বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

অন্তুর বইমেলা

আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৩৫ এএম

অন্তুর জন্ম আমেরিকায়, কতই বা বয়স ওর। সবে বারো পেরিয়ে তেরো বছরে পড়েছে। সপ্তম গ্রেডে পড়ছে। প্রতি বছর সে স্কুলে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সক্রিয় থাকে। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির সময় বাংলাদেশে যাওয়ার, ভাষার মাসে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো, আরও কত কী? যদিও অন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক বইমেলা, ডিসি বইমেলায় কয়েকবার গেছে। কিন্তু টিভিতে দেখা একুশের বইমেলার সুবাসটা সেখানে সে পায় না। সেই সুবাসটা পাওয়ার জন্যই একদিন খাবার টেবিলে বাবার কাছে আবদার পাড়ে।

বাবা, একটা কথা বলব?

কী?

আগামী বছর জানুয়ারির শেষে বাংলাদেশে যেতে চাই।

কেন?

ফেব্রুয়ারির একুশের বইমেলায় আমি যেতে চাই। তা ছাড়া

কী?

ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি করে পুষ্পস্তবক দিতে চাই।

আমার অসুবিধা নেই, কিন্তু ওই সময় তো তোমার স্কুল খোলা থাকবে, ক্লাস মিস হবে না?

না, তা হবে না। আমি স্যারদের সঙ্গে কথা বলে অনলাইনে ক্লাস করার ব্যবস্থা করে নেব।

তা যদি করতে পারো তাহলে আমার অসুবিধা নাই।

বাবার সম্মতি পেয়ে অন্তু খুশিতে চিৎকার করে ওঠে, হিপ হিপ হুররে!

এবার সব গোছানোর পালা। মাও প্রস্তুতি শুরু করে দেয়।

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে অন্তুরা প্লেনে চেপে বসে। দীর্ঘ আঠারো ঘণ্টার লম্বা জার্নি শেষে ভোরবেলা ঢাকার বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিমানের চাকা স্পর্শ করতেই তার সারা শরীরে ভালো লাগার আবেশ খেলা করে যায়। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে আসতেই ছোটকার মুখোমুখি হয় অন্তু। আদরে আদরে তাকে ভরিয়ে দেয় ছোটকা। পথের দু’পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একসময় গাড়ি এসে থামে বাড়ির গাড়ির বারান্দায়। দাদু, দিদা তাকে বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে।

দীর্ঘ বিমানযাত্রার ধকল কাটাতেই কয়েক দিন পার হয়ে য়ায়। এরই ফাঁকে চলে ছোটকার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ, সেখানে ছিল একুশের বইমেলার প্রসঙ্গও। চারুকলার তুখোড় চিত্রশিল্পী ছোটকার কাছে বইমেলার কথা শুনতে ভালোই লাগছিল অন্তুর।

জানিস অন্তু, বইমেলা ঘিরে বইপ্রেমী আর লেখকদের যে জমজমাট আড্ডাটা হয় তার তুলনা নেই। প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই। নতুন বইয়ে ম ম করে চারদিক।

জানিস তো, জগতের বড় বড় মানুষ, বিশ্বের যত জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিপ্লবী এবং স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, তারা সবাই কিন্তু বইয়ের পোকা ছিল। বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার সঙ্গে সবসময় বই থাকত, বিশ্বখ্যাত আলেকজান্ডার দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বই পড়তেন।

জানি তো।

কোত্থেকে জানলি?

বই পড়েই জেনেছি।

কথার ফাঁকেই অন্তু ছোটকার সঙ্গে বইমেলায় যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করে নেয়।

ইতিমধ্যে দরজায় কড়া নাড়ে ফেব্রুয়ারি। পহেলা ফেব্রুয়ারি বিকালবেলা ছোটকার হাত ধরেই সে বইমেলার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ঝা চকচকে মেট্রোরেলে চেপে বসে। মিনিট বিশ-পঁচিশের মধ্যেই তারা পৌঁছে যায় বইমেলা প্রাঙ্গণে। বইমেলার গেটে মানুষের ভিড় দেখে ভালো লাগে তার। ভেতরে ঢুকে দেখে বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে সারি সারি বইয়ের স্টল। ছোটকার হাত ধরে সে বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। প্রতিটি স্টলেই থরে থরে সাজানো রয়েছে বই।

অন্তু ভিড় ঠেলে ঠেলে বর্ধমান হাউজ ও এর আশপাশ ঘিরে জমে ওঠা লেখকদের জমজমাট আড্ডায় এসে পৌঁছায়। অন্তু বাংলা ভাষায় ছোটদের জন্য লিখিত বই পড়েছে। ওর প্রিয় লেখকদের কয়েকজনকে পেয়েও যায়। ভরে উঠতে থাকে তার অটোগ্রাফের খাতা, সঙ্গে চলতে থাকে হাসিমুখে ছবি তোলা।

আরেক দিন ছোটকা এসে বলে, অন্তু কাল সকালে রেডি

থাকিস। বইমেলার শিশুপ্রহরে নিয়ে যাব।

শিশুপ্রহর কী ছোটকা?

বইমেলায় তো দেখলিই কেমন ভিড় থাকে। এই ভিড়ের মধ্যে শিশুদের অনেক কষ্ট হয়। সে জন্য ছুটির দিনগুলোতে সকালবেলাতেও মেলা খোলা থাকে। এই ব্যবস্থা বিশেষ করে শিশুদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে করা হয়েছে বলে এর নাম শিশুপ্রহর।

ওহ, আচ্ছা!

পরদিন ছুটির দিনে সকালবেলা ছোটকার সঙ্গে অন্তু বইমেলার পথে পা বাড়ায়। বইমেলার প্রাঙ্গণে ঢুকে সে দেখে বাংলা একাডেমিসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুখর হয়ে উঠেছে শিশু-কিশোরদের পদচারণায়। সবার চোখে মুখেই আনন্দ আর কৌতূহলের ছাপ। তারা স্টলে ঘুরে ঘুরে দেখছে বই। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে অন্তুর দেখা হয়ে যায় সিসিমপুরের চরিত্র হালুম, টুকটুকি, শিখু ও ইকরিদের সঙ্গে। তাদের কাছে পেয়ে অন্য শিশু-কিশোরদের মতো অন্তুও উল্লাসে মেতে ওঠে।

মেলায় ঘুরতে ঘুরতে শিশুপ্রহরের সময় শেষ হয়ে আসে। অন্তু ছোটকার সঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে এসে মেট্রোরেলের স্টেশনের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে। ভিড় দেখে অন্তুর মনে হলো, যদি অটোগ্রাফের খাতাসহ বই-ব্যাগটা হারিয়ে যাক। বই তো আবার কেনা যাবে, কিন্তু অটোগ্রাফের খাতাটা? এ কথা মনে হতেই সে খাতাটা বুকে ধরে হাঁটতে লাগল। ছুটকা বুঝলেন সবই। মুচকি হেসে ওকে অনুসরণ করতে লাগলেন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত