বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়ানোর পরও গত কয়েক বছরে দেশে দায়মুক্তির অনেক ঘটনা ঘটেছে। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বেলায়ও দায়মুক্তির মতোই ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া হাল আমলে আরও অনেকে প্রবল প্রভাব দেখিয়ে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন। অনিয়মের হোতা এসব ব্যক্তিকে নিয়মের বেড়াজালে নিয়ে একপর্যায়ে অনুকম্পা দেখানো হয়েছে। এমনকি তারা দুর্নীতি করেননি এমন সাফাই গেয়েছে রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলো। অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের গতি শ্লথ হয়ে যায় বা পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াই ঝুলে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি এমন স্বীকৃতি বা দায়মুক্তিও দেওয়া হয়।
এমন পরিস্থিতিতে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদকেও কি আইনের কাঠামোয় ফেলে দায়মুক্তি দেওয়া হবে? বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা মুখে যেন কুলুপ এঁটে বসে আছেন। তারা এ বিষয়ে টুঁ-শব্দটি করছেন না। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ দায়মুক্তি পাচ্ছেন না। তার সম্পদের অনুসন্ধান করা হবে এবং অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলা করা হবে।
প্রভাবশালী আইজিপি ছিলেন বেনজীর আহমেদ। আইজিপি হওয়ার আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালক এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। কিন্তু বেনজীরের ঘনিষ্ঠতা ছিল আরও কয়েক স্তর ওপরে। দায়িত্বে
থাকাকালেই তার অঢেল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। মুখরোচক নানা গল্প ছিল রুপালি জগতের মানুষদের ঘিরেও। কিন্তু সেসব আমলে নেওয়ার সাহস করেনি কেউ। বেনজীর ক্ষমতার চর্চা করতে গিয়ে অতিপ্রভাবশালী কারও রোষে পড়ে যান। তার অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের বিবরণী প্রকাশ হতে শুরু করেছে, যা নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে দুদক। পাশাপাশি দেশ-বিদেশে তার আরও সম্পদ রয়েছে কি না তার খোঁজ চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অনেক এমপি-মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ জমা পড়ার পর অনুসন্ধানে নামে কমিশন। পরবর্তীকালে অনুসন্ধান শেষে কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়, কারও দায়মুক্তি দেওয়া হয়। আলোচিত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি হলে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এ কারণে বেনজীর ইস্যুতে সচেতন তারা। নতুন করে কোনো সমালোচনার সুযোগ দিতে চান না তারা। এ ইস্যুতে ভেবেচিন্তে কাজ করতে চায় কমিশন। বেনজীরের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কমিশন আগ বাড়িয়ে বা অতিমাত্রায় কিছুই করতে চায় না। অভিযোগ অনুসন্ধানে যেসব প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়ে থাকে, বেনজীরের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
পুলিশের সাবেক এ প্রধানের বিস্তর অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খবরের কাগজে ছাপা হলে জনসংযোগ শাখা তা কমিশনের নজরে আনে। বেনজীরের বিষয়টিও একইভাবে এগিয়েছে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানযোগ্য মনে করায় তা যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠায়। অন্যদের বেলায় যা ঘটেছে বেনজীরের বেলায়ও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে সাবেক আইজিপি বেনজীরের ঘনিষ্ঠতা আছে কি নেই, সেটি কমিশন বিবেচনায় নেয়নি। অভিযোগে এসেছে বেনজীর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। তাই নিয়ে এগিয়েছে কমিশন।
জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধান দলের কাছে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের অনেক নথিপত্র এরই মধ্যে চলে এসেছে। যার পর্যালোচনা চলছে। অভিযোগের বিষয়ে বেনজীর আহমেদকে দ্রুত জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় দুদক। এ কারণে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানকে দুদকে হাজির হওয়ার জন্য নোটিস দেওয়া হয়েছে। নোটিসে বেনজীরকে আগামী ৬ জুন এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের ৯ জুন সকাল ১০টায় হাজির হয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।
দুদকের বড় দুর্নীতির অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনুসন্ধান শেষে মামলা করার পরই আসামি ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকে। কিন্তু বেনজীরের অনুসন্ধানের শুরুর দিকেই সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে আসামি পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি ও গ্রেপ্তার করা হয়। বেনজীরের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা জানতে চাইলে দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের অভিযোগটি খুবই গুরুত্ব দিয়েছে কমিশন। আমাদের অনুসন্ধান টিমের কাছে তথ্য ছিল বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদ অন্যত্র হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা হতে পারে। কিন্তু সেটা যাতে না পারে, সেজন্য আদালতের মাধ্যমে সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। বেনজীরের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করা হলেও তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি ও তাকে এখনই গ্রেপ্তারের বিষয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। কারণ বেনজীরের বিষয়ে অন্যান্য সংস্থা দুদকের কার্যক্রম নিয়ে অবগত আছে। দুদক থেকেও বিষয়টি তাদের নজরে দেওয়া হয়েছে।’
দুদকের বেশিরভাগ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট নথিপত্র হাতে পাওয়ার পর অভিযুক্তের সম্পদ বিবরণী চাওয়া, জিজ্ঞাসাবাদ, সম্পদ জব্দ, আসামি পালিয়ে যেতে পারে সন্দেহ হলে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর মতো ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পেলে মামলা করা হয় এবং মামলার পর তদন্ত করে বিচার শুরুর জন্য আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, দুটি আদেশে বেনজীর পরিবারের ৬২১ বিঘা জমি ও ঢাকার চারটি ফ্ল্যাট জব্দ এবং ৩৩ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হয়। এর মধ্যে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গত বৃহস্পতিবার বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দেন। একইদিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয়।
এরপর গত রবিবার আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেয়। একইদিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও সাভারের জমি অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৫৮টি মামলা করেছে দুদক। কিন্তু একটি মামলায়ও ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা যায়নি। এমনকি তার বিদেশ গমন পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি। তিনি দুদকের অনুসন্ধান চলা অবস্থায় দুবাই যান, সেখান থেকে কানাডায় চলে যান। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বাচ্চুকে ৫৮টি মামলায় চার্জশিটে আসামি করা হয়েছে। তিনি দেশে ফেরার দুদিনের মাথায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এই কর্মকর্তার দাবি, দুদক বাচ্চুকে ছাড় দেয়নি, বেনজীরকেও ছাড় দেবে না। তিনি বলেন, অন্যান্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যেসব প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়ে থাকে, বেনজীরের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়ায় কাজ করতে চায় দুদক। দুদকের অনুসন্ধান টিম শুক্র-শনিবার, এমনকি রাত ১০-১১টা পর্যন্ত কাজ করছে। এটি দায়মুক্তির দেওয়ার জন্য করছে না। দুদকের অনুসন্ধানে তার ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলা করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির অনুসন্ধান করে প্রমাণ পেলে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে। আগে অনুসন্ধান শেষ হোক।’
কেন বেনজীরের দায়মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় : বিগত বছরগুলোতে দেশের অনেক এমপি-মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ দুদকে জমা হওয়ার পর জোরেশোরে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। পরে এসব অনুসন্ধানের গতি হ্রাস পায়, অনেকে আবার দায়মুক্তি পেয়েছেন। গত দুই বছরে দুদক থেকে অনেক আলোচিত ব্যক্তি দায়মুক্তি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য আছেন আটজন। তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে নিজেদের রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ ও তদবির শুরু করেন। একপর্যায়ে সফলও হন। দায়মুক্তির তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর নাম। তিনি গত বছর জুনে দায়মুক্তি সনদ পান। তার বিরুদ্ধে দুই দফা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুবারই দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে দায়মুক্তির সনদ পেয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, শেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক ও চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা, সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও বিএম মোজাম্মেল হক।
এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেতে তদবিরের তালিকায় রয়েছেন ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরী। তবে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান এখনো চলমান।