মার্কিন জনগণ নভেম্বরের ৩ তারিখে শুধু প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকেই ভোট দেবেন না, নির্বাচিত করবেন সিনেট এবং হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ সদস্যদেরও। মিলিতভাবে সিনেট এবং হাউজকে বলা হয় কংগ্রেস, যদিও কংগ্রেসম্যান শব্দটা প্রচলিত শুধু হাউজ সদস্যদের বোঝাতে। সিনেট সদস্যদের যথাযথ সম্বোধন সিনেটর।
ব্যালটে থাকছে স্টেট বা অঙ্গরাজ্যের সিনেটর এবং হাউজ সদস্য পদপ্রার্থীদেরও নাম। তাই নভেম্বরের ৩ তারিখের পরে বদলে যেতে পারে সিনেটর এবং কংগ্রেস সদস্যদের দলভিত্তিক সংখ্যা।
বর্তমানে সিনেট রয়েছে রিপাবলিকানদের হাতে আর হাউজ ডেমোক্রেটদের কব্জায়। সিনেটে রিপাবলিকানদের মেজরিটি ২০১৪ থেকে। কেন্টাকির মিচ ম্যাককোনেল হচ্ছেন মেজরিটি লিডার। আর হাউজ ডেমোক্রেটদের দখলে আসে পুনর্বার দুই বছর আগে ২০১৮-এর মধ্যবর্তী নির্বাচনে। রিপাবলিকানদের কাছে চলে গিয়েছিল ২০১০-এর নির্বাচনে। হাউজের ৪৩৫ জন সদস্য প্রতিবার দুই বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। অঙ্গরাজ্যের সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয় জনসংখ্যার অনুপাতে। ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে বেশি, বর্তমানে ৫৩। আর আলাস্কা, ডেলাওয়ার, মনটানা, নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটা, ভারমন্ট আর ওয়াইয়োমিংয়ে সবচেয়ে কম, মাত্র একজন করে।
২০১৮-তে ২৩২ জন সদস্য ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত হন, ন্যান্সি পেলোসি নির্বাচিত হন স্পিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ট্রাম্পকে ইম্পিচমেন্টের (অভিশংসন) মুখোমুখি করেন তারা। ট্রাম্পের নানাবিধ নীতিবিবর্জিত কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার এবং কংগ্রেসের কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ আনেন তারা। কিন্তু হাউজে ইম্পিচ করলেই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায় না। সিনেটে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্টকে দোষীসাব্যস্ত হতে হবে, পদচ্যুত করতে হলে। যা সম্ভব হয়নি ট্রাম্পের ক্ষেত্রে। মাত্র একজন রিপাবলিকান সিনেটর, ইউটাহর মিট রমনি, ট্রাম্পের বিপক্ষে দুটো অভিযোগের মধ্যে একটাতে ভোট দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পসহ তিনজন অভিশংসিত প্রেসিডেন্টের কারও বিরুদ্ধেই সিনেট চূড়ান্ত রায় দেয়নি। অন্য দুজন হচ্ছেন বিল ক্লিনটন (১৯৯৮) আর অ্যান্ড্রু জনসন (১৮৬৮)। সিনেটে বর্তমানে রিপাবলিকানরা ৫৩ জন আর ডেমোক্রেটরা ৪৭। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ডেমোক্রেটদের নেই।
সিনেটেও হাউজের মতোই লেজিসলেটিভ (আইনপ্রণয়নকারী) ব্রাঞ্চের অংশ। তবে সিনেটের ক্ষমতা, প্রভাব আর প্রতিপত্তিতে পার্থক্য আছে, সিনেটের দাপট বেশি। যেমন ইম্পিচমেন্টের শেষ সিদ্ধান্তটা সিনেটের এখতিয়ারে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে প্রেসিডেন্টের মনোনয়ন পাওয়ার পর সিনেটই নিয়োগ চূড়ান্ত করে। সিনেটের সদস্য সংখ্যা প্রতি অঙ্গরাজ্যে দুজন করে মোট ১০০ জন। সিনেটররা নির্বাচিত হন ছয় বছরের মেয়াদে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচন হয় প্রতি দুই বছর অন্তর। এবারে (২০২০-এ) ৩৫টি আসনে নির্বাচন হচ্ছে।
হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে এবারও ডেমোক্রেটরা তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে, নমুনা জরিপে সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে প্রায় শতভাগ। তাদের সদস্য সংখ্যা ২৩২ থেকে বেড়ে ২৪০-এর কাছাকাছি যেতে পারে। ৪৩টি আসনের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২২ জন রিপাবলিকান। ১০ জনের ডেমোক্রেটদের কাছে হারার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তিন-চারজন ডেমোক্রেটিক সদস্যও রিপাবলিকানদের কাছে আসন হারাতে পারেন।
তবে হাউজ নয়, এবারের নির্বাচনে বেশ কয়েকটা সিনেট সিটে বড় ধরনের চমকের প্রতীক্ষায় আছেন পর্যবেক্ষকরা। ৩৫টির মধ্যে ২৩টিতে রিপাবলিকানরা লড়ছেন পুনর্নির্বাচিত হতে। এর মধ্যে আটটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। অ্যারিজোনা, কলোরাডো এবং মেইনে সিনেটের সদস্যপদ ডেমোক্রেটদের হাতে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বাকি পাঁচটির দুটি জর্জিয়ায়, একটি আইওয়ায়, একটি মনটানায় এবং একটি নর্থ ক্যারোলিনায়। মোটামুটি সবগুলোই ‘হালকা লাল’ (দুর্বল রিপাবলিকান) অঙ্গরাজ্যে। এগুলোতে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে রিপাবলিকান সিনেটর প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনাও কমে গেছে। এছাড়া আরও তিনটি (কানসাস, সাউথ ক্যারোলিনা, টেক্সাস) আসনে রিপাবলিকানদের অবস্থা কিছুটা নাজুক। তাই দেখা যাচ্ছে, এদের অনেকেই ট্রাম্পের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেওয়া থেকে সযতনে বিরত থাকছেন। কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। নেবরাসকার একজন সিনেটর বেন স্যাস প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন, যদিও তার আসন মোটামুটি সুরক্ষিত।
একমাত্র ডেমোক্রেটিক সিনেটর যিনি রিপাবলিকানদের কাছে আসন হারাতে পারেন তিনি হচ্ছেন আলাবামার ডগলাস জোনস। তাই সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য সংখ্যা বেড়ে ৫০ হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা। কিন্তু এতে তারা পুরোপুরি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না। তবে কমলা হ্যারিস যদি বাইডেনের টিকিটে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, পদাধিকারবলে তিনি হবেন সিনেটের প্রেসিডেন্ট এবং প্রয়োজনে নির্ধারক (টাইব্রেকিং) ভোটটি দেওয়ার ক্ষমতাধারী। কোনোরকমে ৫১টি বা তার বেশি আসন পেলে এ সমস্যা আর থাকছে না।
হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ডেমোক্রেটদের কর্র্তৃত্বে থাকবে, এটি প্রায় নিশ্চিত। হোয়াইট হাউজও জোসেফ বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ডেমোক্রেটদের হাতে আসছে। সিনেটও যদি আসে তবে ২০২০ ডেমোক্রেটদের জন্য সুবর্ণ বছর হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হবে।
সিনেট এবং হাউজ ছাড়াও ১১টি অঙ্গরাজ্যে গভর্নররাও আছেন ব্যালটে। বর্তমানে মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ২৪ জন ডেমোক্রেটিক পার্টির, ২৬ জন রিপাবলিকান। ১১ জন পুনর্র্নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে সাতজন রিপাবলিকান। মিসৌরির মাইক পারসনের অবস্থা অন্য রিপাবলিকানদের মতো অতটা নিশ্চিত নয়। মনটানায় ডেমোক্রেটদের হাত থেকে গভর্নরের পদটা রিপাবলিকান পার্টির হাতে চলে যেতে পারে। বাকি সবারই পরবর্তী চার বছরের জন্য পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এরা মিডিয়ার আলোচনায় আসছেন না খুব একটা।
সারা দেশে ইলেকটোরাল কলেজে ভোটের সংখ্যা হচ্ছে ৫৩৮, এর সঙ্গে সিনেট এবং হাউজের সদস্য সংখ্যার সম্পর্ক রয়েছে। সিনেটের ১০০, হাউজের ৪৩৫ আর রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ৩ জন, সব মিলে ৫৩৮। এর মধ্য থেকে কমপক্ষে ২৭০টি ভোট পেতে হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য। নির্বাচনের পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এক সময়ে ইলেকটররা (সিনেটর বা হাউজ সদস্যরা নন, দলানুগতদের মধ্য থেকে মনোনীত প্রতিনিধি যারা সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রতীকী ভোট দেওয়ার দায়িত্ব এবং সম্মান পান) নিজ অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে মিলিত হয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পক্ষে পূর্বনির্ধারিত প্রতীকী ভোট প্রদান করেন।
স্টেটওয়ারি ইলেকটোরাল কলেজের ভোটসংখ্যাও একইভাবে নির্ধারিত হয়। যেমন ফ্লোরিডায় ২৭ জন হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ সদস্য আর দুজন সিনেটর মিলে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট সংখ্যা হচ্ছে ২৯। ফ্লোরিডায় যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাবেন তিনি এই ২৯টি ভোটের সবকটিই পেয়ে যাবেন। একইভাবে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের ভোটও বণ্টিত হবে। ব্যতিক্রম শুধু দুটিতে নেবরাসকা আর মেইনে। এ দুই অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী রাজ্যব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তিনি দুটি ভোট পাবেন অবধারিতভাবে। বাকি ভোটগুলো (নেবরাসকায় ৩ আর মেইনে ২) এলাকাভিত্তিক বা কংগ্রেসন্যাল ডিস্ট্রিক্টের ভোটের ওপরে নির্ভরশীল। যে যেই এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন, তিনি সেই ইলেকটোরাল কলেজ ভোটটিও পাবেন। একটি বা দুটি হলেও এ ভোটগুলো মূল্যবান। কারণ নেবরাসকা ও মেইন, এই দুই অঙ্গরাজ্যেই একটি করে ডিস্ট্রিক্ট রয়েছে যেগুলোতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ২০২০-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। অধিকাংশ জরিপের আভাস অনুযায়ী নেবরাসকায় এগিয়ে আছেন বাইডেন কিছুটা, কিন্তু মেইনে দুজনই প্রায় সমান সমান।
ইমেরিটাস প্রফেসর, ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
Irtishad@gmail. com
নভেম্বর ১, ২০২০।