লঞ্চ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন
মো. মজিবুল হক মনির | ১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০
পৃথিবীর যেকোনো অভিধানে দুর্ঘটনা শব্দটির মানে খুঁজতে গেলে এর অর্থের সঙ্গে কয়েকটি শব্দের আবশ্যক সম্পর্ক মেলে, যেমন অনিচ্ছাকৃতভাবে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অপরিকল্পিতভাবে ঘটে যায় এমন কিছু ঘটনা, যার ওপর আসলে কারও কিছু করার থাকে না এমন কিছুকেই সাধারণ দুর্ঘটনা বলা হয়। কিন্তু দেশের নৌ-দুর্ঘটনাগুলোর ধরন, কারণ বিশ্লেষণ করলে কী দেখা যায়? সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্বন্ধে যেসব তথ্য পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, ময়ূর ২ বা মর্নিং বার্ড কোনোটাই অনুমোদিত কোনো চালক চালাচ্ছিলেন না! আইন অনুযায়ী মর্নিং বার্ড লঞ্চটির দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার ও ড্রাইভার থাকার কথা, কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই সেই মাস্টার বা চালক! ফলে যিনি লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন, তার যে দক্ষতার ঘাটতি ছিল, সেটাও উঠে এসেছে পত্রপত্রিকায়। মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসার পথেও এই লঞ্চ ধাক্কা দেয় বালুবাহী এক জাহাজে।
নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন জোটের ২০০৬ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যত উল্লেখযোগ্য নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৭০ ভাগই ঘটেছে ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে। লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ড্রাফট (ড্রাফট হলো নৌযানের পাটাতন থেকে নিচের দিকের গভীরতা, যা নৌযানের ভারসাম্য বজায় রাখে) ও উচ্চতা এই চারটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে আনুপাতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পৃক্ত। যখন কোনো লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খেয়ালখুশিমতো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ানো হয়, তখনই লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। জানা যায়, আন্তর্জাতিক আইন মেনে লঞ্চ নির্মাণ করলে লঞ্চ ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত কাত হলেও তাতে পানি ওঠার কথা নয়, কিন্তু আমাদের দেশের লঞ্চগুলো ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি কাত হয়ে গেলেই পানি উঠে যায়। ২০১৪ সালে পটুয়াখালীতে এমভি শাথিল-১ নামের যে লঞ্চটি ডুবে যায়, তাতে কারিগরি ও কাঠামোগত ত্রুটি ছিল। এর আগেও এই একই লঞ্চ একবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। জানা যায়, যে নকশায় লঞ্চটি তৈরি, সে রকম নকশার লঞ্চ ২০০৬ সালের পর থেকে চলাচলের উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে না। অর্থাৎ দেশের বেশির ভাগ লঞ্চই নির্মিত হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ নকশায়। অথচ এই ভুল নকশা যারা প্রণয়ন, অনুমোদন করেন এবং যারা এই নকশা অনুসরণ করে অথবা ভুল নকশায় লঞ্চ নির্মাণ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। দুর্ঘটনার তদন্তে প্রায়ই উঠে আসে মালিক-চালক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা-গাফিলতির কথা। কিছু কিছু মামলাও হয়, কিন্তু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বললেই চলে। ১৯৭৬ সালের আইনে দোষী মালিকের বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের জেল, এক লাখ টাকা জরিমানা ও পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালিকরা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছেন। দুর্ঘটনার সঙ্গে মালিকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা জরুরি।
লঞ্চ দুর্ঘটনার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে চালকের গাফিলতি, অদক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অধিকাংশ লঞ্চে কোনো দক্ষ চালক নেই। লঞ্চমাস্টারদের অদক্ষতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পাশাপাশি তারা কর্তব্যেও অবহেলা করে থাকে এবং নৌ-ট্রাফিক ব্যবস্থা মানে না। যেসব মাস্টার বিভিন্ন ধরনের নৌযান পরিচালনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তাদের আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো জ্ঞান নেই, কোন সময় কোন দিক দিয়ে গেলে ভালো হবে, তা তারা জানেন না, নৌযান চলাচলের সংকেত সম্বন্ধে তাদের স্পষ্ট এবং সঠিক ধারণা নেই, নদী ও মোহনার বিভিন্ন পয়েন্টে স্রোত ও ঘূর্ণির তীব্রতা, গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত ধারণার অভাব রয়েছে। তা ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় এবং কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, তা তাদের অনেকের জানা নেই, যারা জানেন তারাও আবার নানা কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন না। এ ছাড়া নৌ-নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে মাস্টার-ড্রাইভারদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মাস্টারদের যারা পরীক্ষা নেন, পরীক্ষক বোর্ডের ওপরও এই দায়িত্ব বর্তায়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় এসব অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান যাচাই করা হয় না বলেই লঞ্চ দুর্ঘটনা কমছে না।
