যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইরান। বিশ্ব জুড়ে তেল-গ্যাস সরবরাহের জন্য এই নৌরুটটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে জ্বালানির বাজার। যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এরই মধ্যে ইরানের হুমকির পর তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে বিশ্ববাজারে। গতকাল সোমবার অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮১ দশমিক ৪০ ডলারে পৌঁছায়, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে দাম ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট গবেষণা সংস্থাগুলো।
ইরান ও ওমানের মধ্যে অবস্থিত একটা চ্যানেল বা খাল হলো হরমুজ প্রণালি। এর প্রবেশ এবং প্রস্থানপথ প্রায় ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত। মধ্যবর্তী স্থানে এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ প্রায় ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত যেখান দিয়ে পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও এলপিজি পারাপার হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা অনেকটা পারমাণবিক অস্ত্র রাখার মতোই। একে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি বন্ধ হলে আরও গুরুতর প্রভাব হিসেবে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রেস টিভি জানিয়েছে, দেশটির পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। এদিকে ইরানের ওই সিদ্ধান্তের পর প্রণালিটি খোলা রাখতে চীনকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর হরমুজ প্রণালি থেকে দুই তেল পরিবহনের জাহাজ ফিরে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে জাহাজগুলোর হরমুজ প্রণালি এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট জ্বালানির বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সেই প্রস্তুতিতে খুব একটা লাভ হবে না।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি চুক্তির আওতায় বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি আমদানি করা হয়ে থাকে। যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানের গ্লোবালি (বিশ^ব্যাপী) ব্যবসা রয়েছে। তাই কোনো সমস্যা হলে সিঙ্গাপুর, জাপান কিংবা অন্য কোনো দেশ থেকে জ্বালানি সরবরাহ করবে। সুতরাং আপাতত কোনো সমস্যা হবে না। তবে যুদ্ধ যদি তিন মাসের বেশি সময় চলে তাহলে তখন সমস্যা হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে জ্বালানির দাম ৪ ডলার বেড়ে গেছে। এ বাড়তি ব্যয় আমাদের বহন করতে হবে। এ ছাড়া হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে জ্বালানি আমদানি করা হবে বিকল্প উপায়ে। তবে দেশের বাজারে আপাতত জ্বালানির দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
তেল আমদানিতে ব্যয় বাড়বে : পরিশোধিত ও অপরিশোধিত এ দুই ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় দেশে। তবে একমাত্র জ্বালানি পরিশোধনাগারের সক্ষমতা অনুযায়ী বছরে ১৫ লাখ টনের বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানির সুযোগ নেই। অপরিশোধিত হিসেবে সৌদি আরব থেকে অ্যারাবিয়ান লাইট ও আরব আমিরাত থেকে মারবান লাইট আমদানি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
বাংলাদেশ বেশি আমদানি করে ডিজেল, ফার্নেস, অকটেন, জেট ফুয়েলের মতো পরিশোধিত জ্বালানি তেল। এগুলো আসে মূলত সিঙ্গাপুর ও তার আশপাশের কয়েকটি দেশ থেকে। বছরে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল। দেশের একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া যায় ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে বিপিসির।
দেশের জ্বালানি তেল আমদানির একমাত্র সরকারি সংস্থাটি বলছে, পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ৩০ শতাংশ পরিবহন করা হয় হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে। যদিও আবুধাবি থেকে ভিন্নপথে জাহাজ আসার সুযোগ আছে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিকল্প পথে তেল আনলে খরচ আরও বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের বিকল্প উৎস হিসেবে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। হরমুজ প্রণালি এড়িয়ে লোহিত, এডেন ও আরব সাগর হয়ে বাংলাদেশকে তেল সরবরাহ করতে পারবে সৌদি আরব।
এখন পর্যন্ত তেলের মজুদ ও সরবরাহ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে বিপিসির একজন কর্মকর্তা। তবে যুদ্ধ চলমান থাকলে আমদানি খরচ বাড়তে পারে। আর হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করা হতে পারে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও ভোক্তা পর্যায়ে পুরোটা না চাপিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করা হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরিশোধিত তেল আমদানির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। তবে হরমুজ প্রণালির শেষপ্রান্তে দুবাইয়ের ফুজাইরা নামে একটি বন্দর রয়েছে। এ বন্দর দিয়ে হলেও তেল সরবরাহ স্বাভাবিক থাকতে পারে। অন্যদিকে পরিশোধিত তেল যেহেতু সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে, তাই তেমন সংকট হবে না বলে মনে করছি।’ বর্তমানে দেশে তেলের মজুদ সম্পর্কে তিনি বলেন, সোমবার (গতকাল) পর্যন্ত দেশে ৩ লাখ ৭২ হাজার ডিজেল মজুদ রয়েছে, যা চাহিদার ৩২ দিন পূরণ করবে। এ ছাড়া ১২ দিনের অকটেন (১২ হাজার ৮০০ টন), ১৩ দিনের পেট্রোল (১৬ হাজার ৬০০ টন), ৩১ দিনে জেট ফুয়েল (৫১ হাজার টন) ও ২৯ দিনের ফার্নেস অয়েল (৫১ হাজার টন) মজুদ রয়েছে।
২০১৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর দেশে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা। ২০২১ সালের নভেম্বরে দাম বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। একই সময়ে পেট্রোল ৮৬ ও অকটেন বিক্রি হয়েছে ৮৯ টাকায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের আগস্টে একলাফে দেশে ডিজেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১৪ টাকা। সমালোচনার মুখে ২৫ দিনের মাথায় দাম ৫ টাকা কমানো হয়। ওই সময় পেট্রোল ১২৫ ও অকটেন ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
তবে গত বছর মার্চ থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হয়। জুনে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১০২ টাকায়। আর পেট্রোল ১১৮ ও অকটেন ১২২ টাকায়।
গ্যাস সংকটের আশঙ্কা : দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর ভরসা বাড়ছে। বর্তমানে বিদ্যমান গ্যাসের চাহিদার ৩০ শতাংশের বেশি পূরণ করছে এলএনজি। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে এলএনজি আমদানি ব্যাহত হতে পারে। এটি হলে দেশে গ্যাসের সংকট বেড়ে যাবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রমতে, প্রস্তাবিত বাজেটে এলএনজির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করায় বাড়তি এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চলতি বছর মোট ১১৫টি এলএনজি কার্গো জাহাজ আনার অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। তবে আবহাওয়া ও টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ বিবেচনায় ১০৯টি জাহাজ আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে ৫৬টি এলএনজি কার্গো আসার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি জাহাজ এসেছে। বছরের বাকি সময়ে ৩৩টি জাহাজ আসার কথা।
কিন্তু ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে দাম বেশি বেড়ে গেলে কিছুটা কমতে পারে এলএনজি আমদানি। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে আবুধাবি হয়ে বিকল্প পথে জাহাজ আনার ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়লে ওমান ও কাতার থেকে এলএনজি আসাটা কঠিন হয়ে যাবে। তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে আনার চিন্তা করা হচ্ছে। বাহরাইনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সংঘাতের কারণে বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকলে চড়া দামে এলএনজি কিনতে হতে পারে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে জুন ও জুলাই পর্যন্ত ২০ কার্গো এলএনজি আমদানির চুক্তি আগেই করা হয়েছে। সুতরাং ওই সময় পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। এরপর স্পট মার্কেটে কিংবা তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এলএনজির দাম বাড়লে তখন ব্যয় বেড়ে যাবে।
এলপিজিতেও শঙ্কা : প্রাকৃতিক গ্যাস সংকটের কারণে দেশের বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে আবাসিকে দিনে দিনে (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহার বাড়ছে। সরবরাহকৃত প্রায় ৯৯ শতাংশ এলপিজি বিদেশ থেকে আমদানি করে বিক্রি করে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত এই এলপিজি মজুদ করার সক্ষমতা রয়েছে। ফলে আপাতত কোনো সমস্যা না হলেও যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কিংবা হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এরপর সংকট বাড়বে এলপিজি সরবরাহেও। সেই সঙ্গে দামও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, ইরাক, আরব আমিরাত, কাতার ও ওমান থেকে আমাদের এলপিজিবাহী জাহাজগুলো হরমুজ প্রণালি হয়ে এসে থাকে। তাই হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এলপিজি সরবরাহে বিশাল সংকট দেখা দেবে।
হরমুজ প্রণালি বন্ধে বিশ্বে প্রভাব : যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) অনুমান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল এ প্রণালি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতি বছর সমুদ্রপথে পরিবহন করা প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের জ্বালানি বাণিজ্যের সমতুল্য এটি।
এ প্রণালি ব্যবহার করে যে দেশগুলো অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হলো চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। গুরুত্বপূর্ণ এ জলপথ দিয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ভোক্তা দক্ষিণ এশিয়া।
ইআইএ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন এ প্রণালি ব্যবহার করে প্রায় সাত লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেল আমদানি করে, যা তাদের মোট তেল আমদানির প্রায় ১১ শতাংশ এবং পেট্রোল ব্যবহারের তিন শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের সাবেক প্রধান স্যার অ্যালেক্স ইয়োঙ্গার বিবিসিকে বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যা হতে পারে তা হলো ওই চ্যানেল অবরোধ করা। প্রণালি বন্ধ করা স্পষ্টতই একটা অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এর প্রভাব পড়বে তেলের দামের ওপর।