
তেরো বছর আগে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৯০ শতাংশের মতো। পুরো কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝেই কেন্দ্রটি থেকে আদৌ পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ পাওয়া যাওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়।
অথচ এই কেন্দ্রের ৪ বছর পর পটুয়াখালীর পায়রায় একই ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ-চীনের যৌথ উদ্যোগে কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ২০২০ সালে। সেখানে সমান সক্ষমতার আরও একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে, যেটি ২০২৫ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে এমন দাবি তুলে শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজ। যদিও সরকারের দাবি, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এই কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) যৌথভাবে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) গঠন করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের ঋণসহায়তায় কেন্দ্রটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (ভেল)।
কেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয়। পরে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বে গঠিত হয় নতুন কোম্পানি। কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল ক্রয় চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ক্রয় চুক্তির সময় কেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৮ দশমিক ৮৫ টাকা ধরা হলেও বর্তমানে কয়লার মূল্যবৃদ্ধির কারণে দাম দিতে হবে ১৪ থেকে ১৫ টাকা।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রামপাল কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। শুরুতেই এই কেন্দ্র নিয়ে আশঙ্কা করা হলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। এটি যখন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনো এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের প্রয়োজন ছিল না। আর এখন সরকারের দাবি অনুযায়ী, চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। ফলে এখন এই কেন্দ্র একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। উপরন্তু নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কেন্দ্রভাড়া দিতে হবে। সেই সঙ্গে দিতে হবে ঋণের কিস্তি। এককথায় বলা যায়, কেন্দ্রটি বাংলাদেশকে অনেক ভোগাবে।’
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শুরু থেকেই মিথ্যাচার ও লুকোচুরির অভিযোগ রয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল কেন্দ্রটি নির্মাণে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। বেশ পরে জানা গেল, আসলে সেখানে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রযুক্তির চেয়ে প্রথম প্রযুক্তি ব্যবহারে কয়লার দূষণ হয় কম।
দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য সহজে পাওয়া গেলেও রামপাল কেন্দ্রের সঠিক তথ্য কখনোই পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশ জটিল। সেখান থেকেও সহজে তথ্য পাওয়া বেশ মুশকিল। নানা কসরতে সাধারণ কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেখানে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের আমন্ত্রণে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা ১৬ ফেব্রুয়ারি রামপাল কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। ওই দলে এই প্রতিবেদকও ছিলেন। কিন্তু সেখানেও একধরনের লুকোচুরি চোখে পড়ে। সেখানে প্রকল্প পরিচালকের ব্রিফিং, বাইরের কিছু ছবি তোলা আর কয়লার জেটি পরিদর্শন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থাপনা পরিদর্শন করার সুযোগ হয়নি নিরাপত্তার খোঁড়া অজুহাতে। ফলে কেন্দ্রটির ভেতরের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়নি। অথচ দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে সবকিছুই দেখানো হয়।
তবে বাইরে থেকে যতটুকু দেখা গেছে, তাতে প্রায় পুরো প্রকল্প এলাকাজুড়ে অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতার ছাপ চোখে পড়েছে। চারদিকে ধুলা আর আবর্জনায় ভরা। কোনো কোনো যন্ত্রপাতিতে মাকড়সার জাল ও মরিচা ধরার চিহ্ন পাওয়া গেছে। কয়লা আমদানির জেটিতে যাওয়ার রাস্তা কাদাবালিতে একাকার। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জেটির নিচে বড় বড় ঘাস জন্মেছে। কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখানে যাওয়ার পথে সারি সারি কয়েকটি পুকুর চোখে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এগুলো সব ‘অ্যাশ পন্ড’, যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই রাখা হবে। তবে গর্ত করে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজই হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রে ব্যবহৃত পানি ব্যবস্থাপনার পাইপলাইনেও একাধিক ফাটল দেখা গেছে।
সাধারণত কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯০ দিনের জ্বালানি মজুদ রাখা বাধ্যতামূলক হলেও রামপালের প্রথম ইউনিট চালুর ২৩ দিনের মাথায় কয়লার অভাবে গত ১৪ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা আমদানির পর ১৬ ফেব্রয়ারি কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে।
বর্তমানে কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা। গত ২২ ডিসেম্বর কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের শর্ত পূরণ করেছে এমন দাবি করেছেন বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সৈয়দ আকরাম উল্লাহ।
গতকাল রবিবার তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট প্রস্তুত। এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে।
অ্যাশ পন্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত ছাই সরাসরি বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অ্যাশ পন্ডের কোনো দরকার হচ্ছে না। তবে জরুরি মুহূর্তের জন্যই এটা নির্মাণ করা হবে। নির্মাণকাজের অগ্রগতি কতটুকু তা জেনে জানাতে পারবেন বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পর বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার জন্য এত বেশি সময় নেওয়ার নজির নেই। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে।
অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্রটিতে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহারের কারণে পূর্ণ ক্ষমতায় দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের সক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট হলেও ৬০০ মেগাওয়াট লোডে বেশি সময় ধরে চললে বয়লারের টিউব ফেটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। তখন কেন্দ্রটি বন্ধ করতে হচ্ছে। এমন ঘটনা একাধিকবার সৃষ্টি হওয়ায় ভবিষ্যতে কেন্দ্রটির পূর্ণক্ষমতায় উৎপাদন করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এর আগে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। তাড়াহুড়া করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায়ই বন্ধ থাকায় সেখানে আরও একটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির পাশাপাশি কয়লা সংকটের কারণে এই কেন্দ্র থেকেও ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। কত দিন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, তা নিয়েও কর্মকর্তাদের অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এসব কারণে বড়পুকুরিয়া কেন্দ্রটি এখন পিডিবির জন্য অনেকটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার বোঝা হয়ে দাঁড়ায় কি না, তা নিয়েও রয়েছে একধরনের সংশয়। তবে এ সংশয় সত্যি হলে তা দীর্ঘদিন ভোগাবে দেশকে। কারণ উৎপাদন না করলেও ২৫ বছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি কেন্দ্রটি নির্মাণে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেটিও পরিশোধ করতে হবে।
দেশের অন্য সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রভাড়া দিতে হবে রামপালকে। কেন্দ্রটি উৎপাদন করুক বা না করুক প্রতি ইউনিটের জন্য কেন্দ্রভাড়া দিতে হবে ৪ দশমিক ৮৫ সেন্ট। দুটি ইউনিট একসঙ্গে চালু হলে বছরে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে কেন্দ্রভাড়া গুনতে হবে পিডিবিকে। অন্যদিকে দেশে তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট গড়ে ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পা-ে সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। ডলারসংকটের কারণে সময়মতো কয়লা আমদানি করতে না পারায় কিছুদিন কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন পাইপলাইনে যে কয়লা রয়েছে, তা দিয়ে একটি ইউনিট আগামী এপ্রিল পর্যন্ত চালানো যাবে। এর মধ্যে আমদানি জটিলতা না কাটলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে কেন্দ্রটি চালু রাখা সম্ভব হবে না।
তবে একাধিক সূত্রমতে, বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার আগে যে পরিমাণ কয়লা মজুদের দরকার, তা করা হয়নি। ডলারসংকট হয় এর পরে। ক্যাপাসিটি চার্জ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি না নিয়েই তড়িঘড়ি করে কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
আগামী জুন মাসে কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে প্রকল্প পরিচালক এমন তথ্য জানালেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকৌশলী জানান, কাজের যে অগ্রগতি তাতে পুরো কাজ শেষ করতে চলতি বছর লেগে যাবে।
বয়লার টিউব ফেটে যাওয়ার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘অনেক দিন আগে টিউব এনে সেগুলো গুদামে ফেলে রাখার কারণে সমস্যা হয়েছে। এ সমস্যা আর থাকবে না। ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রেও এ ধরনের সমস্যা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
তবে পটুয়াখালীর পায়রায় উৎপাদনে থাকা একই সক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ ধরনের কোনো সমস্যার কথা এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, নতুন যেকোনো কিছুর শুরুতেই অনেক ঝামেলা হয়। রামপালের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই এই কেন্দ্র নির্মাণের কারণে কিছুটা সময় বেশি লাগছে। যেটা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে হয়নি। তবে এটা সত্যি, আরও আগে রামপাল উৎপাদনে এলে গত বছর বিদ্যুৎ নিয়ে যে সংকট ছিল তা মোকাবিলায় সহায়ক হতো। সবকিছুর পরও কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষের দিকে। এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নিম্নমানের যন্ত্রপাতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। আশা করছি সমস্যার সমাধান হবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ভালো না হলেও অন্তত ওই কেন্দ্রের মতো গুণগত মান যেন রামপালে ঠিক থাকে, সে ব্যাপারে আমরা বলেছি।’
বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘কোয়ালিটি ফেইল’ করছে। সেখানে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যারা এই কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন, তারাই বলেছেন সবকিছু বিবেচনায় রামপাল আর পায়রার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। রামপাল যারা নির্মাণ করছে, তারা কেন গুণগত মান ঠিক করল না, সেটা দেখার বিষয়। না হলে পুরো বিষয় ভেস্তে যাবে; যা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। কারণ নির্ধারিত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারলে অন্য কেন্দ্রের ক্ষেত্রে জরিমানা করা হয়। রামপালের ক্ষেত্রে এটা হলে সেই জরিমানা তো বাংলাদেশকেও দিতে হবে।
তিনি বলেন, সবার আগে এই কেন্দ্রের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ঠিকমতো কাজ শেষ হয়নি। এখানে সম্পূর্ণ অদক্ষতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশবাদীদের যে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা একটা অসিলামাত্র। সত্যিকার অর্থে তাদের বাধার কারণে এক দিনের জন্যও নির্মাণকাজ বন্ধ থাকেনি। এই কেন্দ্রের অনেক পরে পায়রা বিদ্যুতের কাজ শুরু করে নির্ধারিত সময়ের আগে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে নির্মাণকাজ শেষ করেছে নির্ধারিত বাজেটের চেয়েও কম টাকায়। রামপালের ক্ষেত্রে কেন এমন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
