বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

স্বপ্নছোঁয়া সোনার কন্যাদের ছেঁটে ফেললেন বাটলার

আপডেট : ১৮ মে ২০২৫, ১২:৪৫ এএম

‘একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। পিটারের অধীনে খেলতে হচ্ছে না। সেটা হলে সারাক্ষণ এক অস্বস্তির মধ্যে থাকতাম। বরং এখানে (ভুটানে) অনেক ভালো আছি। সবার কাছ থেকে অন্তত সম্মানটা পাচ্ছি’ জাতীয় দলে ডাক না পেয়ে কষ্ট চেপে এভাবেই বলছিলেন এক ফুটবলার।

জুনে মিয়ানমারে নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের জন্য প্রাথমিক দল চূড়ান্ত করেছেন ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার। যেখানে তিনি রাখেননি নারী ফুটবলের সোনালি সময়ের পাঁচ তারকাকে। তাদের মধ্যে আছেন টানা দুবার সাফজয়ী বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এবং দুই সাফের রক্ষণভাগের অন্যতম ভরসা মাসুরা পারভীন। ভুটান লিগে খেলতে যাওয়া ১০ ফুটবলারের মধ্যে ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, রূপনা চাকমা ও শামসুন্নাহার জুনিয়র শনিবার দেশে ফিরে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন। বাকিরা রয়ে গেছেন ভুটানে।

সাবিনা ও মাসুরা ছাড়াও ছাঁটাই হয়েছেন সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণারানী সরকার ও মাতসুশিমা সুমাইয়া। মনে করা হচ্ছে, ২৩ সদস্যের চূড়ান্ত স্কোয়াডে আরও কিছু সিনিয়র বাদ পড়তে পারেন।

গত বছর অক্টোবরে কাঠমান্ডুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালে অভিজ্ঞ ফুটবলারদের সঙ্গে কোচ বাটলারের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। তখন তিনি অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে সাফ জয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন, যা শুরুতেই ব্যর্থ হয় দুর্বল পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করায়। সেই ম্যাচে মাসুরা, কৃষ্ণা, সানজিদা, মারিয়াদের বাদ দিয়ে একাদশ সাজান কোচ। ফলে দল ছিল প্রায় নির্বিষ। শেষ মুহূর্তে শামসুন্নাহার জুনিয়রের গোলে ম্যাচটি ড্র করে বাংলাদেশ।

পরদিন অভিযোগ ওঠে কোচ সিনিয়র ফুটবলারদের পছন্দ করেন না এবং তাদের বাদ দিয়েই দল গঠন করেন। এরপর থেকেই দলে বিভাজন চূড়ান্ত রূপ নেয়। ভারতের বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচের আগে অভিজ্ঞরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। বাধ্য হয়ে কোচ একাদশে ফেরান মাসুরা ও মারিয়াকে। ফলও মেলে অসাধারণ পারফরম্যান্সে ভারতকে হারিয়ে গ্রুপসেরা হয় বাংলাদেশ। এরপর সেমিফাইনালে ভুটান ও ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জয় করে বাংলাদেশ।

দেশে ফিরে অভিজ্ঞ ফুটবলাররা একজোট হয়ে কোচের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৮ ফুটবলার তার অধীনে অনুশীলন না করার সিদ্ধান্ত নেন। কোচ তাদের বাদ দিয়ে নতুন দল গঠন করেন, যা আমিরাতে গিয়ে দুটি ম্যাচে বাজেভাবে হার মানে। সেই ব্যর্থতার পর মনে হয়েছিল, জটিলতা কাটবে। বাফুফে বিদ্রোহী ১৮ জনকে ক্যাম্পে ফেরাতে রাজি করায়। তবে ১০ জন ফুটবলার তখনই ভুটানের তিনটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়ে যান।

সেই ১০ জনের মধ্য থেকে এবার পাঁচজনকে ছেঁটে কোচ ফেলেছেন তাদের ফিটনেস বা পারফরম্যান্স সরাসরি না দেখেই। অথচ তিন দিন আগেই সাবিনা পারো এফসির হয়ে করেছেন ৯ গোল। গোল পেয়েছেন সুমাইয়া, মাসুরা ও কৃষ্ণাও। কিন্তু তাদের পারফরম্যান্সের গুরুত্ব দেননি বাটলার। বরং তাকে বিরোধিতা করায় প্রতিশোধ নিয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে, দেশে ফিরেই শনিবার মতিঝিলে বাফুফে ভবনে আবাসিক ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন ঋতুপর্ণা, মারিয়া, মনিকা, রূপনা ও শামসুন্নাহার জুনিয়র। রবিবার থেকে তারা অনুশীলন শুরু করবেন।

জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার প্রতিক্রিয়ায় সাবিনা, মাসুরা, কৃষ্ণাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা স্পষ্ট কিছু বলেননি। কেবল বলেছেন, ‘দলে কে খেলবে আর কে খেলবে না, সেটা কোচের সিদ্ধান্ত। তিনি হয়তো মনে করেছেন, আমাদের প্রয়োজন শেষ। তাই ডাকেননি। এ নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই।’

তবে কথাগুলো বলার সময় তাদের কষ্ট ছিল চোখেমুখে। শুধুমাত্র একগুঁয়ে এক কোচের কারণে, দেশের জন্য অনেক আনন্দের মুহূর্ত এনে দেওয়া এই ফুটবলারদের এমন পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। তবু তারা হাল ছাড়েননি। সময়ের ওপর ভরসা রেখেছেন। একজন বলেন, ‘খেলাটা ভাই, রক্তে মিশে গেছে। ফুটবল সহজে ছাড়ব না। জাতীয় দলে তো অনেক বছর খেলেছি। এখন খ্যাপ খেলেও টাকা কামাব। কিন্তু ফুটবল ছাড়ব না।’

সাবিনার বয়স পেরিয়েছে তিরিশ, তবুও এখনো দুর্দান্ত খেলছেন। আর বাকিদের বয়স ২২ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে তাদের বিদায় বলার সময় এখনো আসেনি। বাটলারের প্রতিশোধপরায়ণতা ও বাফুফের নির্লিপ্ততা হয়তো সাময়িকভাবে তাদের থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু থামিয়ে রাখা যাবে না। ছোটবেলা থেকে লড়াই করে উঠে আসা এই মেয়েরা নতুন করে আবার লড়বে। তারা একেকজন স্বপ্নছোঁয়া সোনার কন্যা। এবার লড়াইটা অস্তিত্ব রক্ষার এবং অবশ্যই বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত