সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

নির্বাচনের সময় বিচার সংস্কারে প্রাধান্য

আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ০৬:১৮ এএম

চার দিনের সরকারি সফরে লন্ডনে অবস্থান করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আজ শুক্রবার লন্ডনে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় শুক্রবার (১৩ জুন) সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে এ বৈঠক হতে পারে একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। এ বৈঠকেই নির্ধারিত হবে আগামীতে বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে সংঘাতের পরিস্থিতি থাকবে নাকি সমঝোতার পরিবেশ বিরাজ করবে।

বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা। যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বৈঠককে ‘রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট’ আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলছেন, অতীতের সংলাপ ও আলোচনার অভিজ্ঞতা খুব একটা আশাব্যঞ্জক না হলেও, এ বৈঠক একটি ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’। বিশেষত যখন দেশে নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার নিয়ে অস্থিরতা চূড়ান্ত পর্যায়ে। আর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এ বৈঠকে নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা নেই। উন্মুক্ত আলোচনা হবে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, জুলাই সনদসহ যেকোনো বিষয়ই আলোচনায় আসতে পারে।

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, আলোচনা বড় পরিসরেই হবে, যেখানে নির্বাচনের সময়সূচি আগানো, বিচার-সংস্কার এজেন্ডা, জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপির অবস্থান, আওয়ামী লীগের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত, এনসিপির ভবিষ্যৎ, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সম্মানসহ প্রস্থান, তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের মতো বিষয়গুলো থাকবে।

বিএনপি মনে করছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। যেসব বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তার অনেক কিছুই আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে। যদিও এটি নির্ভর করবে দুজনের মধ্যে সত্যিই কী আলোচনা হয় এবং তারা পরস্পরের ওপর কতটুকু আস্থা, বিশ্বাস ও সম্মান বজায় রাখতে পারেন, তার ওপর।

জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান দল হওয়া সত্ত্বেও এবং মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে তাদের সক্রিয় ভয়ূমিকা ও সমর্থনের পরেও সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটি এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে বিএনপিরও যে খুব একটা লাভ হবে না, সেটিও আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।

জানা গেছে, ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের আলোচনার মূল বিষয় হবে নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন বলার পর এখন বলছেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। কিন্তু এটা বিএনপি মানছে না। কারণ তারা মনে করছে, এপ্রিল মাস ভোটের জন্য উপযোগী নয়। এ কারণে তারেক রহমান হয়তো জাতীয় নির্বাচন আরেকটু এগিয়ে আনার পরামর্শ দেবেন। তারেক রহমানের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে সরকারের চলমান সংস্কার নিয়ে আলাপ হবে। বিএনপি বরাবরই তাদের যে ৩১ দফার কথা বলছে, প্রধান উপদেষ্টাকে তারেক রহমান সেটি স্মরণ করিয়ে দেবেন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির আলোচনার বিষয়টিও তুলে ধরবেন।

সংস্কার ইস্যুতে সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবে বিএনপি। দলটি এটাও পরিষ্কার করবে বিএনপি সরকারের সংস্কার কর্মসূচিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। যদি বিএনপি সহযোগিতা অব্যাহত না রাখে তাহলে এ সরকারের পক্ষে সংস্কার কার্যক্রম সফল করা সম্ভব হবে না। আলোচনা তুলে প্রধান উপদেষ্টাকে সেটি স্মরণ করিয়ে দেবেন তারেক রহমান। ‘জুলাই সনদের’ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করার পাশাপাশি বিষয়টি ‘ক্রিটিক্যাল’ না করার বিষয়ে বিএনপি তাদের অবস্থান তুলে ধরবে। এ ইস্যুতে বড় জটিলতা এড়াতে কী করণীয়, তা তুলে ধরবে বিএনপি, যাতে জুলাই সনদ তৈরি করা যায়, পাশাপাশি রাজনৈতিক ঐকমত্যের পথে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়। তারেক রহমানের মনোভাবও আলোচনায় পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে।

