শুক্রবারের আড্ডায় আজকের অতিথি হয়ে এসেছেন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী। তিনি একাধারে স্বনামধন্য চিকিৎসক, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ। তার সঙ্গে আড্ডায় অংশ নেন সহকারী সম্পাদক তাপস রায়হান, মহাব্যবস্থাপক সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মো. হারুনের রশীদ, হেড অব সেলস মিজানুর রহমান ও সহ-সম্পাদক মাসিদ রণ
তাপস রায়হান : আপনাকে ত্রিরত্ন বললে ভুল হবে না! একাধারে স্বনামধন্য চিকিৎসক, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ। কোন পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : প্রথমেই দেশ রূপান্তরকে ধন্যবাদ আমাকে এমন চমৎকার একটি আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। নিজের সম্পর্কে এত প্রশংসা শুনতে একটু বিব্রতই লাগে। আমি এত প্রশংসার যোগ্য কিনা জানি না। তবে এটা ঠিক যে, আমি প্রতিনিয়ত মানুষের কল্যাণের কথা ভাবি। মানুষের জন্য কিছু করার স্বাদ অনেক, অতি ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যতটুকু পারি, পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। তবে যে তিনটি পরিচয় দিলেন তার মধ্যে একটি যদি পছন্দ করতে হয়, তবে অবশ্যই আমি চিকিৎসা পেশাকেই বেছে নেব। চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেই সবচেয়ে গর্বিত মনে করি। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। আজকে আমি যা যা করছি, অন্য যেসব অর্জন কিংবা পরিচয় আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তার সবই হয়েছে আমি একজন চিকিৎসক বলেই। আমি যেখানেই যাই, একজন চিকিৎসক বলেই হয়তো সবাই আমাকে আলাদা সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে থাকেন। এই আড্ডায় আসার আগেই, গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় গিয়েছিলাম। আমি দেখা করতে চাই জানতে পেরেই, একটুও কালক্ষেপণ না করে তারা আমাকে সময় দিয়েছেন। এটা হয়েছে আমি চিকিৎসক বলেই।
মাসিদ রণ : কেউ সফল হওয়ার পর তার অবস্থান সম্পর্কে আমরা সবাই জানতে পারি। কিন্তু এই সফলতার পেছনে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর গল্প থাকে। অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক গল্পও থাকে। আপনার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠার দিনগুলো সম্পর্কে জানতে চাই...?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : ধন্যবাদ, নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে এই জায়গাটুকু আমার বিশেষ পছন্দ। খুব ভালো লাগে ছোটবেলার সেই গল্পটুকু বলতে। অনেককে দেখেছি যারা সফল হওয়ার পর শেকড় ভুলে যায়। কিন্তু আমি কখনোই তা চাই না। আমার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায়। এটি তখন অত উন্নত না থাকলেও এখন শহরের সব সুবিধাই বিদ্যমান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের গ্রাম হবে শহর। সেই কথার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আমার গ্রাম। এখানে রাত হলে ঝিঁঝি পোকার ডাকও শোনা যায়, আবার ঘর থেকে বের হলেই কবিরের দোকানে ক্যান কোকও পাওয়া যায়! আমার পিতা স্বর্গীয় আশুতোষ চক্রবর্ত্তী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯৯৭ সালে। মা পুষ্প চক্রবর্ত্তী গৃহিণী। আমি এখনো তার সঙ্গেই থাকি। ছয়টি বোনের একটি মাত্র ভাই আমি। সবার বড় বোন প্রীতি চক্রবর্ত্তী (সিআইপি), তাকে আপনারা চিনবেন। দেশের একজন প্রখ্যাত নারী উদ্যোক্তা এবং তিনবারের মতো এফবিসিসিআইয়ের পরিচালকের দায়িত্ব আছেন। আমরা প্রতিটি ভাইবোনই ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় ভালো। ছোট বোন সম্মিলিত মেধা তালিকায় দুবার স্ট্যান্ড করেছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার কিছু বন্ধু সব সময় পাশে আছে। তারা প্রতিটি কাজে অনুপ্রাণীত করে আসছে। সঞ্জিব, তানু, মোবারক, নারায়নসহ আরও অনেকে। আমিও ক্লাস ফাইভ আর এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। স্থানীয় সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এসএসসি পাস করি। এরপর ১৯৯২ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে স্টার মার্কসসহ প্রথম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হই। পরবর্তী সময় সরকারি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০০ সালে এমবিবিএস পাস করি।
মাসিদ রণ : পেশা জীবন শুরু কোথায়?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : এমবিবিএস পাস করে ঢাকায় চলে আসার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ভালো চাকরি পেয়ে যাই নিজ এলাকাতেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্রিস্টিয়ান মেডিকেল সেন্টারে (মিশন হাসপাতাল) চিফ মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করি। এটি খুবই ঐতিহ্যবাহী একটি চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। বিদেশিরা পরিচালনা করত। কিন্তু কি একটা ক্রাইসিসের কারণে তারা আর চালাতে পারছিল না। তখন একটা সার্কুলার আসল, যদি কেউ চালাতে পারে তাদের ছয় মাসের একটি পাইলট প্রজেক্ট দেবে। যদি চালাতে পারে তো কন্টিনিউ করবে, না পারলে আর করবে না। তখন আমার শিক্ষক প্রফেসর এবিএম খুরশিদ আলম (বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) আমাকে জানালেন, তোমাদের এলাকায় ওই হাসপাতালে ডা. নিয়োগ দিচ্ছে, তুমি চাইলে অ্যাপ্লাই করতে পার। আমি শুরুতে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না, কারণ আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এত পুরনো হাসপাতালে সুযোগ পাব কিনা। কিন্তু স্যারের অনুপ্রেরণায় ইন্টারভিউ দিলাম। তিনি আমাকে খুব সুন্দর একটি সার্টিফিকেট দিলেন ইন্টার্নশিপের। আমিই প্রথম নন ক্রিশ্চিয়ান বাঙালি হিসেবে সেখানে উচ্চপদে বসি। এটি আমার জীবনের একটি স্বর্ণালি অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করি। চিকিৎসক জীবনের শুরুতেই এমন চমৎকার একটি পরিবেশ পেয়েছিলাম। গর্ব করেই বলি, মেডিকেল সেবার দিক দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানরা বেস্ট। কারণ আমি নিজ চোখে সেটি দেখেছি। প্রকৃত অর্থেই সেবার মনোভাব রয়েছে তাদের। সেখানে এলাকার এলিট শ্রেণি থেকে শুরু করে কর্মজীবীরাও আসত চিকিৎসা নিতে। চার বছর সুনামের সঙ্গে কাজ করি সেখানে। আমার হাতে ওই সময়ে সাড়ে ৫ হাজার শিশুর জন্ম। তাদের অনেকের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রয়েছে। কারও কারও বিয়ে পর্যন্ত খেয়েছি। অনেকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অনেক নেতিবাচক কথা বলে, নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। কিন্তু সেখানে মিশনারি হাসপাতালে কাজের সুবাদে আমাকে সাধারণ মানুষ অনন্য সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করত।
মাসিদ রণ : আপনার বিয়ের গল্পটিও তো বেশ মজার...
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : হ্যাঁ। মিশনারি হাসপাতালে পেশাজীবন শুরুর কয়েক বছর পরই বিয়ে করি। আমার শ^শুরবাড়ি ময়মনসিংহ। শ^শুরমশাই ভূপতিভূষণ দেবনাথ পিডিবির এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তার ছোট মেয়ে নিতুকে আমি বিয়ে করি। আমার বিয়েটাও হয় ওই মিশন হাসপাতালের মধ্যেই। পুরো ক্যাম্পাসটা আলোকিত ছিল বিয়েতে। সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, আমার বিয়েতে কয়েকশ রোগীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমরা যে ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে কথা বলি, এ জায়গাটিতে আমি খুব লাকি। কারণ আমার সঙ্গে আমার রোগীদের সব সময়ই সুসম্পর্ক বিদ্যমান। এখন যে শার্টটি পরে আছি, সেটিও এক রোগীর গিফট। আমি জানি যে, সবার জীবন বাঁচাতে পারব না বা সবাইকে সমান অ্যাটেনশন দিতেও পারব না। কিন্তু আমার দ্বারা যেন কারও কোনো ক্ষতি না হয় এটি আমার জীবনের একটি ব্রত।
তাপস রায়হান : ঢাকা এলেন কবে?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : বিয়ের দুমাস পরেই ঢাকা চলে আসি। যদিও আমাকে মিশন হাসপাতাল থেকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। আমার বস ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পোদ্যোক্তা স্যামসন এইচ চৌধুরী। তিনি আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, তুমি কি কোনো কারণে মন খারাপ করে চাকরি ছাড়ছ? তোমার কী লাগবে আমাকে বলো। তখন তাকে আমি আসল ঘটনাটি খুলে বলি যে, আমার বড় বোন একটি হাসপাতাল কিনেছে মহাখালীতে, সেটিতে কাজ করব। এ কথা শুনে তিনি আমার ফেয়ারওয়েলে যেতে রাজি হন। যা হোক, ঢাকাতে এসে আয়েশা মেমোরিয়াল হাতপাতালের ফাউন্ডার ডিরেক্টর হিসেবে জয়েন করি। চাকরির শুরুতে যেমন মিশন হাসপাতালকে ডুবন্ত অবস্থায় পেয়েছিলাম, এই হাসপাতালটিরও ছিল একই দশা। যেদিন জয়েন করি রোগীর সংখ্যা ছিল শূন্য। এখানেও নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করতে হয়। প্রথমেই আমি এলাকা সার্ভে করি দেখি যে, কী কারণে ১৯৯৭ সালে গড়ে ওঠা একটি হাসপাতাল ২০০৪ সালে এসে ডুবে গেল। বুঝতে পারলাম, এ হাসপাতালে তেমন কোনো সেবাই ছিল না। রোগীকে কোনো অ্যাটেনশন দেওয়া হতো না। হাসপাতালের মালিক মেজর জেনারেল রবের মায়ের নামে আয়েশা মেমোরিয়াল করেছিলেন। তিনি খুবই ভালো মানুষ, কিন্তু তার আশপাশের লোকজন মানুষকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখত। এসব কারণে হাসপাতালের বদনাম রটে। আমরা হাতপাতালটি নেওয়ার তিন মাসের মধ্যেই চেহারা বদলে গেল। ৫০ শয্যার মধ্যে ৩৫টি বেড সবসময় পূর্ণ থাকতে শুরু করল। তা দেখে মেজর জেনারেল রব একদিন বললেন, আশীষ তুমি কীভাবে চালাচ্ছ? এখন রোগী আসছে কেন? তখন আমি তাকে ঘটনাগুলো খুলে বললাম। দেখুন, সবাই একটু ছাড় পেতে পছন্দ করে, ছুটির সময় অল্প কিছু টাকা ছাড় দিলে কিন্তু তারা আবার ওই হাসপাতালে আসে। এভাবেই তো মুখে মুখে হাসপাতালের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
মাসিদ রণ : ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজের অগ্রযাত্রা নিয়ে জানতে চাই...