আমাদের নৌপথকে নিরাপদ রাখতে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় কিন্তু তার বাস্তবায়ন তেমন একটা দেখা যায় না। বলা হয়েছিল জরিপকারীর সংখ্যা বাড়িয়ে ২১ জন করা হবে, ২০ উপপরিচালককে পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে, নৌযানের নকশাগুলো বুয়েট থেকে পরীক্ষা করা হবে। বাস্তবে এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়।
প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মনে হয় যেন তদন্ত কমিটি গঠন করার মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়। কারণ স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন। অনেক তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমাও দেয় না বলে জানা যায়! জমা হওয়া প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের চিত্রও হতাশাজনক। তদন্ত কমিটিগুলোতে বিশেষজ্ঞ না রাখায় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারাই এটি পরিচালিত হয় বলে প্রকৃত দোষীরা, বিশেষ করে দোষী কর্মকর্তারা পার পেয়ে যান। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, তদন্ত কমিটি হতে হবে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি বা অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতির নেতৃত্বে। সেখানে বিশেষজ্ঞ থাকবেন, থাকবেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিনিধিও। সব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও প্রকাশ করতে হবে।
দেশের নদীপথ এবং নৌযানগুলোর তদারকির জন্য তথা নৌপথ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তিনটি পৃথক সংস্থা রয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিদ্যমান তিনটি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর নৌ-চলাচল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি সংস্থা মোটামুটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে বারবার একই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা কমে যেত। এই তিনটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও সংস্থা তিনটির দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করে দেওয়া আছে, তবু জাহাজের নকশা প্রণয়ন এবং নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। অনাকাক্সিক্ষত প্রাণহানির কারণগুলো আসলে চিহ্নিত, তাই শত মানুষের স্বজন হারানোর কান্নার অবসানে প্রয়োজন সেই কারণগুলোর বিষয়ে কঠোর-কঠিন-আন্তরিক উদ্যোগ।
লেখক : বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের যুগ্ম পরিচালক
শেয়ার করুন
মো. মজিবুল হক মনির | ১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০

পৃথিবীর যেকোনো অভিধানে দুর্ঘটনা শব্দটির মানে খুঁজতে গেলে এর অর্থের সঙ্গে কয়েকটি শব্দের আবশ্যক সম্পর্ক মেলে, যেমন অনিচ্ছাকৃতভাবে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অপরিকল্পিতভাবে ঘটে যায় এমন কিছু ঘটনা, যার ওপর আসলে কারও কিছু করার থাকে না এমন কিছুকেই সাধারণ দুর্ঘটনা বলা হয়। কিন্তু দেশের নৌ-দুর্ঘটনাগুলোর ধরন, কারণ বিশ্লেষণ করলে কী দেখা যায়? সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্বন্ধে যেসব তথ্য পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, ময়ূর ২ বা মর্নিং বার্ড কোনোটাই অনুমোদিত কোনো চালক চালাচ্ছিলেন না! আইন অনুযায়ী মর্নিং বার্ড লঞ্চটির দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার ও ড্রাইভার থাকার কথা, কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই সেই মাস্টার বা চালক! ফলে যিনি লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন, তার যে দক্ষতার ঘাটতি ছিল, সেটাও উঠে এসেছে পত্রপত্রিকায়। মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসার পথেও এই লঞ্চ ধাক্কা দেয় বালুবাহী এক জাহাজে।
নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন জোটের ২০০৬ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যত উল্লেখযোগ্য নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৭০ ভাগই ঘটেছে ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে। লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ড্রাফট (ড্রাফট হলো নৌযানের পাটাতন থেকে নিচের দিকের গভীরতা, যা নৌযানের ভারসাম্য বজায় রাখে) ও উচ্চতা এই চারটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে আনুপাতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পৃক্ত। যখন কোনো লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খেয়ালখুশিমতো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ানো হয়, তখনই লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। জানা যায়, আন্তর্জাতিক আইন মেনে লঞ্চ নির্মাণ করলে লঞ্চ ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত কাত হলেও তাতে পানি ওঠার কথা নয়, কিন্তু আমাদের দেশের লঞ্চগুলো ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি কাত হয়ে গেলেই পানি উঠে যায়। ২০১৪ সালে পটুয়াখালীতে এমভি শাথিল-১ নামের যে লঞ্চটি ডুবে যায়, তাতে কারিগরি ও কাঠামোগত ত্রুটি ছিল। এর আগেও এই একই লঞ্চ একবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। জানা যায়, যে নকশায় লঞ্চটি তৈরি, সে রকম নকশার লঞ্চ ২০০৬ সালের পর থেকে চলাচলের উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে না। অর্থাৎ দেশের বেশির ভাগ লঞ্চই নির্মিত হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ নকশায়। অথচ এই ভুল নকশা যারা প্রণয়ন, অনুমোদন করেন এবং যারা এই নকশা অনুসরণ করে অথবা ভুল নকশায় লঞ্চ নির্মাণ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। দুর্ঘটনার তদন্তে প্রায়ই উঠে আসে মালিক-চালক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা-গাফিলতির কথা। কিছু কিছু মামলাও হয়, কিন্তু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বললেই চলে। ১৯৭৬ সালের আইনে দোষী মালিকের বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের জেল, এক লাখ টাকা জরিমানা ও পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালিকরা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছেন। দুর্ঘটনার সঙ্গে মালিকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা জরুরি।
লঞ্চ দুর্ঘটনার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে চালকের গাফিলতি, অদক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অধিকাংশ লঞ্চে কোনো দক্ষ চালক নেই। লঞ্চমাস্টারদের অদক্ষতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পাশাপাশি তারা কর্তব্যেও অবহেলা করে থাকে এবং নৌ-ট্রাফিক ব্যবস্থা মানে না। যেসব মাস্টার বিভিন্ন ধরনের নৌযান পরিচালনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তাদের আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো জ্ঞান নেই, কোন সময় কোন দিক দিয়ে গেলে ভালো হবে, তা তারা জানেন না, নৌযান চলাচলের সংকেত সম্বন্ধে তাদের স্পষ্ট এবং সঠিক ধারণা নেই, নদী ও মোহনার বিভিন্ন পয়েন্টে স্রোত ও ঘূর্ণির তীব্রতা, গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত ধারণার অভাব রয়েছে। তা ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় এবং কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, তা তাদের অনেকের জানা নেই, যারা জানেন তারাও আবার নানা কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন না। এ ছাড়া নৌ-নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে মাস্টার-ড্রাইভারদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মাস্টারদের যারা পরীক্ষা নেন, পরীক্ষক বোর্ডের ওপরও এই দায়িত্ব বর্তায়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় এসব অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান যাচাই করা হয় না বলেই লঞ্চ দুর্ঘটনা কমছে না।
আমাদের নৌপথকে নিরাপদ রাখতে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় কিন্তু তার বাস্তবায়ন তেমন একটা দেখা যায় না। বলা হয়েছিল জরিপকারীর সংখ্যা বাড়িয়ে ২১ জন করা হবে, ২০ উপপরিচালককে পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে, নৌযানের নকশাগুলো বুয়েট থেকে পরীক্ষা করা হবে। বাস্তবে এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়।
প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মনে হয় যেন তদন্ত কমিটি গঠন করার মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়। কারণ স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন। অনেক তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমাও দেয় না বলে জানা যায়! জমা হওয়া প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের চিত্রও হতাশাজনক। তদন্ত কমিটিগুলোতে বিশেষজ্ঞ না রাখায় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারাই এটি পরিচালিত হয় বলে প্রকৃত দোষীরা, বিশেষ করে দোষী কর্মকর্তারা পার পেয়ে যান। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, তদন্ত কমিটি হতে হবে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি বা অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতির নেতৃত্বে। সেখানে বিশেষজ্ঞ থাকবেন, থাকবেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিনিধিও। সব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও প্রকাশ করতে হবে।
দেশের নদীপথ এবং নৌযানগুলোর তদারকির জন্য তথা নৌপথ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তিনটি পৃথক সংস্থা রয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিদ্যমান তিনটি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর নৌ-চলাচল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি সংস্থা মোটামুটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে বারবার একই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা কমে যেত। এই তিনটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও সংস্থা তিনটির দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করে দেওয়া আছে, তবু জাহাজের নকশা প্রণয়ন এবং নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। অনাকাক্সিক্ষত প্রাণহানির কারণগুলো আসলে চিহ্নিত, তাই শত মানুষের স্বজন হারানোর কান্নার অবসানে প্রয়োজন সেই কারণগুলোর বিষয়ে কঠোর-কঠিন-আন্তরিক উদ্যোগ।
লেখক : বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের যুগ্ম পরিচালক