প্রশ্নফাঁস বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগের পরও গতকাল শনিবার এসএসসির প্রথম দিনের পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। গতকাল বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা শুরুর ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর ফেইসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে প্রশ্নের ছবি পোস্ট দেওয়া হয়। পরে সেই প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্ন মিলিয়ে দেখা গেছে, বহুনির্বাচনী পুরোপুরি না মিললেও বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের হুবহু মিল রয়েছে। ওই পোস্টে প্রশ্ন ‘ফাঁস’ করার উদাহরণ দেখিয়ে পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নের জন্য টাকাও চাওয়া হয়েছে।
এদিকে, গতকালের পরীক্ষায় অন্তত চারটি শিক্ষা বোর্ডের ১৭টি কেন্দ্রে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয় নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের। তবে কেন্দ্রগুলোর সব পরীক্ষার্থীই এই ভুলের শিকার হয়নি। পরীক্ষা শেষে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ ছাড়া ঢাকা বোর্ডের বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ‘ক’ সেটে লেখা ছিল, ‘১০১৯ সালের সিলেবাস অনুযায়ী’। এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক বলেন, ‘এটা প্রিন্টিং মিসটেক। এটা মারাত্মক কোনো ভুল নয়। বিজি প্রেসে যারা প্রশ্নপত্র ছাপায় তাদেরই সতর্ক হতে হবে। এ ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আমরা প্রশ্ন ছাপিও না, প্রশ্ন দেখিও না।’
ঢাকাসহ কয়েকটি বোর্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির প্রধান অধ্যাপক জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোথাও ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে কি না, তা এখনো আমাদের অবহিত করা হয়নি। বিষয়টি জানার পর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনলাইনে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এবার এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যে কোনোভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া সম্ভব নয়। যদি পরীক্ষা চলাকালীন প্রশ্ন ফেইসবুকে আসে তবুও সেটা আসল নাকি নকল তা দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘অবশ্য নিয়ম আছে কোনো পরীক্ষার্থী এক ঘণ্টা পরীক্ষায় অ্যাটেন্ড (অংশ নেওয়া) করে চাইলেই কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। হয়তো এমনটিই হয়েছে। কোনো পরীক্ষার্থী এক ঘণ্টা কেন্দ্রে ছিল, পরীক্ষা দিয়েছে, বের হয়ে এসে সেই প্রশ্নের ছবি তুলে ফেইসবুকে দিয়েছে।’ অধ্যাপক জিয়াউল আরও বলেন, ‘তবে আজই হয়তো আমরা একটা নির্দেশনা দেব কেউ এক ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে যদি বের হয়ে আসতে চায়, তাহলে তাকে প্রশ্ন কেন্দ্রে জমা রেখে আসতে হবে।’
রাজধানীর আশকোনায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘দেশের কোথাও এই ধরনের তথ্য পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার পরীক্ষার্থী ২১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৩৩ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ৭০ হাজার ৪১১ জন ও ছাত্রী ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৮৯২ জন। সারা দেশের ২৮ হাজার ৬৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ৩ হাজার ৪৯৭টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছে। বিদেশে কেন্দ্র রয়েছে ৮টি, যেখানে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩৪ জন। গতকাল সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে বাংলা প্রথম পত্র ও মাদ্রাসা বোর্ডে কোরআন মজিদ পরীক্ষায় ১০ হাজার ৩৮৭ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। এ ছাড়া পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছে ২৪ জন।
ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
চট্টগ্রাম : অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্রে এ শিক্ষা বোর্ডের ৭টি কেন্দ্রের নিয়মিতদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রগুলো হলো নগরীর ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় এবং গরীবে নেওয়াজ বিদ্যালয়, কক্সবাজারের পেকুয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, উখিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং উখিয়া পালংখালী উচ্চ বিদ্যালয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুব হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র সচিবদের ভুলের শিকার পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর সংগ্রহ করছি, যাতে কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষতি না হয়।’
জামালপুর : সদর উপজেলার কেন্দুয়ায় বাংলাদেশ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ২১৩ জন, বকশীগঞ্জের উলফাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৯৫ জন, ইসলামপুরের সরকারি নেকজাহান পাইলট মডেল হাই স্কুলে ২০০ জনকে অনিয়মিতদের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। তবে ২০ মিনিট পর বাংলাদেশ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের তা পাল্টে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির বলেন, ‘বিষয়টি বোর্ড কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। যে প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেভাবেই পরীক্ষার মূল্যায়ন করা হবে এবং এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মুন্সীগঞ্জ : শহরের এ ভি জে এম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৮৭ জন নিয়মিত পরীক্ষার্থীর মধ্যে অনিয়মিতদের প্রশ্নপত্র বিলি করা হয়। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিউলী আক্তার জানান, ‘কেন্দ্রের দুটি কক্ষে শহরের কে কে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউশন ও মুন্সীগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নিয়মিতদের মাঝে অনিয়মিতদের প্রশ্নপত্র বিলির বিষয়টি বোর্ড কর্র্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) : বৈদ্যেরবাজার এন এ এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সোনারগাঁ জি আর ইনস্টিটিউশনের ২০ পরীক্ষার্থীর বহুনির্বাচনী পরীক্ষা ভুল প্রশ্নপত্রে নেওয়া হয়েছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রধান জানান, ‘দুই-একজন পরীক্ষার্থীর প্রশ্ন বিতরণে ভুল হয়েছিল। তাৎক্ষণিক বদলে দেওয়া হয়েছে। যদি এ ধরনের ভুল হয়ে থাকে তাহলে তা যাচাই করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
মানিকগঞ্জ : দৌলতপুর উপজেলার পিএস সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুরাতন সিলেবাসে ৬০০ জনের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশ্ন পাওয়ার পর বিষয়টি কেন্দ্র সচিব, হল-সুপার ও শিক্ষকদের জানানো হলেও তারা ওই প্রশ্নেই পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেন। পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে কেন্দ্র সচিব মিজানুর রহমান ও হল-সুপার মজিবর রহমান ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সুরাহা করার আশ্বাস দেন। কেন্দ্র সচিব বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষ এই প্রশ্নেই পরীক্ষার ফল প্রদান করবে বলে জানিয়েছে।’
মাদারীপুর : কালকিনি উপজেলার খাসেরহাট সৈয়দ আবুল হোসেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রতিবাদে পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা কালকিনি-খাসেরহাট সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলামের আশ্বাসে তারা অবরোধ তুলে নেয়। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এ বিষয়ে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে। আশা করছি সমস্যা সমাধান হবে।’
সাতক্ষীরা : কালীগঞ্জ উপজেলার চাম্পাফুল এপিসি স্কুল কেন্দ্রে ৪৮ জনের পুরনো সিলেবাসের প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় কেন্দ্র সচিব সুখলাল বাইনকে বরখাস্ত ও প্রায় তিন ঘণ্টা পর নতুন প্রশ্নপত্রে ফের তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়।
বাগেরহাট : শহরের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের ২০১৮ সালের সিলেবাস অনুযায়ী বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। তবে এজন্য তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন দায়িত্বরত শিক্ষকরা।
গাইবান্ধা : পলাশবাড়ী উপজেলার পবনাপুর ইউনিয়নের ফকিরহাট দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১১০ জনের পুরনো সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। ইউএনও মেজবাউল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এ ঘটনায় কেন্দ্র সচিব বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম সরকারকে অব্যাহতি দিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।