শুরুতেই মুঠোভর্তি বেতন। রাশিয়ায় প্রশিক্ষণের সুযোগ। বহির্বিশে^ ব্যাপক চাহিদা। সবকিছুই মিলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চাকরিতে। এ কারণেই অন্য যেকোনো চাকরির তুলনায় মেধাবীরা ভিড় জমাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে।
এত সুযোগ-সুবিধার চাকরি বলেই তদবিরটাও আকাশচুম্বী। স্থানীয় প্রভাবশালী, জাতীয় রাজনীতিক, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবের তদবির আর তদবির। বাদ নেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। কিন্তু কোনো তদবিরেই কারও তকদির ফিরছে না। সব তদবির পাশে রেখে মেধাভিত্তিক জনবল বাছাই নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয়েছে সরাসরি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের তত্ত্বাবধানে। মৌখিক পরীক্ষায়ও বুয়েটের প্রতিনিধি থাকেন। প্রকল্পের কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয়, মনস্তত্ত্ববিদসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রার্থী বাছাই করেন।
চার বছর আগে প্রথম দিনের মৌখিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান হাজির হয়েছিলেন। পরীক্ষা বোর্ডেই প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন প্রার্থীদের তদবির আমলে নেওয়া হবে কি না। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমার নিজের কোনো তদবির নেই। কাজেই আমার দিক থেকে কোনো চাপ নেই। বাকি কাজটা আপনারা নির্ভয়ে করতে পারবেন তো?’ মন্ত্রীর এ অভয়বাণী শুনে আশান্বিত হয়ে ওঠেন প্রকল্প পরিচালক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কারও তদবির আমলে নেওয়া হয়নি।
ইয়াফেস ওসমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনবলও তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতের উন্নত জাতি গঠনের জন্য পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ উপলব্ধি থেকেই নির্মোহভাবে জনবল বাছাই করা হচ্ছে। কোনো ধরনের তদবির মানা হয়নি। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেশের সেরা মেধাবীদের হাতে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী।
দেশের সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পের জন্য জনবল লাগবে ২ হাজার ৫৩৫ জন। এর মধ্যে ধাপে ধাপে নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৯২৭ জন। তাদের মধ্যে ৮৫১ জনকে রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সাতজন কর্মকর্তা ২০১৮ সাল থেকে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ¦ালানি আসার আগেই রাশিয়া থেকে রূপপুর ফিরবেন। আরও ৫৬৪ পদে জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এসব পদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ২৫ হাজার। প্রতি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ৪৪টি। এসব কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানেই রূপপুরের দুটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ করে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চাকরি ছেড়ে দেন তখন কী হবে। সেই ব্যবস্থাও পাকা করে রেখেছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে তাদের বন্ড সই দিতে হয়েছে যে, ১১ বছরের আগে কোনো অবস্থাতেই তারা চাকরি ছাড়তে পারবেন না। এর আগে চাকরি ত্যাগ করলে তাদের পেছনে প্রশিক্ষণ বাবদ বা তাদের গড়ে তুলতে সরকারের যে খরচ হয়েছে তা তাকে ফেরত দিতে হবে। তবে ১১ বছর চাকরির পর কেউ ইচ্ছা করলে চাকরি ছাড়তে পারবেন।
১১ বছর পর কিছু লোক চাকরি ছাড়তে পারেন, তখন শূন্যতা তৈরি হবে কি না জানতে চাইলে শৌকত আকবর বলেন, ‘সেই ব্যবস্থাও করে রেখেছি। ততদিনে তার বেতনও অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চাকরির বেতন অন্য যেকোনো চাকরির চেয়ে বেশি।’
প্রকল্পে যোগদানের পর দুই বছর প্রশিক্ষণ চলবে। এরপর চাকরি স্থায়ী হলে সেকশন লিড ইঞ্জিনিয়ার পদের বেসিক বা মূল বেতন হবে ৬২ হাজার ৪০০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতাসহ নানা ধরনের ভাতা যোগ হবে। কর্মীদের আকৃষ্ট করার জন্য ৪০ শতাংশ হারে প্রজেক্ট অ্যালাউন্স দেওয়া হচ্ছে। সব মিলে মোট বেতন দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) বাছাই প্রক্রিয়া শেষে যারা বিসিএস বিভিন্ন ক্যাডারে যোগ দেন তাদের প্রারম্ভিক মূল বেতন ২২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে শুরুতেই একটা ইনক্রিমেন্ট যোগ হয়ে মূল বেতন দাঁড়ায় ২৩ হাজার টাকার কিছু বেশি।
কারা প্রকল্পের বিভিন্ন পদে বাছাই হচ্ছেন জানতে চাইলে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত বুয়েটের শিক্ষার্থীরা এই চাকরিতে আসছেন। বুয়েট ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন।
দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে পদোন্নতি দেওয়া হয় সিনিয়রিটির ভিত্তিতে। বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসে পদোন্নতির ভিত্তি হবে লিখিত পরীক্ষা এমন প্রস্তাব ছিল সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়ায়। এ নিয়ে প্রবল আপত্তি তোলেন জুনিয়র কর্মকর্তারা। তাদের বক্তব্য ছিল, একবার পরীক্ষা দিয়ে তারা চাকরি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়ার জন্য তারা আবার পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। তাদের আরও যুক্তি ছিল, যে সিনিয়র কর্মকর্তারা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পাওয়ার বিধান চালু করতে চান তারা সারা জীবন পদোন্নতি পেয়েছেন সিনিয়রিটির ভিত্তিতে। সিনিয়ররা যদি সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতি পান জুনিয়ররা কেন পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পাবেন এ নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল প্রশাসনে। শেষ পর্যন্ত জুনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে নতি স্বীকার করে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতির বিধান থেকে সরে আসে সরকার।
এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, রূপপুরের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কীভাবে হবে। বিষয়টি জানার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরমাণু শক্তি কমিশনের রূপপুর প্রকল্প অফিসে মুখোমুখি হলে প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, পদোন্নতি পেতে হলে পরীক্ষায় বসতে হবে। পরীক্ষা দিয়ে ধাপে ধাপে পদোন্নতি নিতে হবে রূপপুরের কর্মকর্তাদের। একজন কর্মকর্তা নির্দিষ্ট পদে দীর্ঘদিন চাকরি করেও পরবর্তী পদের জন্য অযোগ্য হতে পারেন। কাজেই পদোন্নতির জন্য অবশ্যই পরীক্ষা দিতে হবে।
দেশের সাধারণ মানুষ কবে নাগাদ পরমাণু বিদ্যুৎ পাবে জানতে চাইলে শৌকত আকবর চুপ হয়ে যান। তার দৃষ্টি চলে যায় অফিস রুমের সুপরিসর জানালা ভেদ করে অসীম আকাশে। চুপচাপ মনে মনে যোগ-বিয়োগ করে জানালেন, সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের অক্টোবরে জ্বালানি আসবে। তারপর ধাপে ধাপে উৎপাদনে যাবে সবচেয়ে দামি এ প্রকল্প।
শৌকত আকবরের চেয়ারে বসেই টিএসসির পাশ দিয়ে যাওয়া মেট্রোরেল দেখা যায়। টিএসসির পূর্বপাশের দেবদারু গাছের ফাঁক গলে মেট্রোরেল দেখিয়ে প্রকল্প পরিচালক বললেন, ‘ভালো জিনিসের জন্য কারোরই তর সয় না। আমাদেরও সইছে না। আশা করি শিগগিরই এর দেখা মিলবে।’
পার্বত্য তিন জেলায় অভিযানের মুখে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৩৯ জঙ্গি পালিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরাম সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে বলে পুলিশের একটি সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে। সংস্থার একটি সূত্র বলছে, এ জঙ্গিদের সহায়তা করছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। তাদের ধরতে সহয়তা চেয়ে ভারতকে অনুরোধ জানানো হবে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। জঙ্গিরা যাতে ভারতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিএসএফ তৎপর বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশ থেকে পুরোদমে জঙ্গি নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। ইতিমধ্যে পুরনো জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাসহ অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে। তবে নতুন একটি সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালালেও তাদের সেই স্বপ্নপূরণ হবে না। কোমলমতি তরুণ-তরুণীদের তারা টার্গেট করেছে। তবে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে না কেউ। যারা ভুলে চলে গিয়েছিল তারা আবার ফেরত এসেছে। যারা আসেনি তাদের ধরতে পুলিশ ও র্যাব কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘পাহাড় অঞ্চলে এ সংগঠনের সদস্যরা আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। সেই আলোকে অভিযান চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তবে জঙ্গিদের হামলা বা তৎপরতা চালানোর শক্তি নেই। তাদের শক্তি খর্ব করা হয়েছে।’
পুলিশের ওই সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপাস্তরকে জানান, সম্প্রতি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শারক্বীয়ার শীর্ষ নেতা মহিবুল্লাহ ওরফে ভোলা শায়েখের কাছ থেকে নানা বিষয়ে তথ্য জানা যাচ্ছে। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে কারা কারা সহায়তা করছে সে ব্যাপারে মুখ খুলেছেন তিনি। আত্মগোপনে থাকা সদস্যরা কোথায় কোথায় অবস্থান করছেন সেই তথ্যও তিনি দিচ্ছেন। পুলিশের ওই সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে, মিজোরাম সীমান্তে অবস্থান করা শারক্বীয়ার ৩৯ সদস্যের মধ্যে সংগঠনটির আমির মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, অর্থ শাখার প্রধান এবং দাওয়াতি শাখার প্রধানও রয়েছেন। এ ছাড়া আছেন শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন, মোশারফ হোসেন, শামীম মাহফুজ। এর আগে শায়েখসহ ৪০ জন পার্শ্ববর্তী দেশে পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের ধাওয়া খেয়ে তারা ফের বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে চলে আসে। কেএনএফ পাহাড়ে শারক্বীয়াকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানাভাবে সহায়তা করছে।
গত বছর আগস্টে কুমিল্লা থেকে আট যুবক নিখোঁজের খবর আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। পরে জানা যায়, দেশের ১৯ জেলা থেকে নিখোঁজ হয়েছে ৫৫ জন। এ নিখোঁজ তরুণদের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নাম জানতে পারে। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ‘সামরিক বাহিনীর’ পোশাক পরিধান করে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণের ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পরে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। এ পর্যন্ত অর্ধশত সদস্যকে ধরা হয়েছে। গত বছর অক্টোবর থেকে র্যাব এ পর্যন্ত আটটি বড় ধরনের জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায়। অভিযানের একটি ছিল রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায়। ওই অভিযানে কেএনএফের তিন এবং শারক্বীয়ার সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম অঞ্চলে ১২ থেকে ১৩টি ক্যাম্প রয়েছে। কেএনএফ সদস্যরাই এসব ক্যাম্পে শারক্বীয়া সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। র্যাবের অভিযানের পর জঙ্গি সংগঠনটির দুটি দল বান্দরবানের সিপ্পি পাহাড়ের কাছে (রামজুদান ক্যাম্পে) প্রশিক্ষণ নেয়। পরে ওই পাহাড় থেকে দক্ষিণে অন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়।
পুলিশের ওই সংস্থাটি জানায়, শারক্বীয়া নেতা কারছের নেতৃত্বে থাকা ২১ জনের দলটি মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এই টিমের সদস্যরাই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ধাওয়ায় আবার বান্দরবানে ফিরে আসে। এদের মধ্যে মহিবুল্লাহ ছাড়া কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। মূলত তারা মিজোরামের শূন্যরেখায় অবস্থান করছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা অভিযানের মুখে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে তারা পাহাড়ি অঞ্চলেই রয়েছে। তাদের সর্বশেষ অবস্থান মিজোরাম সীমান্ত এলাকায় বলে চিহ্নিত করেছি। এদের গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে পাহাড়ি এবং দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় অভিযান শুরুর আগে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের কার্যক্রম শুরু করে। গত বছর সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা তাদের বিষয়ে তথ্য পাই। বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। তবে র্যাবের অভিযানের মুখে তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বর্তমানে তাদের কোনো হামলা চালানোর সামর্থ্য নেই। জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বাইরে থাকলেও তাদের মূল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় বড় কয়েকজন নেতাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এখন তাদের হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা নেই।
পুলিশ সূত্র জানায়, কেএনএফের সদস্যদের অনেকের বাড়ি ভারতের মিজোরামে। তারা সেখান থেকে দেশের পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য তারা অতি গোপনে দেশের সীমান্ত এলাকার পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তোলে। এরপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কেএনএফ সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে কয়েকজন পালিয়ে আসার পর বিষয়টি টের পায় র্যাব ও পুলিশ।
গত ৮ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় আবদুল হাদি ওরফে সুমন ওরফে জন (অর্থদাতা), আবু সাঈদ ওরফে শের মোহাম্মদ (অর্থদাতা) এবং দাওয়াতি কাজে যুক্ত রনি মিয়াকে। ৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রাজধানীর গুলিস্তান থেকে ধরা হয় গোলাম সারোয়ার (শারীরিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষক), সাকির মাহমুদ, ফরহাদ হোসেন, মুরাদ হোসেন ও ওয়াসিকুর রহমান ওরফে নাঈমকে। ১১ জানুয়ারি বান্দরবানের থানচি ও বেয়াংছড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে নিজাম উদ্দিন হিরণ ওরফে ইউসুফ, সালেহ আহমেদ ওরফে সাইহা, সাদিকুর রহমান সুমন ওরফে ফারকুন, বাইজিদ ইসলাম ওরফে মুয়াজ ওরফে বাইরু এবং ইমরান বিন রহমান শিথিল ওরফে বিল্লালকে। ২৩ জানুয়ারি ইয়াহিয়া গার্ডনের গহিন বনে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় মাসুদুর রহমান ওরফে রণবীর ওরফে মাসুদ (শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম ওরফে কয়কে। ৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের থানচির রেমাক্রি ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করে পুলিশ ও র্যাব।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মিজোরাম সীমান্তে ৩৯ জঙ্গি অবস্থানের বিষয়ে ভারতকে আমরা অবহিত করেছি। ওইসব জঙ্গি ধরতে ভারতের সহায়তা চাওয়া হবে। নতুন জঙ্গি সংগঠনটি নিয়ে আমরা উদ্বেগের মধ্যে আছি। তাদের যে চক্রটি সহায়তা করছে তারা ভয়ংকর প্রকৃতির। ইতিমধ্যে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে জঙ্গিরা কিছু একটা করার পরিকল্পনা নিয়েছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।’
চিনির দামে লাগাম টানতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে গতকাল রবিবার এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। চিনি আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, শুল্ক প্রত্যাহারের এ সুবিধা নিয়ে আমদানি করা চিনি আগামী মাসের (মার্চ) প্রথম ভাগে দেশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে ভারত থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন বা ১ কোটি ২৫ লাখ কেজি চিনি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ১১ জানুয়ারি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ চিনিও রমজানের আগে দেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ফলে আগামী রমজানে চিনির দাম বাড়বে না বলে মনে করছেন সরকারি নীতিনির্ধারকরা।
তবে বাজারসংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, অতীতে দেখা গেছে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কোনো না কোনো অজুহাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজারে চিনির দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে সাধারণ ক্রেতাকে কষ্টে ফেলেছে। তাই শুধু আমদানি করলেই হবে না বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। সরকারি চিনিকলগুলো বন্ধ থাকায় দেশের চিনির বাজার বেসরকারি খাতের মুষ্ঠিমেয় কিছু আমদানিকারকের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি খাত থেকে মূলত অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে দেশেই পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে। অনেকে আবার পরিশোধিত চিনিও আমদানি করে থাকে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের পঞ্চম সভায় আমদানি, সরবরাহ পরিস্থিতি ও বাজারমূল্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। ওই বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে যে গত ছয় মাসে প্রায় দুই লাখ টন চিনি কম আমদানি হয়েছে। মূলত ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারার কারণে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে টাস্কফোর্সের সভায় জানানো হয়। এতে রমজানে চাহিদার তুলনায় চিনির সংকট দেখা দিতে পারে। দাম আবারও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়। এ পরিস্থিতি এড়াতে টাস্কফোর্সের সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিনি আমদানি বাড়িয়ে চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক হার যৌক্তিকীকরণের জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়। সভায় আশা প্রকাশ করা হয়, আমদানি বাড়লে আসছে মাসের শবেবরাত ও রমজানে চিনির চাহিদা বাড়লেও দাম স্থিতিশীল থাকবে।