এনসিপির প্রতি সরকারের সমর্থনের বিষয়টি কমবেশি সবার জানা। বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনের পর সরকার গঠনের সুযোগ পায়, তাহলে সেখানে এনসিপির অংশ কী হবে, অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে তাদের আসন সমঝোতা হবে নাকি অন্যান্য দলের মতো এনসিপিরও স্বতন্ত্রভাবে এগিয়ে যাবে, সে বিষয়টি হয়তো প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় উঠে আসতে পারে।

পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জোর দেবেন তারেক রহমান। সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিষয়ে কী করণীয়। এরই মধ্যে দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে, বিশেষ করে আগামী নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ যাতে কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য আওয়ামী লীগকে মোকাবিলার কৌশল কী হবে, তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করবেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা।

নির্বাচনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্মানজনক বিদায়, তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টিও দুই পক্ষ পরিষ্কার করার চেষ্টা করবে বলে জানা গেছে। সরকার আগামী এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে চাইলে তার আগেই একটা ‘সেফ এক্সিট প্ল্যান’ লাগবে। আলোচনায় এটিও উঠে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। অনেকেই মনে করেছিলেন, ৫ আগস্টের পর তারেক রহমান দ্রুতই দেশে ফিরবেন। তার আইনজীবীরা একাধিকবার বলেছেন, তার দেশে ফেরার পথে আর কোনো আইনি বাধা নেই। ফলে এ আলোচনায় তার দেশে ফেরার সম্ভাব্য সময়সীমা ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়েও কথা হতে পারে।

২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময় কারামুক্ত হয়ে সপরিবারে লন্ডনে চলে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের সময়ে তার অনুপস্থিতিতে পাঁচ মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়। দায়ের করা হয় শতাধিক মামলা। আদালতের চোখে তিনি হয়ে যান ‘পলাতক আসামি’। এমনকি তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা আসে। এর মধ্যে পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারেককে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু আর মায়ের কারাগারে যাওয়ার মতো দুঃসময়েও তার দেশে ফেরা হয়নি। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। যেসব মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল, একে একে তার সবটিতেই খালাস পান খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। মুক্ত খালেদা জিয়া এ বছরই চিকিৎসার জন্য লন্ডন ঘুরে এসেছেন। সেখানে ছেলের বাসাতেই তিনি ছিলেন। তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানও ১৭ বছর পর গত মে মাসে ঢাকা ঘুরে যান। দেশে না থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তিনিই দল চালাচ্ছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিয়মিত বৈঠক করছেন।

গত কয়েক মাসে ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। এরই মধ্যে ঈদুল আজহার আগের দিন গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন। প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর ওই রাতেই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সরকারের এ ঘোষণার কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সেখানে দলটির পক্ষ থেকে এপ্রিলে নির্বাচনের বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

এমন অবস্থায় ঈদের দিন গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় গিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বিএনপির সূত্রমতে, শুভেচ্ছা বিনিময়ের একপর্যায়ে সরকার ঘোষিত নির্বাচনের নতুন রোডম্যাপের বিষয়টি উঠে আসে। তখন খালেদা জিয়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সরাসরি কোনো ধরনের বিরোধে না জড়ানোর পরামর্শ দেন। নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গেলে বিএনপির কোনো লাভ নেই। তাই বিরোধ নয়, সংকট সমাধানে আলোচনাই শ্রেয়। তার পরামর্শ অনুযায়ীই, সে পথেই হাঁটতে হবে। বেগম জিয়ার ওই পরামর্শে বদলে যায় বিএনপির রাজনীতির দৃশ্যপট। ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবিতে দলীয় কঠোর অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় হয়ে বিএনপি এখন যৌক্তিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানের পথে এগোতে চাচ্ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এ বৈঠকের মাধ্যমে যদি একটি যৌক্তিক সমঝোতা তৈরি হয়, তবে তা শুধু আগামী নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণেই নয়, দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনের দিকেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এখন দেখার বিষয়, লন্ডনের এ আলোচনা কতটা কার্যকর হয় এবং বাংলাদেশ কোন পথে অগ্রসর হয়।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত