
রাজধানী ঢাকায় ছোট্ট একটি কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান চালান জালাল। মাসে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে তার চার সদস্যের পরিবার। দোকানে শিক্ষার্থীদের খাতা-কলম আর কাগজও বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু মাস দু-এক ধরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই তার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে কাগজের বাজারে অস্থিরতাই এর প্রধান কারণ। কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়েও নিয়মিত মিলছে না প্রিন্ট ও ফটোকপির কাগজ। বেশি টাকায় কাগজ মিললেও কাস্টমার বাড়তি টাকায় প্রিন্ট ও ফটোকপি করতে নারাজ। এ নিয়ে নিয়মিত চলছে বচসা। তার ভাষায়, ‘কাস্টমার সাফ বলে দেয়আপনারা তো ডাকাত। সরকার তো কাগজের দাম বাড়ায়নি। আপনি কেন বেশি নেবেন? আমরা কীভাবে বোঝাব যে সরকার তো কাগজের বাজারটা নিয়ন্ত্রণও করছে না।’
জালাল বলছিলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ার কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতার বিক্রিও কমেছে কয়েক গুণ। কাগজের প্যাকেট, কার্টুনসহ কাগজসংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও অনেক। এভাবে কাগজের দাম বাড়লে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। শিক্ষার্থী আছে এমন পরিবারগুলোকেও গুনতে হবে খরচের বাড়তি টাকা। এর প্রভাব পড়বে সরকারের ওপরও। তাই কাগজের দামের লাগাম টানতে সরকারকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ওপরও যে এর প্রভাব পড়ছে তা উঠে আসে ঢাকার কাফরুল এলাকার এ ব্যবসায়ীর ভাষ্যে। কয়েক মাস পরেই বইমেলা আর জানুয়ারি মাসে নতুন বই লাগে স্কুল-কলেজে। ঠিক তখনই কাগজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহেও টান পড়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ সুযোগে হু-হু করে বাড়ছে কাগজের দাম। পাইকারিতে কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে।
হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। এ কাগজের দাম গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাটের কাগজ, আর্ট কার্ড ও রঙিন কাগজের দামও। কিন্তু কাগজের এ দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের তদারকি, কোনো উদ্যোগ কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির বক্তব্যও আমরা পাইনি।
বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা।
তবে বই পাওয়া বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জোর আশ্বাস দিলেও বই ছাপার কাজ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে নতুন বছরের প্রথম দিন প্রাথমিকের সব পাঠ্যবই পাওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। কাগজের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি শিক্ষা ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কাজকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। প্রতিটি পরিবারের শিক্ষার খরচও তখন বেড়ে যায়, যা চলছে বর্তমানে।
কিন্তু কেন কাগজের এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি? গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, কাগজের কাঁচামালের সংকট রয়েছে। বিদ্যুতের সংকটের কথাও তুলে ধরছেন ব্যবসায়ীরা। ব্রাইটনেস কাগজের জন্য লাগে ভার্জিন পাল্প। চাহিদা থাকলেও যেটা পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি হয়নি। ডলার সংকটের কারণে এখন আমদানিও করা যাচ্ছে না। পাল্পের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় কাগজকল মালিকরা তা আমদানিও করছেন না। ফলে কাগজের চাহিদার এই সময়ে সংকট তৈরি হচ্ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে কাগজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবে প্রকাশনা শিল্প। এমনটাই মনে করছেন প্রকাশকরা। করোনা পরিস্থিতির পর সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালেই স্বাভাবিক সময়ে বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মেলা উপলক্ষে দেশীয় প্রকাশনীগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকেই। কিন্তু কাগজের দামসহ সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দামও অনেকটাই বাড়বে। এতে পাঠকরা বই কিনতে এসে বড় একটা ধাক্কা খাবেন এবং বই বিক্রি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ফলে দেশে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় মৌসুমে বাড়তি দামে বইয়ের বেচাকেনা নিয়ে এখনই চিন্তার ভাঁজ অনেকের কপালেই।
অনেক প্রকাশক বাছাই করে নতুন বই বা কেউ কেউ নতুন বই করবেন না বলেও পরিকল্পনা করছেন। এতে প্রকাশনা শিল্প যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি দেশের শিল্প-সাহিত্যের অগ্রগতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা মোটেই কাম্য নয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশকরা গণমাধ্যমের কাছে কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের ক্ষতির কথা তুলে ধরলেও সম্মিলিতভাবে এখনো সরকারের কাছে তারা এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এমন কোনো খবর আমরা পাইনি। যেটি হওয়ার উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। এ বিষয়ে প্রকাশকদের ঐক্যবদ্ধতার ঘাটতি রয়েছে এবং সে সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় কাগজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে মত দেন কেউ কেউ। প্রকাশনা শিল্পে সৃজনশীল বই প্রকাশের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাগজের দামসহ বই-সংক্রান্ত সব বিষয়ের প্রতি নজর দিতে সরকারিভাবে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করাও উচিত বলে মনে করেন লেখক ও প্রকাশকরা। এতে শিল্প-সাহিত্যের অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগও কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
একসময় কাগজের মূল্যবৃদ্ধিকে জাতীয় সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি বরিশালে ঘূর্ণিঝড় এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। সেখানে অবস্থানকালে তার সঙ্গে দেখা করতে যান বরিশাল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশকরা। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিউজপ্রিন্ট কাগজ বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানান। প্রকাশকদের সব কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ইহা জাতীয় জীবনের একটি আশু সংকট। দুই বৎসরে দুই ধাপে কাগজের টনপ্রতি মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর তীব্র প্রভাব পড়িবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে, যা এই অঞ্চলের মানুষের ওপর নতুন আরেকটি বোঝার শামিল। জাতীয় সংবাদপত্র শিল্প যাহাতে এই সংকট থেকে উত্তরণ পায় তাহার ব্যবস্থা লওয়া হইবে।’
তাই বঙ্গবন্ধুকন্যার আমলে কাগজের সংকট ও লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেএমনটাই আমাদের আশা।
লেখক: লেখক ও গবেষক
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ইতিহাসেও বিশ্ববিদ্যালয়মাত্রই ছিল আবাসিক। অর্থাৎ সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের আবাসন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পাঠ দেওয়া নয়; বরং জ্ঞানচর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক নিবিড় আদান-প্রদানের সুবিধার্থে এই আবাসিক ব্যবস্থা। এভাবে শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, আর গবেষণাগারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান বিকাশের পথ তৈরি হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা আজ আর নেই। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করতে সচেষ্ট নয় বলেই বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলে গাদাগাদি করে থাকছে শিক্ষার্থীরা। একই কারণে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেই তৈরি হয়েছে বহুল সমালোচিত ‘গণরুম’
সংস্কৃতি। প্রশ্ন হলো শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেও বছরের পর বছর যথাযথ আবাসনের সুবিধা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয় তাহলে তারা শিক্ষায় মনোনিবেশ করবে কীভাবে?
দেশ রূপান্তরে মঙ্গলবার ‘এক কক্ষে ২০০ ছাত্রী’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিয়ে হলেও আদতে দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রায় একই দশা। আবাসিক হলের সাধারণ কক্ষগুলোতে খানিকটা স্বস্তি মিললেও গণরুমের দশা সবসময়ই করুণ। গণরুমেও তিন ফুট প্রস্থের একেকটি বিছানায় থাকতে হচ্ছে দুজনকে। দুজনের জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি করে টেবিল-চেয়ার। প্রতিটি বিছানার মাঝে দুই ফুটের ফাঁকা স্থানে রাখা টেবিলে বা নিচে রাখতে হয় দুজনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ফলে ঘুম, খাওয়া, পড়াশোনা সবই করতে হয় বিছানায়। এভাবে একটি গণরুমে দুই শতাধিক ছাত্রীকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীহলগুলোর গণরুমে। গণরুমের এসব বাসিন্দাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় রান্না করতে গিয়েও। নিত্য বিড়ম্বনা আছে শৌচাগার নিয়েও; গড়ে ৩০ জন ছাত্রীর জন্য আছে মাত্র একটি শৌচাগার। শিক্ষার্থী, প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ছাত্রীহলের গণরুমের বর্তমান দশা যেকোনো শরণার্থী শিবিরের চেয়েও করুণ। এসব হলের হাজারের বেশি ছাত্রীর দিন কাটছে মানবেতর অবস্থায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ৯ হাজার ৩৪৬ জন ছাত্রীর বিপরীতে সিট রয়েছে ৪ হাজার ৩৫৪টি; যা মোট আবাসনের মাত্র ৪৬ শতাংশ। পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা না থাকায় ছাত্রীদের ছয়টি আবাসিক হলেই গণরুম সৃষ্টি হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রী নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। আর্থিক অসচ্ছলতার কথা উল্লেখ করে তারা গণরুমের সিটের জন্য বিভিন্ন অনুরোধ করেন। অনেকের অভিভাবক এসে মেয়ের নিরাপত্তার কথা বলে গণরুমে সিটের জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। তখন বাধ্য হয়ে সিটের তুলনায় অধিক শিক্ষার্থী রাখতে হয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষ ও দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রীদের গণরুমে থাকতে দেওয়া হয়। এর মধ্যে মন্নুজান হলের চারটি গণরুমে প্রায় দুই শতাধিক ছাত্রী, তাপসী রাবেয়া হলের দুটি গণরুমে ২৮০ জন, খালেদা জিয়া হলের দুটি গণরুমে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী থাকেন। এছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের একটিমাত্র গণরুমে এ বছর ২১০ জন ছাত্রীকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, বেগম রোকেয়া হলে পাঁচটি রুমে প্রায় ২৫০ জন ছাত্রী ও রহমতুন্নেছা হলে কয়েকটি গণরুমে প্রায় ২৫০ ছাত্রী থাকেন। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তাপসী রাবেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌসী মহলের বক্তব্য বেশ স্পষ্ট। তিনি সরাসরিই বলেছেন, ছাত্রীদের জন্য হলের সংখ্যা না বাড়ালে এসব সংকট কাটবে না। অন্যদিকে, প্রশাসন জানিয়েছে, প্রতি বছর যত সংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে তাদের সবাইকে জায়গা দেওয়ার মতো সিট ক্যাপাসিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। কারণ আগে ছাত্রীদের সংখ্যা কম থাকলেও এখন ছেলে-মেয়ে প্রায় সমান হারে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের জন্য ১১টি হল থাকলেও মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত হল নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকটের এমন করুণ পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ইউজিসি কারুরই অজানা নয়। কিন্তু আবাসন সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৯৯ হাজার ৭২৩ জন শিক্ষার্থীর। প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তুলনায় কম হলেও বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের আবাসনেরও সংকট রয়েছে। অথচ আবাসন সংকটের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। কারণ শিক্ষা কেবল শ্রেণিকক্ষের বিষয় নয়। শ্রেণিকক্ষের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্ত পরিসর আর মানসম্মত আবাসনের নিশ্চয়তাও সমান জরুরি। এসব জরুরি বিষয় নিশ্চিত করা না গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসরও বিকশিত হবে না। আমরা আশা করব কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন সংকট দূর করতে সচেষ্ট হবে।
ডিম্বাস্ত্র আবার কী? প্রক্ষিপ্ত মিসাইল। মাথায় পড়লে টের পাবেন। নিক্ষিপ্ত ডিমের কথা শুনলে বেশি বিচলিত হয়ে থাকেন রাজনীতিবিদরা। বহু বছর আগে পচা ডিমের ব্যবহার নামে একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। প্রশ্ন ছিল এত পচা ডিম যায় কোথায়? প্রায় সব বিক্রেতাই ‘কমন ক্রেতা’র কথা বলেছেনবেকারি মালিক। কেক তৈরি করতে পাইকারি দরে কিনে নেন। একজন বিক্রেতা তার দৃঢ় বিশ্বাস থেকে এমনও বলেছেন যে পচা ডিম না হলে কেক সুস্বাদু হয় না। রাজনীতিবিদদের ওপর নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে কয়েকজন বিক্রেতার কাছ থেকে সতর্ক কিছু ক্রেতা ডিম কিনে থাকেন।
ডিন মার্টিনের গানটা এমনকি রাজনীতিবিদরাও ভালোবাসেন। গানের সারমর্ম অনেকটা এ রকম : তুমি যদি কারও ভালোবাসা না পাও, তুমি মানুষই না; ছুড়ে দেওয়া ডিম যদি তোমার মাথায় না ভাঙে তুমি রাজনীতিবিদই না।
বিশেষ করে ছুড়ে দেওয়া পচা ডিম যতক্ষণ না রাজনীতিবিদকে আঘাত করছে রাজনীতিবিদ হিসেবে তার নাবালকত্ব কাটছে না। এই সাবালকত্বের সঙ্গে চুল-দাড়ি-গোঁফ গজানোর সম্পর্ক অতি সামান্য। চুল-দাড়ি-গোঁফ কেবল গজায়নি, পেকে টাক পড়ার দশা হয়েছে এমন একজন বাহাত্তর-উত্তীর্ণ তিয়াত্তরে রাজা তৃতীয় চার্লস প্রায় মাতৃসম রানী ক্যামিলা পার্কারকে নিয়ে ইয়র্কশায়ার সফরে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য সদ্য প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভাস্কর্য উন্মোচন। এ সময়ই এক তরুণের ছুড়ে দেওয়া ডিম্ব-মিসাইল রাজাকে ও রানীকে আঘাত করতে চেষ্টা করে।
এই ডিম্ব-মিসাইলে একদা সূর্য না ডোবা সাম্রাজ্যের বৃদ্ধ রাজাকে সাবালক বানানোর উদ্যোগ নিয়ে এক তরুণ গ্রেপ্তার হন এবং তার এই টার্গেট শুটিংয়ের জন্য মোটেও অনুতপ্ত নন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। দেরিতে সাবালকত্বের দিকে ধাবিত তৃতীয় চার্লস নাবালকসুলভ আচরণ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেননি, কোনো রাজনৈতিক দলের অপকীর্তি বলে পাড়া মাত করেননি, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও মনে করেননি, নিজেও ডিমকামানের গোলন্দাজের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেননি, এমনকি টাকা খরচ করে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ফেস্টুন ইত্যাদি বানিয়ে রসিক তরুণটির ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই ধ্বনি দেওয়ার জন্য ছাত্র ও যুব ফ্রন্টকে রাস্তায় নামিয়ে দেননি। এটাই হচ্ছে ডিম্বাঘাতী সাবালকত্ব। ডিমের আঘাতে গত আড়াই হাজার বছরে কোনো রাজনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেননি। তবুও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে হলে নিক্ষেপকারী তাৎক্ষণিক মৃত্যু ভাগ্যক্রমে এড়াতে পারলেও হত্যাপ্রচেষ্টা মামলার আসামি হতোই। সাবালকত্ব পরিমাপে ডিম্বসূচকটি সমাদৃত।
‘গড সেইভ দ্য কিং’জাতীয় সংগীত হলেও ইয়র্কের তরুণরা চেঁচিয়েছে ‘তোমাকে রাজা মানি না’, নুয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ বছর বয়সী ডিম নিক্ষেপকারী চেঁচিয়ে বলেছেও ‘ক্রীতদাসের রক্তের ওপর এই দেশ দাঁড়িয়েছে’।
নিক্ষিপ্ত ডিম একটি নয় একাধিক। ৯ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানের সংবাদ কাভার করতে আসা গার্ডিয়ান প্রতিনিধি দেখেছেন তিনটি নিক্ষিপ্ত ডিম-মিসাইল আর বিবিসির প্রতিনিধি দেখেছেন পাঁচটি। তিন বা পাঁচ বিতর্কের চেয়ে হতাশাব্যঞ্জক বিষয়টি হচ্ছে উভয় মাধ্যমই দাবি করেছে ডিম রাজাকে আঘাত করতে পারেনি। রাজা ডিমকে ডজ দিয়েছেন। এই সংবাদে আবার দুটি আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে; প্রয়াত রাজার সাবালকসুলভ আচরণ তাহলে সাময়িক। দ্বিতীয়ত. একালের তরুণরা টার্গেট শুটিংয়ে ব্যর্থ। দুটোই চিন্তার কারণ।
পাঁচটি হোক কী তিনটি হোক একাধিক ডিম রাজার দিকে ধেয়ে এসেও তাকে ছুঁতে পারেনি টার্গেট শুটিংয়ে ব্যর্থতার কারণে তার সাজা হোক এতে কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু এটাকে যেন হত্যাপ্রচেষ্টা বলে প্রচার না করা হয়। এমনকি নিক্ষেপকারীর ইচ্ছে ছিল রাজাকে ব্যথা দেওয়াএ কথাও যেন বলা না হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছেসরকারের পক্ষে এ কথা ছড়ানো হলেও ধৃত আসামির পক্ষে বলা হয় ব্যথা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে তো সেদ্ধ ডিম ছোড়া হতোডিমটা কাঁচা ছিল। সেদ্ধ বেশি হলে শক্তও বেশি, আঘাতে ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
টার্গেট মিস করা নিয়ে আফসোস করে গেছেন সর্দার উধম সিং। লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের সময়কার পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার এবং তখনকার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড জেটল্যান্ডকে (১৯১৭ থেকে ১৯২২ বাংলা গভর্নর) হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি করেন। মাইকেল ও ডায়ার সেখানেই লুটিয়ে পড়েন কিন্তু টার্গেট হয়তো মিস করেছেন এমনই আশঙ্কা করেছিলেন তরুণ উধম সিং। পুলিশবেষ্টিত অবস্থায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘জেটল্যান্ড কি মরেছেন? তারও মরা উচিত। আমি তার ডানদিকে দুটো গুলি করেছিলাম।’
সর্দার উধম সিংয়ের সংশয় সঠিক। জেটল্যান্ড কেবল আহত হয়েছেন। তার গুলি টার্গেট ছুঁয়ে গেলে যথাস্থানে আঘাত করেনি। তিনি আফসোস করে বললেন, মাত্র একজন মরেছেন। আমি তো ভেবেছি আরও বেশি মারতে পারব। আমি নিশ্চয়ই খুব ধীরে ধীরে কাজটা করেছি। অনেক মহিলা ছিলেন তো তাই।
(মার্ডার অ্যাট ক্যাক্সটন হল ও অন্যান্য ইতিহাস : প্রকাশক এপিপিএল)
ডিমের দাম এতটাই বেড়েছে, কোথাও কোথাও সম্ভবত গুলির দামকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার পরও যারা গাঁটের পয়সা খরচ করে ডিম কিনে কাঁচা অবস্থায় অথবা সেদ্ধ করে ছুড়ে মারেন তাদের উদ্দেশ্য যে উধম সিংয়ের মতো হত্যা করা নয় তা যে স্পষ্ট, আর যাই হোক ডিম নিক্ষেপকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহীর মর্যাদা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কোনো মানে নেই। বরং টার্গেট মিস করার জন্য তাকে অদক্ষ বলে গালাগাল দিয়ে পিজিয়ন টার্গেট শুটিংয়ে হাত পাকানের সুযোগ করে দেওয়া উচিত বলেও পশ্চিমের ‘এগ প্রোজেক্টাইল অ্যানালিস্টরা’ মনে করেন।
মুনতাজার আল জাইদি নামের জুতো-ছোড়া সাংবাদিকের কথা মনে করুন। ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮ প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে নিয়ে বাগদাদে বহুসংখ্যক টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে যখন লাইভ সংবাদ সম্মেলন করছিলেন মুনতাজার নিজের পায়ের জুতো খুলে প্রেসিডেন্টের মাথা বরাবর ছুড়লেন, দক্ষ আক্রোব্যাটের মতো প্রেসিডেন্ট জুতোকে ডজ দিলেন। এক জুতোতে আর কাজ কীভেবে মুনতাজার দ্বিতীয়টিও ছুড়লেন। এবার প্রেসিডেন্ট মাথা সরালেন আর ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নিক্ষিপ্ত দ্রব্যটি ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। অনস্বীকার্য, সেদিন থেকে মুনতাজার আল জাইদি সেলিব্রিটি হিসেবে যাই নাম কামিয়ে থাকুন না কেন টার্গেট শুটিংয়ে তিনি যে অদক্ষ এটা কাঁচা শুটাররাও বলতে ছাড়েননি। তার কারাবাসকে তারা অদক্ষতার শাস্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। মুনতাজার দুটো বাক্যমিসাইলও নিক্ষেপ করেছিলেন। প্রথম নিক্ষেপের সময় বলেছিলেন, ‘তোর মতো কুত্তার জন্য ইরাকি জনগণের শেষ চুম্বন।’ দ্বিতীয় নিক্ষেপের সময় বলেছেন, ‘এই জুতোটি ইরাকের বিধবা, এতিম ও নিহতদের পক্ষ থেকে।’
মুনতাজার মাত্র ৯ মাস জেল খেটে বেরিয়ে এসে প্যারিসে গিয়ে তারই এক স্বদেশির জুতো হামলার শিকার হয়েছেন। টার্গেট শুটাররা মনে করেন টার্গেট মিস করার শাস্তি এত কম হলে শুটিংয়ের সিরিয়াসনেস কমে যাবে।
* * *
খ্রিস্টজন্মের ৬৩ বছর পর রোমান গভর্নর ভেসপাসিয়ানকে যে প্রজা টার্গেট করেছিলেন তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। সেকালে ডিম কিংবা জুতো (কজনই বা জুতো পরতেন!) জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, ছোড়া হতো আহার্য ও ফলমূল। ভেসপাসিয়ানের গায়ে লেগেছিল শালগম।
অপরাধী ও রাজনীতিবিদদের ডিম পাওয়ার ব্যাপারটি বেশ পুরনো। প্রথম এলিজাবেথের যুগে থিয়েটার দর্শকদের কেউ কেউ পকেটে পুরে দু-একটি ডিম নিয়ে যেতেন। কারও অভিনয় বিরক্তিকর হলে তার ওপর ডিম এসে পড়ত। শত শত দর্শকের মধ্যে কাজটা কোন অসন্তুষ্ট দর্শকেরকখনো কখনো তা শনাক্ত করা গেলেও তারা মামলা-মোকদ্দমা বা হেনস্তার শিকার হননি। বরং নাট্যপরিচালক অভিনেতাকে বদলে দিয়েছেন কিংবা তার চরিত্রে গতি সংযোজন করেছেন।
রাজনীতিবিদ নিজ দলের হলেও বক্তৃতার সময় যদি অসমীচীন কথা বলেন তাতে দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হয়। সমর্থকদের বরাবরই প্রত্যাশা নেতার কথা জাদুতে তাদের মুগ্ধ করবেন, বিরক্তির উদ্রেক করবেন না। ইংরেজরা তাদের রাজনৈতিক সভাগুলোতেও ওভারকোটের ভেতর ডিম নিয়ে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত জর্জ এলিয়টের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মিডল মার্চ’-এ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী চরিত্র মিস্টার ব্রুক নির্বাচন প্রচারণায় যে ভাষণ দিলেন তা ছিল অগোছালো এবং দুর্বল। সুতরাং ভাষণের একপর্যায়ে তার ওপর ডিম বর্ষিত হতে শুরু করলরীতিমতো শিলাবৃষ্টির মতো।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এগ ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে চলেছেপ্রাইম মিনিস্টার এগড্ মানে প্রধানমন্ত্রী ডিম্বাক্রান্ত হয়েছেন। সদ্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ঢোকা ঋষি সুনাক এখনো এগড্ হননি, তার মানে সাবালকত্বপ্রাপ্তি ঘটেনি। লিজ ট্রাসকে নাবালিকা অবস্থাতেই বিদায় নিতে হয়েছেমাত্র ৪৫ দিনের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, তিনি কোনো ডিম্বাস্ত্র আকর্ষণ করতে পারেননি। অথচ তাদের পূর্বসূরিদের সাফল্যের ইতিহাসে ডিম্বাস্ত্রের ভূমিকা খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিংশ শতকের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রীদের একজন (কেবল ব্রিটেনে নয় সমগ্র বিশে^ সাফল্যের নিরিখে) মার্গারেট থেচার ডিম খেয়েছেন। বাংলা অভিধান ডিম্বাক্রান্ত হওয়া শব্দটি গ্রহণ করেনি। ডিম খাওয়া দ্ব্যর্থবোধক শব্দযুগল হিসেবে গৃহীত হতে পারেনাশতায় ডিম খাওয়া কিংবা জনসভায় ডিম খাওয়া। থেচারের আগে ডিম খেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন। পরে ডিম খেয়েছেন জন মেজর, টনি ব্লেয়ার, ডেভিড ক্যামেরন। ডিমভাগ্যই তাদের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বহাল রেখেছে। তাদের সাবালকত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে।
বিংশ শতকের সবচেয়ে সফলদের একজন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এপিসোডটি তুলে না ধরলেই নয়। ১৯৬৭-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন প্রচারণায় ভুবনেশ্বর এসেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ডিম্বাকৃতির একটি প্রক্ষিপ্ত মিসাইল (ব্রিটিশরা বলে থাকে ডেয়ারি মিসাইল) বক্তৃতারত ইন্দিরা গান্ধীর নাকে আঘাত করল। গুরুতর আঘাত নাকের হাড় ভেঙে দিল, রক্তপাত শুরু হলো, তিনি নাকমুখ চেপে ধরলেন। এ অবস্থাতেই তিনি বললেন, এটা গণতন্ত্রের জন্য অশুভ সংকেত। কাকে ভোট দেবেন? নিক্ষেপকারীকে? বেশি রক্তপাত হতে থাকায় তাকে দ্রুত ডায়াস থেকে নামিয়ে দিল্লিতে হাসপাতালে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ডাক্তারের নির্দেশ উপেক্ষা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা নাক নিয়ে আবার জনসমক্ষে আসেন এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পাকাপাকি প্রধানমন্ত্রী হন।
জেরেমি ওয়েবস্টার জীবদ্দশায় মার্গারেট থেচারকে হাতের কাছে পাননি বলে তখন ডিম খাওয়াতে পারেননি। ২৬ মে ২০২২ লিঙ্কনশায়ারে মার্গারেট থেচারের ১০ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য স্থাপিত হওয়ার আগে থেকেই লিস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগের প্রধান ৫৯ বছর বয়সী জেরেমি ওয়েবস্টারের হাত পকেটের ভেতর নিশপিশ করছিল। ভাস্কর্যটি স্থাপিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি পকেট নয়, ডিমের বাক্স থেকেই ডিম বের করে ‘ম্যাগি’র ওপর ছুড়ে মারলেন। ব্যাপারটা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটেনি। তার ডিম প্রক্ষেপণের চিত্রধারণের সুযোগও নিয়েছেন রসিক ফটোগ্রাফার। পুলিশ তাকে ছাড়েনি। মার্গারেট থেচারের পক্ষে তার কোনো স্বজন কিংবা তার রক্ষণশীল দল তার ফাঁসি দাবি না করলেও সংক্ষিপ্ত বিচারের বিলেতি পুলিশ আইনের ৫ ধারায় তার ৯০ পাউন্ড জরিমানা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা মোটেও থেচারবিরোধী নন এবং তার ভাস্কর্য স্থাপনে তাদের কোনো অসন্তোষও নেই, ব্যাপারটা জেরেমির নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত।
কী জানি জেরেমি হয়তো ভেবেছেন মার্গারেট থেচার (১৯২৫-২০১৩) জীবদ্দশায় পর্যাপ্ত ডিম খাননি, তার ভাস্কর্যকেও কিছু খাওয়ানো দরকার।
শ্রমিকদলীয় প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ১৯৭০ সালে হ্যারোতে ডিম খেলেন। নিক্ষিপ্ত একাধিক ডিমের একটি তার গায়ে লেগে ভেঙেও গেল। হ্যারল্ড উইলসন হেসে উঠলেন এবং মাইক্রোফোনে জনতার উদ্দেশে বললেন, হ্যারোতে দ্রব্যমূল্যের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে স্বীকার করতেই হবে শ্রমিক দলের শাসনকালে ডিম এত সস্তা হয়েছে যে তা নিক্ষেপও করা যায়। যদি রক্ষণশীল দল ক্ষমতায় আসে তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন আগামী ৫ বছর ব্রিটেনের জনগণ ডিম কিনে নিক্ষেপ করার সক্ষমতা অর্জন করবে না।
হ্যারল্ড উইলসন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
ডিম খাওয়ার পর টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, শুধু ডিম কেন, মাখনও নিক্ষেপ করুক, তাহলে কেক বানিয়ে খাওয়া যেত। এর নামই রাজনৈতিক সাবালকত্ব।
বিবেচনা করুন ‘ডিমপরিপক্বতা’ হ্যারল্ড উইলসনকে কত সম্মানিত করেছে আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রক্ষিপ্ত ডিমকে হয়তো বলা হবে আণবিক বোমাহিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমার চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী। এর নাম রাজনৈতিক নাবালকত্ব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
বাংলাদেশে টিকে থাকতে হলে একটু ‘কায়দা করে’ চলতে হয়। সোজা পথে না চলে কিছুটা বাঁকা রাস্তায় যাওয়াই যেন এখানকার রীতি। এখানে নৈতিকভাবে ভালো লোকদের বলা হয় ‘সহজ-সরল’। এই বলার মধ্যে আবার একটুখানি প্রচ্ছন্ন দরদ থাকে। সৎ লোকদের প্রতি দরদ না দেখিয়েও উপায় নেই, কেননা এরা পদে পদে বিপদে পড়েন। বেশিরভাগ সরকারি অফিসে বৈধ এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোনো কাজ করাতে চাইলে যে কাজটার জন্য যে সময় লাগে সেই একই কাজে যখন অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়, তার অর্ধেক সময় লাগে। অনিয়ম যখন সমস্ত ব্যবস্থাকে গ্রাস করে তখন শিক্ষাব্যবস্থাও এর বাইরে যেতে পারে না। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে এর শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেই চলে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দূরে থাক, এসব শিক্ষার্থী পাস নম্বরও পাচ্ছে না। অর্থাৎ, ধরে নিতে হবে গলদটা গোড়ায়। প্রায় শতভাগ পাস আসলে কতটা সংখ্যাগত আর কতটুকু গুণগত সেটা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই প্রশ্ন করার। নানা সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে পরীক্ষার খাতা যারা দেখেন তাদের প্রতি এক ধরনের মৌখিক নির্দেশনা আছে শিক্ষার্থীদের যেন ফেল করানো না হয়। নির্দেশনা যেহেতু মৌখিক, তাই এ অভিযোগ প্রমাণ করা শক্ত। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই যে ‘পাস করা’ শিক্ষার্থীদের ঘটে তেমন বিদ্যাবুদ্ধি নেই তার প্রমাণও তো নেহাত কম নয়।
অনেকদিন ধরে ‘সৃজনশীল’ নামক এক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি বাংলাদেশে চলমান। নামে সৃজনশীল হলেও এটা আসলে প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল নয়। প্রশ্নপত্রে আসা ‘উদ্দীপক’ নামক কয়েক লাইনের রচনার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে থাকা কোনো একটি গদ্যের তুলনামূলক বিচার ছাড়া ‘সৃজনশীল’ শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। তা ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষকরা কতটুকু বোঝেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে পাঠদানে রয়ে যাচ্ছে প্রচুর খামতি। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আবার মুখস্ত করছে ‘সহায়ক’ বই। গাইড বই বন্ধ হয়েছে বেশ আগে। কিন্তু ঠিকই ‘কায়দা করে’ চলছে এসব ‘সহায়ক বই’। শুধু নামেই আলাদা।
সম্প্রতি এইচএসসির প্রশ্নপত্রের কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে কথা উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা। প্রশ্নপত্রে কমপক্ষে তিনটি সমালোচনাযোগ্য উপাদান ছিল। ৬ নভেম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-২য় প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্ন ছিল এমন ‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনিসুল হক লেখালিখি করে সুনাম অর্জন করতে চান। ২১শে বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে আনিসুল হক বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে, (ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা করো। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ করো। এই প্রশ্নে প্রথম মূল সমস্যা হলো ব্যক্তি আক্রমণ এবং বিদ্বেষ ছড়ানো। আনিসুল হক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফলে প্রশ্নকর্তা না জেনেই আনিসুল হকের নাম নিয়েছেন সেটা ভাবার অবকাশ নেই। এ রকম একটা পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তাকে হেয় করা অত্যন্ত নিম্নরুচির কাজ। তাছাড়া উদ্দীপকের প্রথম বাক্যটিও ভুল। যিনি ‘প্রখ্যাত’ সাহিত্যিক তিনি কেন ‘সুনাম’ অর্জন করতে চাইবেন! প্রখ্যাত মানেই তো যিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার মতো দায়িত্বশীল লোকজন ভুল বাক্য লিখবেন এটাও মেনে নেওয়া মুশকিল। আরেকটি প্রশ্নে ছড়ানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। সেখানকার উদ্দীপকে বলা হয়েছে ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ- বণ্টন মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামের এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমি এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’
সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ও সংকট নিয়ে যখন বাংলাদেশে বহুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখন এমন প্রশ্ন এইচএসসির শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে সেটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। উল্টোদিকে দেশে অনেক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত আছে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় গিয়ে দেখেছি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান রেখে সেখানকার বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। অথচ প্রশ্নের উদ্দীপকটিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাড়াবাড়ি রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যই উদ্দীপকটি অস্বস্তিকর। দায়িত্ববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকলেই কেবল এমন প্রশ্ন করা সম্ভব। আরেকটি উদ্দীপকে বলা হয়‘ফারজানা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন কলেজ শিক্ষিকা। অনেক আগেই বিয়ের বয়স পেরিয়েছেনতাই তিনি বিয়ে করেননি। ছাত্রজীবনে তিনি ভালোবেসেছিলেন ব্যক্তিত্বহীন একজনকে। কারণ বাবা-মার যৌতুকের চাপের মুখে সে ফারজানাকে বিয়ের কথা অস্বীকৃতি জানায়। এরপর থেকে ফারজানা তার কলেজ আর একাকিত্ব জীবন কাটায়।’ উদ্দীপকটিতে সংবেদনশীলতার লেশমাত্র নেই। নারীশিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে স্পষ্ট। আলোচ্য তিনটি উদ্দীপকই রচনা হিসেবে খুব নিম্নমানের তো বটেই, এসবের অভিঘাত সম্পর্কেও প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা সচেতন নন।
সৃজনশীল প্রশ্ন নামে বাংলাদেশে যা চালু আছে তাতে কোনো প্রকার সৃজনশীলতা শেখানো সম্ভব না। সত্যিকার অর্থে যদি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হয় তাহলে যেসব দেশে সৃজনশীল শিক্ষা চালু আছে সেখান থেকে পদ্ধতি দেখে-শুনে-বুঝে প্রথমে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রকৃত বিদ্বান মানুষদের যুক্ত করতে হবে এসব কাজের সঙ্গে। তারপর ভাবতে হবে এটি চালু করার কথা। গোঁজামিল দেওয়া নামসর্বস্ব শিক্ষাপদ্ধতিকে সৃজনশীল নামে চালিয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
বাংলাদেশে যেহেতু ‘কায়দা করে’ অনেক কিছু হওয়া সম্ভব, শিক্ষকতার চাকরিও এর ব্যতিক্রম নয়। সবাই জানে সরকারি চাকরি পেতে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়। মেধাহীন মানুষদের শিক্ষকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় বসালে তার খেসারত পুরো জাতিকেই দিতে হবে। আমরা, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা অন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু তাতে প্রলয় বন্ধ হয় না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা ‘আর পি সাহা’ নামেও পরিচিত। তিনি ১৮৯৬ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার অদূরে সাভারের কাছৈড় গ্রামে দরিদ্র একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ বছর বয়সে আরপি সাহা কলকাতায় যান এবং বিপ্লবী দলে যোগ দেন। কয়েকবার কারাবরণও করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-বেঙ্গল সেনা মেডিকেল কোরে যোগ দিয়ে ইরাকে যান; সেনাবাহিনীতে কমিশনও লাভ করেন। এরপর কয়লা সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। চার বছরেই তিনি কলকাতায় বিশিষ্ট কয়লা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। ১৯৩৮ সালে নিজ গ্রাম মির্জাপুরে তিনি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং ২০০ ছাত্রীর থাকা ও পড়াশোনার উপযোগী আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি গরিবদের কল্যাণে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করান। মায়ের স্মরণে মির্জাপুরে ‘কুমুদিনী মহিলা কলেজ’ ও বাবার নামে ‘দেবেন্দ্র কলেজ’ স্থাপন করেন। মির্জাপুরে ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কীর্তি। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ মে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন। ১৯৭৮ সালে সরকার তাকে এবং ১৯৮৪ সালে তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে সমাজসেবায় অবদানের জন্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার দেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
কয়েক দফা বাড়ার পর রমজানের প্রথম দিন কিছুটা কমেছে মুরগির দাম। শুক্রবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনটা দেখা গেছে। এ ছাড়াও গতকাল শীর্ষ চার পোল্ট্রি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে তলব করে ভোক্তা অধিকার। পরে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় মুরগির দাম।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে ২৪৫-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালির দাম ২০ টাকা কমে ৩৬০ টাকায়, আর দেশি মুরগি ৬৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম কমেছে। তারা জানান, আগের তুলনায় তাদের বিক্রি কমে গেছে। এ অবস্থায় দাম আরও কমতে পারে বলে জানান তারা।
আর ক্রেতারা বলছেন, এখনও তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে মুরগি ও ডিম।
এদিকে, বাজার তদারকিতে সকাল থেকে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রোজার প্রথম দিন শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযানে নামে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সকাল সাড়ে ১০টায় এ বাজারের কিচেন মার্কেটে অভিযান শুরু করেন সংস্থার সদস্যরা। অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। উপস্থিত আছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান আব্দুল জব্বার মণ্ডলসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা।
এর আগে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুরগির দাম সমন্বয়ের জন্য ডাকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেখানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, 'মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না।'
ব্রাজিলের সমুদ্রতীরবর্তী শহর রিও ডি জেনেইরোর কাছে একটি অপরাধী চক্রের প্রধানের গ্রেপ্তারে অভিযানের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রিও ডি জেনেইরোর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সাও গনসালো শহরের শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা সালগেইরোতে এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশের দাবি, নিহতরা সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী।
ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পারার মাদক-নেতা অভিযুক্ত লিওনার্দো কোস্তা আরাউজো সালগেইরোতে লুকিয়ে আছে- এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে আরাউজোও আছেন। পারার বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নিহতের ঘটনায় তার হাত আছে বলেও অভিযোগ।
পুলিশ জানিয়েছে, আরাউজোকে গ্রেপ্তারে বৃহস্পতিবার চালানো এই অভিযানে হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়।
রিও শহরের পুলিশ প্রায়ই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে। শহরটির গভর্নর ক্লডিও কাস্টো সোশালে এক পোস্টে লেখেন, আমরা আমাদের এই শহরকে অন্য কোনো এলাকা থেকে আসা দুর্বৃত্তদের অভয়াশ্রম হতে দেব না।
এ ঘটনায় অপরাধী চক্রের স্থানীয় তিনজন সোর্সও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।