ব্যবসায়ী খোকন চৌধুরী ওরফে খোকন নন্দী। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, না ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় চার বছর সাত মাস ধরে তার মরদেহ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) মর্গে। দুই স্ত্রীর মধ্যে এ নিয়ে চলছে মামলা। প্রথম স্ত্রীর দাবি, খোকন নন্দী ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী। সে অনুযায়ী তার মরদেহ সৎকার করা হবে এবং তার সম্পদের উত্তরাধিকারীও তারা। দ্বিতীয় স্ত্রী বলছেন, খোকন অ্যাফিডেভিট করে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তার মরদেহ দাফন করা হবে। এ নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় এখন দুই পরিবার।
এদিকে, খোকনের মৃতদেহ নিয়ে বিপাকে রয়েছে ঢামেক হাসপাতাল মর্গ কর্র্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় লাশটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।’
ঢামেক হাসপাতাল মর্গের সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার সহকারী জজ আদালত (দেওয়ানি মামলা নম্বর ২৫২/১৪, ঢাকা) বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ও তদারকিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মরচুয়ারিতে খোকনের মরদেহটি সংরক্ষণের আদেশ দেয়। এরপর চার বছর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও মরদেহটি হিমঘরে পড়ে রয়েছে। মর্গ সহকারী সেকান্দার জানান, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে বারডেম কর্র্তৃপক্ষ ব্যাগে ভরে মরদেহটি ঢামেকের মর্গে দিয়ে যায়। এর পর থেকে মরদেহটি ডিপ ফ্রিজে রাখা আছে। মরদেহের দাবিদার কেউ হাসপাতালে আসেননি। মাঝেমধ্যে আত্মীয় বা বন্ধু পরিচয়ে দু-একজন এসে মরদেহটি দেখে যান।
মর্গের সহকারীরা আরও জানান, ২০১৪ সালের ১৪ জুন দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আক্তার ওরফে বাবলির বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে খোকন চৌধুরীকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ২৬ জুন ৭৮ বছর বয়সী খোকন মারা যান। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে স্বামীর মরদেহ দাফনের উদ্যোগ নেন বাবলি। এতে বাধা দেয় খোকনের প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী এবং দুই সন্তান বাবলু নন্দী ও চন্দনা নন্দী। সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকারের জন্য মরদেহ নিয়ে যেতে চান তারা। এই প্রেক্ষাপটে ঘটনাস্থলে যায় রমনা থানার পুলিশ। তারাও বিষয়টির সমাধান করতে না পেরে দেওয়ানি আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এরপর আদালতে মামলা হয়। সেই মামলা এখনো চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই পরিবারের দাবি ও মরদেহ নিয়ে টানাহেঁচড়ার মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বিপুল সম্পত্তি। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তিনতলা মার্কেটসহ শত কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির মালিক ছিলেন খোকন। এই সম্পত্তি দখলে রাখতে প্রথম স্ত্রী ও তার ছেলেমেয়ে ব্যাপক তৎপর। খোকনের জীবনযাত্রাও ছিল রহস্যঘেরা। দুই পরিবারের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ছিল। শেষ দিকে রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। ওই এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তেন এবং ঈদুল আজহার সময় গরু কোরবানি করে এলাকায় মাংসও বিতরণ করতেন তিনি। প্রথম স্ত্রী ও তার দুই সন্তান থাকতেন রায়েরবাজারের বাসায়; সেখানেও যাতায়াত ছিল খোকনের। সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী তাদের সঙ্গে পূজা-পার্বণে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় মন্দিরেও যেতেন তিনি।
গতকাল শনিবার বাবলি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খোকনের এক ভাইয়ের সঙ্গে তার প্রথম স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। পারিবারিক অশান্তির কারণে ওই সংসার ত্যাগ করেন তিনি। এমনকি তার ছেলে বাবলুকে কোনো দিন সন্তান বলে স্বীকার করেননি। তবে চন্দনাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করতেন।’ তিনি আরও জানান, পল্টনে এক চটপটির দোকানে পরিচয়ের পর ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই খোকনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আর বিয়ের আগে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অ্যাফিডেভিট করে খোকন নন্দী ধর্মান্তরিত হন; নাম রাখেন খোকন চৌধুরী। তাদের বিয়ের কাবিননামা ও অ্যাফিডেভিট আছে। আদালতে সব নথিপত্র উপস্থাপন করেছেন বলেও জানান তিনি।
বাবলি আরও জানান, খোকন জীবিত থাকার সময় তার চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই জহরলাল নন্দী ও সাগর নন্দী উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় যাতায়াত করতেন। শ্বশুরবাড়ির অন্য আত্মীয়রাও আসতেন। স্থানীয় লোকজন খোকন চৌধুরীকে মুসলমান হিসেবেই জানতেন এবং খোকা ভাই নামে ডাকতেন। শাহজাহানপুরের বাসায় তারা ১৮ বছর ছিলেন। তাদের কোনো সন্তান নেই। তিনি বলেন, ‘খোকনের লাশ পড়ে থাকার মূল কারণ ধর্মীয় নয়, বরং সম্পত্তি দখল। তার প্রথম স্ত্রীর লোকজন ও ভাইয়েরা আদালতে শুধু সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করে। তারা মার্কেটের ভাড়া তোলে, ইচ্ছেমতো অগ্রিম নিয়ে দোকানপাট ভাড়া দেয়। অথচ তার লাশটি সাড়ে চার বছর ধরে পড়ে আছে, সেটা দাফনের বিষয়ে কারও কোনো উদ্যোগ নেই।’ তিনি জানান, আদালতে তার পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে প্রথম স্ত্রীর পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বাবলুকে খোকন সন্তান হিসেবে অস্বীকার করতেন, বিষয়টি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব। কিন্তু তারা বাবলুর ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজি হচ্ছে না। ধর্মান্তরিত হলেও ব্যবসার প্রয়োজনে খোকন তার আগের নাম খোকন নন্দীই ব্যবহার করতেন। নিজেকে অসুস্থ উল্লেখ করে বাবলি জানান, স্বামীর মরদেহ তিনি দাফন করতে চান। এ বিষয়টি দ্রুত সুরাহার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধও জানান তিনি।
খোকনের প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দীর সঙ্গে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মরদেহের দাবিদার হিসেবে করা আবেদনেও তার কোনো ফোন নম্বর বা যোগাযোগের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এদিকে, বাবলুর বরাত দিয়ে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট’-এর এক ব্যবসায়ী জানান, বাবার মরদেহের শেষকৃত্য না হওয়ায় পরিবারের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তারা নানা সমস্যায় পড়ছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হন চন্দন কুমার চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন নামে এক শিক্ষক। ওই ঘটনায় পলি আক্তার নামে তার মুসলিম স্ত্রী ও তিথি চক্রবর্তী নামে সনাতন ধর্মের অনুসারী স্ত্রী মরদেহ দাবি করেন। ওই মামলার রায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগকে চন্দনের মরদেহ জনস্বার্থে দেওয়ার আদেশ দেয় আদালত।