতের হামলার মুখে সংযত আচরণ করেছে পাকিস্তান। হামলায় অংশ নেওয়া ‘প্রায় ৭৫ থেকে ৮০টি বিমানের’ মধ্যে পাঁচটিকে তারা গুলি করে ভূপাতিত করেছে। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা এসব হামলা চালিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়েবা (এলইটি) ও জইশ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা বলেছে, পাঞ্জাবের ভাওয়ালপুরে জেইএমের ঘাঁটি এবং একই প্রদেশের মুরিদকে শহরে এলইটির আস্তানাসহ নয়টি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে তারা।
অবশ্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, পাকিস্তানের ছয় স্থান পাঞ্জাবের শিয়ালকোট, ভাওয়ালপুর ও মুরিদকে এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদ, বাগ ও কোটলিতে ছয়টি জায়গায় ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, হামলায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় আঘাত হানতে সক্ষম সমরাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে ভারতের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে এই হামলা চালিয়েছে। এমনভাবে হামলাগুলো চালানো হয়েছে, যেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কোনো স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু না হয়। হামলায় স্কাল্প ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, হ্যামার প্রিসিশন গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র এবং আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। এ তো গেল যুদ্ধের বিবরণ। যুদ্ধ করে সেনাবাহিনী, শুরু করে ক্ষমতাসীনরা আর যুদ্ধের খরচ জোগায়, ক্ষয়ক্ষতি বহন করে জনগণ। তাই যুদ্ধ নিয়ে উন্মাদনা তৈরি না করলে জনগণের আবেগকে ব্যবহার করা যায় না। এই উন্মাদনায় জাতিগত, ধর্মীয় সব উপাদান ব্যবহার করে জনগণকে উত্তেজিত করা হয়। ফলে অস্ত্র ব্যবসা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের দাবিকে পাশে সরিয়ে রাখা এবং রাজনৈতিক ফায়দা তোলা সবই সম্ভব। ফলে দিন শেষে জনগণ দেখে যুদ্ধে জয়-পরাজয় নিয়ে যত বিতর্ক থাকুক না কেন, আসলে হেরে গেছেন তারা। এবারও পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে এ অঞ্চলে পড়তে শুরু করেছে। এক দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করে অপর দেশের বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রী ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। দুই দেশের শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। ভারতীয় মুদ্রা রুপির দামও কমেছে। এমনকি যুদ্ধের কোনো পক্ষ না হওয়ার পরও শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত ৭৮ বছরে কয়েক দফা যুদ্ধ হলো। কে লাভবান হয়েছে? প্রতিটি যুদ্ধেই শেষ পর্যন্ত সমাধান খুঁজতে হয়েছে আলোচনার টেবিলে। ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তিতে ভারত পাকিস্তান লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি মেনে নেওয়া ও বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয় আলোচনার শর্ত ভঙ্গ করে আর যুদ্ধ শেষ হয় আলোচনার টেবিলে বসে। মাঝখানে থাকে রক্তের স্রোত, জীবন ও সম্পত্তি হারানো মানুষের দীর্ঘ সারি আর হাহাকার। যুদ্ধের আগুনে ঘর পুড়লেও সেখানে আলু পোড়ানোর চেষ্টা চলে। অস্ত্র বিক্রেতারা তৎপর অস্ত্র বিক্রি করতে, ক্ষমতাসীনরা চেষ্টা করছে যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে ভোট এবং ক্ষমতা সংহত করার, জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেন দেশ চালাতে সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করা যায়। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধেও সেটাই ঘটছে। উপমহাদেশের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ পরিস্থিতিতে নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক দিক দেখলে, দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। জনগণের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকার কারণে কোনো দেশের পক্ষ নেওয়া বা বিপক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা প্রবল। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষের জীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনে। আজকের দুনিয়ায় এক দেশ আর এক দেশকে দখল করা অত সহজ নয়। যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে গিয়ে অর্থনীতির যে কি হাল হয়, তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে বারবার। আর যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে হলেও যুদ্ধের ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, গোটা বিশ্বেই তা ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। ৫ হাজার কিলোমিটার দূরের যুদ্ধ আগুন লাগিয়েছে বাংলাদেশের কারওয়ানবাজারের সবজির দামেও। লাভবান হয়েছে ব্যবসায়ীরা, আর দুর্ভোগে পড়েছে জনগণ।
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়তো স্থায়ী হবে না। হুঙ্কার দিয়ে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি আর অল্প-স্বল্প যুদ্ধ এই নীতি অনুসরণ করবে দুই দেশ। কিন্তু এতে আন্তর্জাতিক মোড়লদের দুই দেশকে কেন্দ্র করে বলয় তৈরি এবং অস্ত্র ব্যবসাকে বাড়ানো আর নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরির কাজ ভালোভাবেই এগোবে। যার খেসারত দেবে জনগণ। যুদ্ধ করবে সেনাবাহিনী আর ব্যাপক হারে মৃত্যুবরণ করবে সাধারণ মানুষ। এই যুদ্ধ থামবে কিন্তু মুনাফা ও ব্যবসার আগুন যুদ্ধংদেহী মনোভাব জাগিয়ে রাখবে বহু দিন। এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হবে কাশ্মীর আর উত্তেজিত থাকবে উপমহাদেশের জনগণ।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক