ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে তেহরানে হামলার ঝুঁকি বাড়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। দূতাবাস কর্মকর্তাদের পাশাপাশি শতাধিক বাংলাদেশিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতকাল মঙ্গলবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘চ্যান্সারি ভবন ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে হামলার আশঙ্কা ছিল। তাই সোমবার রাতে রাষ্ট্রদূত নিজ বাসভবন ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। দূতাবাসের অন্য কর্মকর্তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।’
তিনি আরও জানান, দূতাবাসে অবস্থানরত এবং যোগাযোগকারী প্রায় ১০০ বাংলাদেশিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এজন্য একটি বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেল কার্যকর না থাকায় অর্থ পাঠানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। তবু বিকল্প পথে অর্থ পাঠানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান সচিব।
তেহরান থেকে বাইরে কোথায় গেলে নিরাপদে থাকা যাবে, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বর্তমানে বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে এবং স্থলপথও নিরাপদ নয়। তাই প্রবাসীদের তেহরান ত্যাগ না করে আপাতত নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
সচিব আরও জানান, এতসংখ্যক প্রবাসীকে একই জায়গায় স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। তাই তাদের বিভিন্ন স্থানে ভাগ করে সরিয়ে নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় সময় লাগবে বলেও জানান তিনি। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নাগরিকদের তেহরান থেকে সরিয়ে ইরানের ভেতরেই নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করেছে দেশটির কর্র্তৃপক্ষ।
ভারতে ব্যাংকিং চ্যানেলের সুবিধা থাকায় তারা এ কাজ সহজে করতে পেরেছে। পাকিস্তানের নাগরিকরাও ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে নিজ দেশে ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন।
দূতাবাসের কর্মযজ্ঞ নিয়ে রুহুল আলম বলেন, ‘দূতাবাস যুদ্ধাবস্থায়ও সেবামূলক কাজ করছে। বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চালু করা হয়েছে। দূতাবাস প্রতিনিয়ত যুদ্ধের আপডেট জানাচ্ছে। পাশাপাশি অন্য দেশ কীভাবে তাদের নাগরিকদের নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছে, সেসব আপডেট নিয়মিত আমাদের জানাচ্ছে।’
সব মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক বর্তমানে ইরানে অবস্থান করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত, দুজন কর্মকর্তা, পাঁচজন কর্মচারী এবং তাদের পরিবারসহ প্রায় ৪০ জন রয়েছেন। রেডিও তেহরানে আটজন বাংলাদেশি ও তাদের পরিবারসহ রয়েছেন ২৭ জন। তেহরানে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় ১০ থেকে ১২ জন। পেশাজীবী আছেন প্রায় ১০ জন। এ ছাড়া, ২৮ জন বাংলাদেশির গত ১৩ জুন দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আটকা পড়েছেন। সব মিলিয়ে তেহরানে ৪০০ বাংলাদেশি রয়েছেন।
ইরানের অন্যান্য জায়গায় প্রায় ৬০০ বাংলাদেশি আছেন, তারা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সে দেশে বসবাস করছেন। সেখানে বিয়ে করে তারা স্থায়ী হয়েছেন। এর বাইরে আরও প্রায় ৮০০ বাংলাদেশি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে ইরানে অবস্থান করে বিভিন্ন সেক্টরে চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। প্রায় ২০০-এর মতো শিক্ষার্থী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। এ ছাড়া মানব পাচারের ট্রানজিট দেশ হিসেবে ইরানে সবসময় ৩০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি অবস্থান করেন অন্য দেশে পাচার হওয়ার অপেক্ষায়।
এ প্রসঙ্গে রুহুল আলম জানান, ইরানে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি আছেন। এদের মধ্যে বড়সংখ্যক বাংলাদেশি ইরানি মেয়েদের বিয়ে করে ওইখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আরেক দল বাংলাদেশি ওখানকার সমুদ্র অঞ্চলে মাছ ধরাসহ ছোটখাটো কাজ করে। তাদের মধ্যে অনেকের বৈধ কাগজপত্র নেই। কিছু বাংলাদেশি ইরানের ডিটেনশন সেন্টারে আছে। এর বাইরে কিছু বাংলাদেশি আছেন পেশাজীবী, যারা গণমাধ্যম ও চিকিৎসাসেবা খাতে কাজ করছেন। আরও কিছু বাংলাদেশি আছেন, যারা ওখানে ভ্রমণে রয়েছেন। কিছু শিক্ষার্থী আছেন।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ খুব সহসা বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘যুদ্ধের পরিণতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে, সেটা আমরা জানি। আমরা ইউক্রেন যুদ্ধ দেখেছি। সেটি দীর্ঘায়িত হওয়ায় আমরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, সবাই বুঝতে পারছি। মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিকভাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই যুদ্ধ আমাদের জন্য বাড়তি ক্ষতির শঙ্কা তৈরি হরেছে।’
ক্ষতির সম্ভাব্য দিকগুলো তুলে ধরেন রুহুল আলম। তিনি বলেন, ‘যারা ওখানে প্রবাসী ছিলেন, তারা কর্ম হারাবেন। যুদ্ধ বন্ধ হলেও পরবর্তী সময়ে যে অবস্থা তৈরি হবে, তাদের সেখানে থাকাটা কতটুকু সম্ভব হবে, সেটাও বিশেষ বিবেচনার বিষয়। তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখতে পাচ্ছি বা বুঝতে পারছি, খুব সহজে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সিগন্যাল বা সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। তবে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সংঘাত বন্ধ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। তা না হলে যুদ্ধের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।’
তেহরানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা বেশি ঝুঁকিতে থাকায় প্রথম দফায় সরকার তাদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়া আপাতত তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে থাকা অর্থ দিয়ে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘অর্থ পাঠানো কষ্টসাধ্য। তবে স্থানান্তরের জন্য যে অর্থ লাগবে আমরা পাঠানোর চেষ্টা করছি।’
অর্থ পাঠানোর চ্যালেঞ্জের সমাধান নিয়ে রুহুল আলম জানান, ‘আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অতিরিক্ত টাকা পাঠাব। এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা যতটা সম্ভব বন্ধুরাষ্ট্রগুলো থেকে সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছি। ইরানের কাছ থেকেও আমরা সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের যতগুলো চ্যানেল বা মেকানিজম খোলা আছে, সবগুলোয় চেষ্টা করছি। তবে মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কোনো কিছু মসৃণভাবে হয় না।’