দেশের অন্যতম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ^জিৎ সাহা দেশ রূপান্তরকে বলেন, শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা নিয়ে চিনি আমদানি করা হলে তা দেশে পৌঁছতে মার্চের প্রথম ভাগ লাগবে। শুল্ক সুবিধায় আমদানি করা চিনি দেশের বাজারে ছাড়া হলে চিনির দাম স্থিতিশীল থাকবে কি না তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা তো শুনেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের সভায় বলা হয়েছে চিনি আমদানি কম হয়েছে। আশা করছি শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধায় আমদানি করা চিনি বাজারে ছাড়া হলে দাম স্থিতিশীল থাকবে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দেশ রূপান্তারকে বলেন, শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে অবশ্যই চিনির বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। তবে শুধু আমদানিতে সুবিধা দিলেই হবে না। কোনো অজুহাতেই যাতে সিন্ডিকেট করে বাজারে দাম বাড়ানোর সুযোগ না পায় তার নজরদারিও থাকতে হবে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সচেতন থাকতে হবে।
সম্প্রতি এক সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, সরকার রমজানে সব ধরনের পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চেষ্টা করছে। বাজার নিয়ন্ত্রণেও নজরদারি করা হবে। সাধারণ ক্রেতা যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে সে জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি চিনি আমদানিতে রাজস্ব সুবিধা দেওয়া হলে বাজানে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শুল্ক প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপন জারি করায় আগামী ৩০ মে পর্যন্ত আমদানিকারকরা বিনা শুল্কে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি খালাস করতে পারবেন। আগে প্রতি টন পরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৬ হাজার টাকা ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩ হাজার টাকা শুল্ক কর নির্ধারিত ছিল। এ ছাড়া অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩০ শতাংশ সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপিত ছিল। দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে এটি কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। এ সুবিধা চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে প্রতি টন চিনি আমদানিতে কাস্টম ডিউটি ৩ হাজার টাকা, সংরক্ষণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে চিনি আমদানি ডিউটি পড়ে প্রায় ৬১ শতাংশ।
কয়েক মাস থেকে দেশে চিনির সংকট চলছে। ক্ষেত্রবিশেষে ১২০ টাকা দিয়েও এক কেজি চিনি কিনতে পারেননি ভোক্তা এমন ঘটনাও আছে। এখনো সেই সংকট পুরোপুরি কাটেনি। উচ্চ দামেই বিক্রি হচ্ছে চিনি। এদিকে আসছে মাসেই রমজান। সারা বছর ১২-১৩ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে রমজান মাসে অন্য সময়ের তুলনায় চিনির চাহিদা বেড়ে যায়। এ মাসে চিনির চাহিদা দুই লাখ টন ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে এনবিআরসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূলত রোজায় নিরবচ্ছিন্ন চিনির সরবরাহ এবং দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সরকার চিনি কিনছে : ভারত থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন বা ১ কোটি ২৫ লাখ কেজি চিনি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ চিনির জন্য কেজিপ্রতি খরচ হবে ৫৬ টাকা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গত ১১ জানুয়ারি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভারতের কলকাতার শ্রীনোভা ইস্পাত প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন চিনি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জন্য এ চিনি কেনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে (ডিপিএম) এ চিনি কিনতে খরচ হবে ৭০ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি চিনি কিনতে খরচ হবে ৫৬ টাকা ২ পয়সা। এর আগে গত বছর ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ব্রাজিল থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন চিনি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। টিসিবির জন্য কেনা ওই চিনির জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৬৫ লাখ ৫২ হাজার ৬২৫ ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় ৬৫ কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৭ টাকা। প্রতি টন চিনির দাম ধরা হয় ৫২৪ ডলার। সরকারের কেনা এসব চিনিও রমজানের আগে দেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মাদক প্রবেশের সব থেকে বড় এ রুটকে সরকার মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে রূপরেখা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। গতকাল রবিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, কমিটির আগের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করার বিষয়টি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ আসে। গতকালের বৈঠকে ওই সুপারিশের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয় সভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করে চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করার বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির আগের বৈঠকে (গত ১৫ জানুয়ারি) সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী প্রসঙ্গটি তোলেন। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাছাকাছি অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদকে আক্রান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, ভারত থেকে হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে ঢুকছে। পরে তিনি সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক চোরাচালান রোধে নিিদ্র সীমান্ত নিশ্চিতকরণ, স্যাটেলাইট ইমেজারি প্রযুক্তি স্থাপন এবং চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
ওই বৈঠকে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী ও বৈঠকে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. ফখরুল আহসান মাদক ও অস্ত্র আটক, চোরাচালানে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার বিপদের কথা বলেন।
বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ডেটাবেজ তৈরি করা হয়। রোহিঙ্গা ডেটাবেজটি এনটিএমসিকে দেওয়া হলেও ২০১৮ সাল-পরবর্তী সময়ে তা হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে বর্তমানের ডেটাবেজ না থাকায় আইনপ্রয়োগকারী ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এতে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার বিষয়টি আবারও উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মাদক পাচার ও কারবারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যিনিই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এখানে বাস করতে হলে আমাদের দেশের আইন মানতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন কর্মকা- থেকে তাদের দূরে থাকতে হবে। এসব বন্ধ না করলে হয় তারা তাদের দেশে ফেরত যাবে, না হয় অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
তিনি বলেন, বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া কাটলেই গুলি চালায়। এখানে তারের বেড়া কাটলে আমাদেরও কঠোর হতে হবে। কক্সবাজার অঞ্চল মাদকপ্রবণ এলাকা বলেই এখানে সংসদীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানান।
কমিটির সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, মাদক পাচারের বিভিন্ন রুটের মধ্যে কক্সবাজার রুটেই বেশিরভাগ মাদক আসার কথা জানা যায়। বর্তমানে মাদক পাচার প্রায় তিনগুণ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২০ সালে একশর বেশি তালিকাভুক্ত মাদক পাচারকারী আত্মসমর্পণ করেছিল। যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারা আবারও এ পাচার কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার এলাকায় মাদক পাচার রোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বিশেষ ভাতার আওতায় আনার কথাও বলেন এ সদস্য।
পরে বৈঠকে কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদ জিরো পয়েন্টে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মাদক পাচারের বড় রুট হিসেবে এ পয়েন্টটি চিহ্নিত হয়েছে।
মাদক পাচারকারী, অবৈধ মাদক কারবারি, সব রোহিঙ্গা এবং মাদকের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিদের তালিকা তৈরির বিষয়ে অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয়ে মাদক কারবারিদের একটি সমন্বিত তালিকা তৈরির কার্যক্রম চলমান বলেও বৈঠকের অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মাদকের (ইয়াবা) চালান মিয়ানমার থেকে ওইদিক দিয়ে আসে (চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার)। সে বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল। মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করা হলে গুরুত্ব পায়। তবে সেটা ঘোষণা হলে একটা অ্যাটেনশন হবে ওখানে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে কি না। তাই বিষয়টি আলোচনার মধ্যে আছে।’
কভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে গেলেও তার সরকার দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলছি। আমরা বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছি। একদিন এই বাংলাদেশ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রবিবার তার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডা. এস এ মালেক স্মরণে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব অডিটরিয়ামে এ সভার আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যার পর এক দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে ডা. এস এ মালেকের অবদানের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যে কয়জন অবদান রেখে গেছেন তার মধ্যে ডা. এস এ মালেক একজন। অত্যন্ত বৈরী পরিবেশের মধ্যেও তিনি জাতির পিতার আদর্শকে সামনে নিয়ে এসেছেন এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও নেতাকর্মীদের শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের জানানোর বিষয়টি তিনি অনেক দক্ষতার সঙ্গে করে গেছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, তার লেখনীর মাধ্যমে জাতির পিতার আদর্শকে তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে সেটাও তিনি লিখে গেছেন। আমি মনে করি সেগুলো আমাদের জন্য একটা বিরাট সম্পদ হিসেবে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার, মানুষের মাঝে জনমত সৃষ্টি, লেখালেখি এবং সংগঠন করার ক্ষেত্রে তার অনেক অবদান রয়েছে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, স্কুলজীবন থেকে রাজনীতি করলেও তিনি কখনো আওয়ামী লীগের সভাপতি হবেন তা ভাবেননি। কিন্তু ১৯৮১ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে দল আমার অনুপস্থিতিতে সভাপতি করায় আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়েছিল।
তিনি বলেন, ড. মালেক ও মোহাম্মদ হানিফ তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কারণ তারা জনমত তৈরি করেছেন এবং দলীয় ফোরামে নিয়ে গেছেন। এমনকি তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য বারবার জোর দেওয়ার জন্য ডা. এস এ মালেককে তিরস্কার করেছিলেন বলেও উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আলোচনা সভায় সিনিয়র সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য অজিত কুমার সরকার ডা. এস এ মালেক ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-আলোয় আঁকা সাহসী মানুষের প্রতিকৃতি’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক এবং ডা. এস এ মালেকের ছেলে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন।
ডা. মালেককে রাজনীতি সচেতন হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে ডা. মালেকের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডা. মালেক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তার যুদ্ধক্ষেত্র কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এয়ার রেইড চলার সময়ও তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ডা. মালেক ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে রাজবাড়ী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন প্রসঙ্গে বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিবাদ করতে এবং তার আদর্শ জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্যই এর সৃষ্টি। কেননা সে সময় শেখ মুজিব নামটাও নিষিদ্ধ ছিল। আর মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েই জিয়াকে সেনাপ্রধান করার ৩ মাসের মধ্যে জিয়া ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলে এই বঙ্গবন্ধু পরিষদই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রচার করার প্রয়াস নেয়। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সৃষ্টির পেছনে ড. মতিন চোধুরীর বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে এর দায়িত্বে থাকা বেগম সুফিয়া কামাল, বিচারপতি কে এম সোবহানসহ অন্যদের অবদানকেও স্মরণ তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই এদেশকে গড়ে তুলছি। করোনা অতিমারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা প্রতিকূলতার মাঝে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখাই আমাদের প্রচেষ্টা। এজন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। ইনশাআল্লাহ এই বাংলাদেশ একদিন উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবেই গড়ে উঠবে।
তিনি মরহুম ডা. এস এ মালেকের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদকে সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গতকাল যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলোজি ডিপার্টমেন্ট অব ইনিওস ইনস্টিটিউটের অ্যান্টিমাইক্রোবাইয়াল রিসার্চের পরিচালক প্রফেসর টিমোথি ই ওয়ালশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি এ কথা বলেন।
বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে তার স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমের কাছে ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, ‘চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, একসময় দেশের বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হতো। কিন্তু এখন তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘এখন সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।’
অ্যান্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সবস্থানেই অ্যান্টিবয়োটিকের বিক্রি বন্ধ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
টিমোথি ই ওয়ালশ বলেন, অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল রেস্টিস্ট্যান্স (এএমআর) এখন বিশ্বে একটি মহামারী আকারে আবির্ভূত হয়েছে। এখনই যদি এটা বন্ধ করা না হয় তবে ভবিষ্যতে এটা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রফেসর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এর কারণে লাখো মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।’
এ সময় তিনি এএমআর বিষয়ক গ্লোবাল লিডার্স গ্রুপের কো-চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেন।
বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, হৃদরোগ, বক্ষব্যাধি, ক্যানসার ও নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের মতো বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ দেশের স্বাস্থ্য খাতে সার্বিক উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার কৃষি, মৌলিক বিজ্ঞান ও ওষুধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপের ব্যাপারে তিনি বলেন, বৃত্তি-উপবৃত্তি দেওয়ার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা বিশেষত পিএইচডি, পোস্ট-ডক্টরাল ও গবেষণাক্ষেত্রের জন্য ২০০টি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে।
বৈঠককালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ইনিওস ইনস্টিটিউট অব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রিসার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু-আইওআই ফেলোশিপের অধীনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার জন্য স্কলারশিপ প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী নীতিগতভাবে এই ফেলোশিপের ব্যাপারে তার সম্মতি প্রকাশ করেন।
এ ছাড়াও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ককাসের সঙ্গে এএমআর বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অংশীদারত্বের একটি প্রস্তাবও দেন টিমোথি ই ওয়ালশ এবং প্রধানমন্ত্রী এতে ইতিবাচক সাড়া দেন।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ্। বাসস
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
সৌদি আরবের আসির প্রদেশের আভা জেলায় বাস দুর্ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাগণকে আহত বাংলাদেশী নাগরিকদের চিকিৎসার সকল প্রকার উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
সৌদি আরবের জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের মতে, সোমবার সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় আসির প্রদেশের আভা জেলায় একটি ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় প্রায় ২৪ জন নিহত এবং প্রায় ২৩ জন আহত হয়।
বিকেল ৪টার দিকে আগাবত শার নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে যাত্রীদের অনেকেই বাংলাদেশী ছিলেন বলে জানা গেছে।
বাসটি ওমরাহ পালনরত হজযাত্রীদের নিয়ে পবিত্র নগরী মক্কায় যাচ্ছিল।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রেক সিস্টেমের ত্রুটির কারণে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় এবং আগুন ধরে যায়।
স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কনস্যুলেট প্রতিনিধিকে জানিয়েছে যে, মৃতদেহ পুড়ে যাবার এবং বিকৃত হবার কারণে তাদের জাতীয়তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়েছে।
তাই, উল্লিখিত দুর্ঘটনায় কতজন বাংলাদেশি মারা গেছে তা হাসপাতাল বা ট্রাফিক সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’