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : ২০১৩-১৪ সেশনে আমরা ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পাই। এটি একটি আড়াইশো শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হয় সে সময়। মেডিকেল কলেজের নাম ইউনিক হতে হয় বলেই আয়েশা মেমোরিয়ালের নাম বদলে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ করা হয়। একসঙ্গে আমরা হাসপাতালের নামটিও একই নামে রূপান্তর করি। এখন এটি ৫০০ শয্যা অনুমোদিত, কিন্তু ৩৫০ শয্যা অপারেশনে আছে।
তাপস রায়হান : আপনার কি মনে হয়, একজন চিকিৎসক হওয়ার ফলে হাসপাতাল পরিচালনা করা অনেক সহজ বিষয়?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : যে কোনো কাজে অবশ্যই পেশাদার লোক থাকতে হবে। তবে সেই কাজটি আরও বেগবান হয় যদি নীতিনির্ধারক পর্যায়েও কর্মসংশ্লিষ্ট কেউ থাকেন। আপনাদের গণমাধ্যমের কথাই বলি, এখানে একজন সাংবাদিক যখন প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন তখন যত গতি বাড়বে, আর একজন ব্যবসায়ী বা করপোরেট জগতের কেউ যদি সেই দায়িত্বে থাকেন তাহলে কিন্তু একই রকম হবে না। তেমনি হাসপাতালের ক্ষেত্রেও যখন পরিচালনা পর্ষদে একজন চিকিৎসক থাকেন তখন সুবিধা হয়। আমার ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে। কারণ আমি অসুবিধাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি, আর সে অনুযায়ী দ্রুত সমাধান করতে পারি। একটা উদাহরণ দিই, আমি যখন হাসপাতালের পরিচালক হলাম তখন খেয়াল করে দেখলাম অপারেশন থিয়েটার আছে তিনটি, তারমধ্যে দুটিই কাজ করছে না। কারণ ‘ডায়াথার্মী’ মেশিন নষ্ট, যা দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করা হয়। যেটা অপারেশনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মেশিন। কিন্তু আগে যেহেতু মেডিকেল রিলেটেড কেউ ম্যানেজমেন্টে ছিল না, তারা ভেবেছে এটা পরে ঠিক করলেও হবে। কিন্তু সেটি ওই মুহূর্তেই ঠিক করা জরুরি। এটি আমি চিকিৎসক বলেই বুঝেছি। কভিডের পরিস্থিতি নিশ্চয়ই মনে আছে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ ছিল। কিন্তু আমি চিকিৎসক বলেই রোগীর কথা চিন্তা করেছি। আমার টিম নিয়ে পুরো কভিডে কাজ করে গেছি। সে সময় দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, ব্যাংক, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন শিল্পীদের সংগঠন আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই কাজের জন্য আমরা কভিড হিরো অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি।
তাপস রায়হান : এত হাসপাতালের মধ্যে ইউনিভার্সেল হাসপাতালের বিশেষত্ব কোন জায়গায়?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : ইউনিভার্সেলে দরিদ্র মানুষের জন্য দশ শতাংশ বেড ফ্রি। এরমধ্যে অপারেশন খরচও যুক্ত। শুধুমাত্র টেস্ট আর কিছু ওষুধপত্রের জন্য আলাদা পেমেন্ট করতে হবে। এছাড়া এমন কিছু কাজ করি যেগুলো একেবারেই মানবতার তাগিদে। আর্থিক অসুবিধার কারণে অনেক রোগী হয়তো বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েও ফিরে এসেছে। তাদের আমরা ভর্তি করে পুরো চিকিৎসা খরচ বহন করেছি। আমাদের এখানে অনেক দুস্থ শিল্পী ভর্তি হন, তাদেরও আমরা সাধ্যমতো সাহায্য করি। শুধু তাই নয়, আমার হাসপাতালটি রেলগেটের পাশে অবস্থিত হওয়ায় অনেক রেলে কাটা বেওয়ারিশ লাশ আমি নিজ দায়িত্বে চিকিৎসা করি। এর ফলে আমাদের কিছুটা ঝামেলায়ও পড়তে হয়। তাও মানবিক কাজগুলো আমরা করছি এবং সারা জীবন করে যাব। একই ছাদের নিচে চিকিৎসার পরিপূর্ণ সেবা পাওয়া যাবে ইউনিভার্সেলে। এখানে জিরো থেকে অ্যাডাল্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ারসমৃদ্ধ আইসিইউ সেন্টার রয়েছে প্রায় ১০০ বেডের, ওয়ান স্টপ কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েয়ে যেখানে হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু করে বাইপাস সার্জারি পর্যন্ত করা সম্ভব, গাইনিতে ২৪ ঘণ্টা স্পেশালিস্ট সার্ভিস রয়েছে, ২৪ ঘণ্টা কার্ডিওলজিস্ট সার্ভিস, ল্যাব সার্ভিস, ট্রমা ম্যানেজমেন্ট টিম রয়েছে, ক্রিটিক্যাল অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, ক্রিটিক্যাল হেলিকপ্টারের চুক্তিও রয়েছে। অর্থাৎ এটি একটি ওয়ান স্টপ টার্সিয়ারি কেয়ার হসপিটাল। যেখানে উন্নত বিশে^র তুলনায় কম খরচে সব সেবা বিদ্যমান। এবং যা রাজধানীর একটি সেন্টার পয়েন্ট মহাখালীতে অবস্থিত। এসব কারণেই ইউনিভার্সের হাসপাতালে রোগীরা ভরসা করে গিয়ে থাকেন। ভবিষ্যতে আমরা চিকিৎসাসেবায় আরও নতুন বিষয় যুক্ত করব। যেমন অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্ট। যখন রোগীকে শুরু থেকেই এমন একটি টার্সিয়ারি কেয়ার হসপিটালে ভর্তি করা হয়, তখন তার চিকিৎসা শুরু থেকেই সেভাবেই শুরু হয়। ফলে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
এছাড়া প্রতি মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন দরিদ্র মানুষের একটি অপারেশন আমরা সম্পূর্ণ ফ্রিতে করে দেব। আপনাদের সম্মানে এই ঘোষণাটি আমি আজ দেশ রূপান্তরের আড্ডার মাধ্যমেই ঘোষণা দিয়ে গেলাম।
তাপস রায়হান : আপনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন। শোনা যাচ্ছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে লড়বেন। এর পেছনের কারণ কী?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : আসলে রাজনীতির অপর নামও তো মানবসেবা। চিকিৎসা পেশার মাধ্যমে আমি হয়তো শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিষয়ক সেবা প্রদান করি। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হলে সেই সেবা আরও বড় পরিসরে করার সুযোগ থাকে। তাই আমি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাচ্ছি। তাছাড়া আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বহু বছর আগে থেকেই। কুমিল্লা মেডিকেলে পড়ার সময় কালচারাল সেক্রেটারি ছিলাম। অনেক বড় বড় কালচারাল প্রোগ্রাম তখন করেছি। সে সময় বিভিন্ন কর্মকা- করার দায়ে এবং ১৫ আগস্ট জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী পালনের দায়ে আমরা কয়েক বন্ধুর হোস্টেল সিটসহ ছয় মাসের ছাত্রত্ব পর্যন্ত বাতিল হয়েছিল। তবে এসব কথা তো সচরাচর বলা হয় না, যারা কাছ থেকে আমাকে চেনেন তারা জানেন বিষয়গুলো। শুধু রাজনৈতিক কর্মকান্ডই নয়, চিকিৎসা পেশায় আসার পরও আমি সাধ্যমতো এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ২০১০ সালে মৌলবাদী রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিজয়ের ৪০ বছর উপলক্ষে বিশাল কনসার্ট করি। সেটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১০ বছর পর কোনো বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল। আমার এলাকায় বাবার নামে ‘আশুতোষ চক্রবর্ত্তী স্মারক শিক্ষাবৃত্তি’ প্রদান করি। প্রতি বছর একজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেই বৃত্তি মেধাবীদের মধ্যে প্রদান করা হয়। সরাইলে বিশেষ দিবস ও দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পসহ বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে বড় আয়োজনের একটি আমার এলাকার দুর্গাপূজা। সেটিও আমি করে আসছি অনেক বছর ধরে। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উদাহরণ। কভিডেও নানা ধরনের স্বাস্থ্য উপকরণ বিতরণ করেছি।
তাপস রায়হান : আপনি নির্বাচনে জয়ী হলে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী : সংসদ সদস্যরা সাধারণত কাবিখা, রাস্তাঘাট নির্মাণ এসব নিয়েই কাজ করেন। কিন্তু আমি একটু অন্যভাবে চিন্তা করেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তাÑ এই তিনটি বিষয়ের দিকে আমার নজর থাকবে সবচেয়ে বেশি। আমাদের এলাকার মানুষ আর্থিকভাবে একেবারে খারাপ নেই, কিন্তু শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়েছে আমার। স্কুলগুলোকে আরও আধুনিকায়ন করতে চাই। শিক্ষকদের মানোন্নয়নে কাজ করতে চাই। যে স্কুলগুলোকে সরকারিকরণ করলে আরও ভালো ফলাফল আসবে সেগুলো করতে চাই। স্বাস্থ্য খাতে কিছু অঙ্গীকার আমি আগেও করেছি বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারণায়। তারমধ্যে রয়েছে আমার আসন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২-এ একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করতে চাই। সরাইল ও আশুগঞ্জের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে আধুনিকায়ন করতে চাই। কারণ আমি হতাশ হই যে, মানুষ এসব হাসপাতালে গেলে নাকে হাত দিয়ে ঢোকে। তারমানে এখানে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। আর আমার যেহেতু হাসপাতাল পরিচালনার স্পেশালিটি রয়েছে তাই এগুলো করা আমার পক্ষে সহজ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটা অভিযোগ সব সময় পাওয়া যায়। তা হলো চিকিৎসক থাকে না। আমি যদি চিকিৎসকদের কমপ্লেক্সের পাশেই আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাহলে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে আর সমস্যা হবে না। ফলে মৃত্যুর আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। স্টেমি সেন্টারের ব্যবস্থা করতে চাই। যাতে হার্ট অ্যাটাক হলে দ্রুত তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যায়।
রোগী আর চিকিৎসকের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটির অন্যতম কারণ পকেট থেকে নগদ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করা। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে কিন্তু মেডিকেল বীমার মাধ্যমে চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করা যায়। আমাদের দেশেও এটিকে বাধ্যতামূলক করা হোক। খুব উপকার পাবে সাধারণ মানুষ। ভারতের সবচেয়ে অনুন্নত রাজ্য ত্রিপুরাতেও মানুষ এই স্বাস্থ্য বীমার সুফল ভোগ করছে। আরেকটি বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তার যত মেগা প্রজেক্ট আছে, তার পিপিপির আওতায় হচ্ছে। দেশের ১০০টি বেসরকারি হাসপাতালকেও যদি পিপিপির আওতায় আনা যায় তাহলে পিপিপি আমাদের ফান্ডিং করে বলে দেবে, চিকিৎসার খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে। এতে সরকারি হাতপাতালের ওপর চাপ কমবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিরাপদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পিপিপি স্বাস্থ্য খাতের অস্থিরতা দূর করতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এগুলো সব ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া। এছাড়া আমার এলাকায় কিছু কবরস্থান ও শ্মশানঘাট রয়েছে যা খুবই জীর্ণশীর্ণ। মানুষের শেষ ঠিকানা এগুলো। এগুলোর উন্নয়ন করতে চাই। আমাদের নেয়ামতপুরের দুর্গা মন্দির দুর্বৃত্তদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি সংস্কারের জন্য আমি স্থানীয় সরকার বিষয়কমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সাহায্য চাওয়া মাত্র তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটা পাস করে দিয়েছেন। ঘটনাটি জানার পর মন্দির কমিটি উল্লাসে ফেটে পড়ে। আসলে সাধারণ মানুষের খুব সাধারণ সব চাওয়াটা পূরণ করা কঠিন কিছু নয়। অনেকেই আমার সমালোচনা করেন যে সরাইলে খুব বেশি দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে থাকে। জননিরাপত্তার জন্য এটি বন্ধে আমি উদ্যোগ নেব। এছাড়া আমার এলাকাকে দৃষ্টিনন্দন করতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা সাজানো আছে আমার।
লিখেছেন : মাসিদ রণ
ছবি : আবুল কালাম আজাদ
লোকেশন : গ্রিন লাউঞ্জ