ঢাকায় ম্যালেরিয়া রোগের বাহক অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এর আগে অল্পবিস্তর কিছু মশা পাওয়া গেলেও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এবারই প্রথম এই মশার পাশাপাশি মশার লার্ভা পেলেন গবেষকরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, তারা এত দিন ঢাকার বাইরে থেকে আসা কিছু ম্যালেরিয়া রোগী পেলেও অ্যানোফিলিস মশা বা মশার লার্ভা পায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষক গত ২৩ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভেতর ও করপোরেশনসংলগ্ন স্থানে পূর্ণাঙ্গ অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পান। মশা ও লার্ভা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে রাখা হয়েছে। লার্ভা থেকে উৎপন্ন পিউপা ও পিউপা থেকে রূপ নেওয়া পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করবেন তারা। তারপর তা প্রকাশ করা হবে।
এ ব্যাপারে গবেষক দলের প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা ও সেই মশার লার্ভা খুঁজতে গিয়ে অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পেয়েছি। গত ২৩ মার্চ উত্তর সিটিতে ও উত্তর সিটির কাছাকাছি একটা জায়গায় পূর্ণাঙ্গ অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অনেক লার্ভা আছে সেখানে। সেখান থেকে ১২টা লার্ভা সংগ্রহ করেছি।’
এই গবেষক আরও বলেন, ‘এখনো বলতে পারছি না এই লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা পাওয়ার কারণে ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি কী হবে। কারণ আরও কাজ করতে হবে। আশা করছি, আগামী ম্যালেরিয়া দিবসে পূর্ণাঙ্গ বিষয়টি জানাতে পারব।’
এই মশা ও লার্ভা পাওয়ার ঘটনায় শহরাঞ্চলেও ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা তৈরি হলো বলে মনে করছেন গবেষকরা। এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছেন না অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারাও। তারা মনে করছেন, ঢাকায় যেহেতু বিভিন্ন সময় ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে, তাই ভবিষ্যতে এসব রোগী ও মশার সান্নিধ্য ঘটলে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
লার্ভা এবারই প্রথম : ঢাকায় এত দিন অল্পবিস্তর কিছু অ্যানোফিলিস মশা পেলেও এবারই প্রথম এ মশার লার্ভা পাওয়া গেল বলে জানান অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। এই কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক বলেন, ‘অ্যানোফিলিস মশা কামড়ের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগটি ছড়ায়। যদি ওই মশার দেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণু থাকে তবেই নতুন কেউ আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে অ্যানোফিলিস মশার ৩৬টি প্রজাতি আমরা পেয়েছি। একেক প্রজাতি একেক রকম। একেক জায়গায় হয়।’
তবে সরকারিভাবে ঢাকায় এখনো ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া যায়নি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ম ম আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকায় এই মশা বা মশার লার্ভা নেই। কেউ যদি পেয়ে থাকেন, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
অনুরূপভাবে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া যায়নি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজেস) ও বর্তমানে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মোহাম্মদ জহিরুল করিম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি ২০২১ সালে বদলি হয়ে হাসপাতালে আসি। তখন পর্যন্ত ঢাকায় এই মশা বা মশার লার্ভা পাওয়া যায়নি। আমরা অনেক সময় ম্যালেরিয়া রোগী পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সার্ভেও করেছি। কিন্তু মশা পাইনি। পরে দেখা গেছে, সব রোগী বাইরে থেকে রোগটি নিয়ে এসেছে।’
এই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, কবিরুল বাশার ভালো গবেষক। তিনি পেলে সত্যতা আছে। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
শহরাঞ্চলে ছড়ানোর আশঙ্কা কতটুকু : অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার মনে করেন, ঢাকায় অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া গেলে অন্য শহরগুলোতেও থাকতে পারে। এতে করে কিছুটা সন্দেহ করা যায় যে শহরাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে। আরবান ম্যালেরিয়া যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে, বাংলাদেশেও সেটা হতে পারে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাংলাদেশ এখনো ম্যালেরিয়ামুক্ত হয়নি। শহরকেন্দ্রিক ম্যালেরিয়া শুধু বান্দরবান শহরে হয়। অন্য জেলাগুলোতে শহরে হয়নি।
ডা. ম ম আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে নগরকেন্দ্রিক ম্যালেরিয়া নেই। শহরাঞ্চলে ম্যালেরিয়া থাকার কোনো উদাহরণ আমরা এখনো পাইনি।’
তবে শুধু অ্যানোফিলিস মশা থাকলেই হবে না, সেই মশাকে ম্যালেরিয়ার বাহক হতে হলে রোগী লাগবে বলে জানান ডা. মোহাম্মদ জহিরুল করিম। তিনি বলেন, ‘এই জীবাণু বা প্যারাসাইট হতে মশার একটা ন্যূনতম ঘনত্ব লাগে। ঘনত্ব ওই পর্যায়ে গেলে তখন রোগটি ছড়িয়ে যাবে। এটাকে আমরা এপিডেমিক বলে। অর্থাৎ অনেক ছড়িয়ে যাবে।’
এই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, দুটি জিনিস লাগবে। একটি হলো ওই মশার অঞ্চলে কাউকে ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ে যেতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হলো, ওই মশার ঘনত্ব একটা ন্যূনতম পর্যায়ে থাকতে হবে। তাহলে ম্যালেরিয়া ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
ঢাকায় নতুন করে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ও রকম আশঙ্কা নেই। যদি সেটা হতো তাহলে এত দিনে সারা বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে যেত। এত দিনে একটু একটু করে এগোনোর কথা। কিন্তু গত ২৪ বছরে সেটা হয়নি। আক্রান্ত গ্রামের পাশের গ্রামে ম্যালেরিয়া হয়নি এমন উদাহরণও আছে।
১৩ জেলায় ম্যালেরিয়া, ২ জেলায় ঝুঁকি : ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ থেকে এখনো ম্যালেরিয়া নির্মূল করা যায়নি। তবে নির্মূলের পর্যায়ে আছে। ধাপ অনুযায়ী নির্মূলের চিন্তা করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে ময়মনসিংহ ও সিলেট জোনে, এরপর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় নির্মূল করা হবে। পরের ধাপে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি।
এই কর্মকর্তা জানান, তিন জোনের মধ্যে ময়মনসিংহ ও সিলেটে প্রি-এলিমিনেশন ফেজ (প্রাক-নির্মূলপর্যায়) চলছে। বান্দরবানে কন্ট্রোল ফেজ (নিয়ন্ত্রণপর্যায়) চলছে। অর্থাৎ এখানে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে, তবে কিছু সংক্রমণ এখনো হচ্ছে। কিন্তু সেই সংখ্যা খুব বেশি না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের কারণে অবস্থার কিছুটা অবনতি হয়েছে। নির্মূলের লক্ষ্য ২০২৭ সাল। ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া মুক্ত ঘোষণা করা হবে জেলাটিকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়া রোগী ছিল ১৬ হাজার ৫৬৭ ও মারা যায় ৬ জন। এর আগের বছর ২০২২ সালে রোগী ছিল ১৮ হাজার ও মৃত্যু ১৪।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের ১৩ জেলার মধ্যে ৮ জেলায় প্রি-এলিমিনেশন চলছে। এর মধ্যে আছে ময়মনসিংহ জোনে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর। আর সিলেট জোনে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। এই আট জেলায় ম্যালেরিয়া একেবারেই শূন্যের কোঠায়। এসব জেলায় বছরে দু-একটা রোগী পাওয়া যায়, তাও সেগুলো অন্য জেলা থেকে আসা।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরও জানান, ম্যালেরিয়া পরিমাপকের স্কেল এপিআই (অ্যানুয়াল পারাসাইট ইনডেক্স)। এই সূচক দিয়ে এই রোগের মাত্রা ও সংক্রমণ কোনপর্যায়ে আছে, সেটা পরিমাপ করা হয়। এই ইনডেক্সের মান যদি ১-এর নিচে থাকে, তখন সেই জেলা বা দেশকে ম্যালেরিয়া নির্মূল বা শূন্যের পর্যায়ে আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
এই এপিআই অনুযায়ী, দেশের ১১টিট জেলার এপিআই-১-এর নিচে আছে। শুধু রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে এপিআই-১-এর ওপরে। অন্যান্য জেলায় যে রোগী, সেগুলো বাইরে থেকে আসা, স্থানীয় সংক্রমণ নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাকি ৫১ জেলায় ম্যালেরিয়া নেই। ১১ জেলায় দু-একটা রোগী আছে, যারা অন্য জেলা থেকে সংক্রমিত হয়ে আসা। বাকি দুই জেলা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ।